jugantor
আসছে ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ

  আলাউদ্দিন আরিফ  

০৮ মে ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ ও ‘স্যালাইন সেট’ রিপ্যাকিং (পুনঃমোড়কজাতকরণ) করে বাংলাদেশে এনে বাজারজাত করছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। পাশাপাশি কাগজপত্রে অন্য পণ্যের নাম ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা হচ্ছে জীবণরক্ষাকারী ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম। অবৈধভাবে আসা এসব ওষুধ ও সরঞ্জামের মানদণ্ড নিশ্চিত না করে বাজারজাত করায় এগুলো সেবন ও ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত যে কোনো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সব সময় থাকছে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বুধবার তার সরকারি দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘বহু দিন থেকেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। এছাড়া আমরা গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরেছি চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহƒত নিডেল, সিরিঞ্জ ও ইনফিউশন সেট (স্যালাইন সেট, নিডেল, সিরিঞ্জ) রিপ্যাকিং হয়ে বাংলাদেশে আসছে। এগুলো আনা হচ্ছে ব্লিস্টার প্যাক ও রিবন প্যাকে। এসব সুই-সিরিঞ্জে ‘জীবাণুমুক্ত’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ‘জীবাণুযুক্ত’।

ড. মইনুল খান আরও বলেন, চট্টগ্রামের বুদস্ সেট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ‘গার্মেন্টস পণ্য’ ঘোষণা দিয়ে ৭৫ কার্টন নিউরোপেথিক ব্যথানাশক ওষুধ আমদানি করেছে। সোমবার তারা ৩৭টি কার্টন শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে খালাস করে নেয়। বাকি কার্টনগুলোও খালাসের চেষ্টা চলছিল। ওই অবস্থায় ওষুধগুলো জব্দ করা হয়।

‘আমদানিকৃত মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইনফিউশন সেট ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতীত খালাস প্রদান’ শিরোনামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইনফিউশন সেট আমদানির কোনো প্রকার অনুমতি বা ছাড়পত্র দেয়নি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু সিআইসেল (কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে দেশের ১৫৮ জন আমদানিকারক ৫৯৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার ২০৪ টাকার ইনফিউশন সেট আমদানি এবং খালাস করে নিয়েছেন।’

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইনফিউশন সেট আমদানি নীতি আদেশ অনুসারে একটি নিয়ন্ত্রিত পণ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এসব পণ্যের উৎপাদনকারী দেশ, পণ্যের গুণাবলী, দাম, উৎপাদনকারীর রেকর্ড ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে তা আমদানির অনুমোদন দিয়ে থাকে। এসব পণ্য মানবদেহে সরাসরি ব্যবহৃত হয় বিধায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদনে উল্লেখিত উৎপাদক ব্র্যান্ডের বাইরে নিুমানের পণ্য আমদানি করা হলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনবিহীনভাবে বিভিন্ন শুল্ক ভবন দিয়ে আমদানি ও খালাস করা ইনফিউশন সেট ব্যবহার মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের মেডিকেল বা সার্জিক্যাল পণ্য কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। এসব পণ্য ব্যবহারে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত হয় এমন যে কোনো রোগ হতে পারে। এ ধরনের রোগের আক্রমণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ও স্যালাইন সেট শুধু একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি হয়ে থাকে। এমনকি একই ব্যক্তির শরীরেও এসব পণ্যের অধিক ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।

অবৈধভাবে আসা এসব পণ্য ব্যবহারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক নজরুল এগুলোর আমদানি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আটক সংক্রান্ত শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের একাধিক প্রতিবেদন যুগান্তরের হাতে রয়েছে। এর একটিতে বলা হয়েছে, দেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানির শর্ত পূরণ না করে কুরিয়ার সার্ভিস বা বিভিন্ন অবৈধপথে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ৫ মার্চ ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ৯৮ কেজি ওষুধ আটক করা হয়। এর মধ্যে ছিল ক্যানেসটেন ক্রিম, জেনিক্যাল অরলিস্টে, ইমিগ্রান, ফুসটাম জেলসহ বিভিন্ন ওষুধ। ভুয়া এলসির মাধ্যমে যার মূল্য দেখানো হয়েছিল মাত্র ৯৮ ডলার। প্রকৃতপক্ষে এসব ওষুধের দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। ২৬ ফেব্র“য়ারি ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ‘হেলথ প্রোডাক্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা দুই কার্টন ওষুধ জব্দ করা হয়। ওষুধের মধ্যে ছিল স্যাবলি ৫০০ এমজি, লেসকল ফ্লুভাসটিন, ডিমকর্ন এমআর, মাইকেলিক ইনজেকশন, গ্লোনাল এফ ৭৫ আইইউ জাতীয় ওষুধ, যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ টাকা। এছাড়া ১৯ মার্চ ‘ফ্রি মেডিসিন স্যাম্পল’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ওষুধের চালান আটক করা হয়। যার মধ্যে ছিল ৬৫ লাখ টাকার পলিক্যাপ ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ। আর ৪ মে জব্দ করা হয় ৪৭২ কেজি ব্যথানাশক ওষুধ, যা আমদানি করা হয়েছিলে গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা দিয়ে। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এই চালানটির এলসি, বিল বাউচার সবই ছিল ভুয়া। জালজালিয়াতির মাধ্যমে এসব ওষুধের ৩৭ কার্টন খালাস ও বাকি অংশ খালাসের চেষ্টা চলছিল। পরে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খালাস হওয়া ৩৭ কার্টনসহ সব ওষুধ জব্দ করেন। শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক জানান, এসব ওষুধ খালাসের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার মতে, এসব ওষুধের সঙ্গে ফার্মেসি মালিক, ওষুধ ব্যবসায়ী, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাসহ অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আইয়ুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ওষুধের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ জড়িত। ওষুধ আমদানি করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হবে। এর বাইরে ওষুধ আমদানি করার সুযোগ নেই। সুই-সিরিঞ্জসহ ইনফিউশন সেট আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভাইস। এর জন্য অবশ্যই পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ রিপ্যাক করে আমদানির কোনো সুযোগ নেই। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে বাজারে যেসব ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ পাওয়া যায় তা একবার ব্যবহার করলেই অকার্যকর হয়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া বাংলাদেশ ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এগুলো আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়লে ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ মান রক্ষা করে শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমোদন দেয়া যায়। কিন্তু চোরাইপথে কেউ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এগুলো আমদানির অভিযোগ পেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, চোরাইপথে আমদানি করা ওষুধ ব্যবহারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। ডিসপোজেবল নিডেল, সিরিঞ্জ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হবে। স্যালাইনসেট কেটে ফেলতে হবে। নিডেল ভেঙে ফেলতে হবে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চোরাচালান এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, একই সুই-সিরিঞ্জ একাধিকার ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস, এইডস, ক্যান্সারসহ যে কোনো রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। এসব ব্যবহারকারীর শরীরে ইনফেকশন হবে। তার মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি। তাছাড়া অবৈধভাবে আমদানি করা কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারেও বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। কারণ এগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।


 

সাবমিট

আসছে ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ

 আলাউদ্দিন আরিফ 
০৮ মে ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ ও ‘স্যালাইন সেট’ রিপ্যাকিং (পুনঃমোড়কজাতকরণ) করে বাংলাদেশে এনে বাজারজাত করছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। পাশাপাশি কাগজপত্রে অন্য পণ্যের নাম ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা হচ্ছে জীবণরক্ষাকারী ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম। অবৈধভাবে আসা এসব ওষুধ ও সরঞ্জামের মানদণ্ড নিশ্চিত না করে বাজারজাত করায় এগুলো সেবন ও ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত যে কোনো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সব সময় থাকছে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বুধবার তার সরকারি দফতরে যুগান্তরকে বলেন, ‘বহু দিন থেকেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। এছাড়া আমরা গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরেছি চীনসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে ব্যবহƒত নিডেল, সিরিঞ্জ ও ইনফিউশন সেট (স্যালাইন সেট, নিডেল, সিরিঞ্জ) রিপ্যাকিং হয়ে বাংলাদেশে আসছে। এগুলো আনা হচ্ছে ব্লিস্টার প্যাক ও রিবন প্যাকে। এসব সুই-সিরিঞ্জে ‘জীবাণুমুক্ত’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ‘জীবাণুযুক্ত’।

ড. মইনুল খান আরও বলেন, চট্টগ্রামের বুদস্ সেট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ‘গার্মেন্টস পণ্য’ ঘোষণা দিয়ে ৭৫ কার্টন নিউরোপেথিক ব্যথানাশক ওষুধ আমদানি করেছে। সোমবার তারা ৩৭টি কার্টন শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে খালাস করে নেয়। বাকি কার্টনগুলোও খালাসের চেষ্টা চলছিল। ওই অবস্থায় ওষুধগুলো জব্দ করা হয়।

‘আমদানিকৃত মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইনফিউশন সেট ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতীত খালাস প্রদান’ শিরোনামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইনফিউশন সেট আমদানির কোনো প্রকার অনুমতি বা ছাড়পত্র দেয়নি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু সিআইসেল (কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে দেশের ১৫৮ জন আমদানিকারক ৫৯৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৯৩ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার ২০৪ টাকার ইনফিউশন সেট আমদানি এবং খালাস করে নিয়েছেন।’

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইনফিউশন সেট আমদানি নীতি আদেশ অনুসারে একটি নিয়ন্ত্রিত পণ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এসব পণ্যের উৎপাদনকারী দেশ, পণ্যের গুণাবলী, দাম, উৎপাদনকারীর রেকর্ড ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে তা আমদানির অনুমোদন দিয়ে থাকে। এসব পণ্য মানবদেহে সরাসরি ব্যবহৃত হয় বিধায় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদনে উল্লেখিত উৎপাদক ব্র্যান্ডের বাইরে নিুমানের পণ্য আমদানি করা হলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনবিহীনভাবে বিভিন্ন শুল্ক ভবন দিয়ে আমদানি ও খালাস করা ইনফিউশন সেট ব্যবহার মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের মেডিকেল বা সার্জিক্যাল পণ্য কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। এসব পণ্য ব্যবহারে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি এইডসসহ সুই দ্বারা সংক্রমিত হয় এমন যে কোনো রোগ হতে পারে। এ ধরনের রোগের আক্রমণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ও স্যালাইন সেট শুধু একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি হয়ে থাকে। এমনকি একই ব্যক্তির শরীরেও এসব পণ্যের অধিক ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।

অবৈধভাবে আসা এসব পণ্য ব্যবহারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক নজরুল এগুলোর আমদানি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আনা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আটক সংক্রান্ত শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের একাধিক প্রতিবেদন যুগান্তরের হাতে রয়েছে। এর একটিতে বলা হয়েছে, দেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানির শর্ত পূরণ না করে কুরিয়ার সার্ভিস বা বিভিন্ন অবৈধপথে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ৫ মার্চ ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ৯৮ কেজি ওষুধ আটক করা হয়। এর মধ্যে ছিল ক্যানেসটেন ক্রিম, জেনিক্যাল অরলিস্টে, ইমিগ্রান, ফুসটাম জেলসহ বিভিন্ন ওষুধ। ভুয়া এলসির মাধ্যমে যার মূল্য দেখানো হয়েছিল মাত্র ৯৮ ডলার। প্রকৃতপক্ষে এসব ওষুধের দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। ২৬ ফেব্র“য়ারি ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ‘হেলথ প্রোডাক্ট’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা দুই কার্টন ওষুধ জব্দ করা হয়। ওষুধের মধ্যে ছিল স্যাবলি ৫০০ এমজি, লেসকল ফ্লুভাসটিন, ডিমকর্ন এমআর, মাইকেলিক ইনজেকশন, গ্লোনাল এফ ৭৫ আইইউ জাতীয় ওষুধ, যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ টাকা। এছাড়া ১৯ মার্চ ‘ফ্রি মেডিসিন স্যাম্পল’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ওষুধের চালান আটক করা হয়। যার মধ্যে ছিল ৬৫ লাখ টাকার পলিক্যাপ ও অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ। আর ৪ মে জব্দ করা হয় ৪৭২ কেজি ব্যথানাশক ওষুধ, যা আমদানি করা হয়েছিলে গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা দিয়ে। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এই চালানটির এলসি, বিল বাউচার সবই ছিল ভুয়া। জালজালিয়াতির মাধ্যমে এসব ওষুধের ৩৭ কার্টন খালাস ও বাকি অংশ খালাসের চেষ্টা চলছিল। পরে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খালাস হওয়া ৩৭ কার্টনসহ সব ওষুধ জব্দ করেন। শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক জানান, এসব ওষুধ খালাসের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার মতে, এসব ওষুধের সঙ্গে ফার্মেসি মালিক, ওষুধ ব্যবসায়ী, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাসহ অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আইয়ুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ওষুধের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ জড়িত। ওষুধ আমদানি করতে হলে ওষুধ প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হবে। এর বাইরে ওষুধ আমদানি করার সুযোগ নেই। সুই-সিরিঞ্জসহ ইনফিউশন সেট আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভাইস। এর জন্য অবশ্যই পূর্বানুমতি নিতে হবে। ব্যবহৃত সুই-সিরিঞ্জ রিপ্যাক করে আমদানির কোনো সুযোগ নেই। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে বাজারে যেসব ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ পাওয়া যায় তা একবার ব্যবহার করলেই অকার্যকর হয়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া বাংলাদেশ ডিসপোজেবল নিডেল ও সিরিঞ্জ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এগুলো আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়লে ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ মান রক্ষা করে শর্তসাপেক্ষে আমদানির অনুমোদন দেয়া যায়। কিন্তু চোরাইপথে কেউ মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এগুলো আমদানির অভিযোগ পেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, চোরাইপথে আমদানি করা ওষুধ ব্যবহারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। ডিসপোজেবল নিডেল, সিরিঞ্জ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হবে। স্যালাইনসেট কেটে ফেলতে হবে। নিডেল ভেঙে ফেলতে হবে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম চোরাচালান এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, একই সুই-সিরিঞ্জ একাধিকার ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিস, এইডস, ক্যান্সারসহ যে কোনো রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। এসব ব্যবহারকারীর শরীরে ইনফেকশন হবে। তার মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি। তাছাড়া অবৈধভাবে আমদানি করা কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহারেও বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই। কারণ এগুলোর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র