jugantor
সব সরকারের আমলেই পরিবর্তন
লুই কানের নকশা ক্ষতবিক্ষত
বিলম্বে হলেও আট কবর সরানোর উদ্যোগ * দক্ষিণ প্লাজা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবি

  শেখ মামুনূর রশীদ  

১৯ অক্টোবর ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের অমর সৃষ্টি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। কিন্তু এর নকশা দফায় দফায় ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। পঁচাত্তরের পর প্রায় প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই নানান অজুহাতে নকশাবহির্ভূতভাবে সংসদ ভবন এবং এর আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। জরুরি প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে নকশা কাটাছেঁড়া করে আঘাত হানা হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যের সংসদ ভবন এলাকায়। এতে করে সৌন্দর্য ও স্থাপত্য কলাকৌশলের দিক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন সংসদ ভবনের চেয়ে অন্যতম এই স্থাপত্য শিল্প ক্রমেই তার আপন ভুবনের সীমানা হারাতে বসেছে।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রায় ৮শ’ একর জমি নিয়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। দেশের প্রখ্যাত স্থপতি অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের পরামর্শে তার শিক্ষাগুরু এস্তোনীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন খ্যাতনামা স্থপতি লুইস ইসাডোর কানকে (লুই আই কান) এ জন্য দায়িত্বও দেয়া হয়। সে অনুযায়ী নকশাও প্রণয়ন করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।

কিন্তু এ সংক্রান্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের লে-আউট সেভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। বরং একের পর এক বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। যার সঙ্গে লুই আই কানের মূল নকশার মধ্যে কোনো মিল নেই। আর এর ফলে দীর্ঘ ২০ বছরের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা জাতীয় সংসদ ভবন ক্রমেই তার চরিত্র হারাতে বসেছে। বদলে যাচ্ছে এর আশপাশের চিরচেনা রূপ। সংসদ সচিবালয়, গণপূর্ত অধিদফতর, স্থাপত্য অধিদফতরসহ সরকারের নানা মহলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করায় লুই আই কানের মূল নকশা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বারবার।

লুই আই কানের সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত বরেণ্য স্থপতি অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ১৯৬৪ সাল থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরে এজন্য একটি সাইট অফিস করেন লুই আই কান। বুয়েটের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সাল থেকে তিনিসহ আরও কয়েকজন তরুণ এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

সামসুল ওয়ারেস জানান, শেরেবাংলা নগরকে ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন লুই আই কান। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি নিজেই কয়েক দফা খসড়া নকশা করার পর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৯৭৩ সালে এটি চূড়ান্ত করেন। এরপর এর যাবতীয় নকশা হস্তান্তর করেন সরকারের কাছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সংকীর্ণ স্বার্থে মূল্যবান সেই নকশা বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এমনকি কয়েক দফায় এই নকশা পরিবর্তনও করা হয়েছে।

প্রায় একই রকম মন্তব্য করেন বিশিষ্ট স্থপতি নুরুর রহমান খান। যিনি লুই আই কানের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, লুই আই কান বঙ্গীয় বদ্বীপ, এর নদী, বিস্তৃত সবুজ, প্রসারিত সমভূমি, উঁচু ভিটায় তৈরি ঘরবাড়ি এবং এর ভূমি-জলে মেশানো ভূ-প্রকৃতি থেকে সংসদ ভবনের নকশা তৈরির প্রেরণা খুঁজছিলেন। ঢাকায় আসার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ান এবং এই মৌসুমী জলবায়ু ঘেরা বাংলাদেশের মানুষের যাপিতজীবন বুঝতে নদীতীরের দৃশ্যাবলীর রেখাচিত্র (স্কেচ) তৈরি করেন। যে কারণে লেকের ওপর সংসদ ভবন তৈরি করা হয়েছে।

তিনি জানান, কয়েক বছর আগে ৪০ জন আমেরিকান স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও বিনিয়োগকারীর একটি দল বাংলাদেশে আসেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ ভবন দেখা। যাদের একজন ছিলেন জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরিতে নিয়োজিত নকশাবিদ দলের সদস্য। তিনি আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় বসে লুই আই কানের কাজের সহযোগী হয়েছিলেন। সংসদ ভবনে প্রবেশ করে তিনি অভিভূত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই প্রথম তিনি এমন একটি ভবনের জাদুকরি সৌন্দর্য প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। দুনিয়ার অপর প্রান্তে বসে যিনি নিজেও এর নকশা তৈরিতে জড়িত ছিলেন। তাই তার কাছে এটা তীর্থ ভ্রমণের চেয়ে কম কিছু ছিল না।

জানা গেছে, মূল নকশায় জাতীয় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের কোথাও কবরস্থানের জায়গা রাখা হয়নি। অথচ পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এ জায়গায় আটজনকে কবর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানের ৭৪ একর এলাকার মধ্যে ৫ বিঘা জমিতে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর বা সমাধি কমপ্লেক্স।

এছাড়া সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে আরও সাতটি কবর। ‘জাতীয় কবরস্থান’ নামে পরিচিত হলেও এসব কবরের অবস্থান আসাদগেট বাস স্ট্যান্ডসংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউর পাশে। এখানে আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খানের কবর। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, খান এ সবুর, সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও তমিজ উদ্দিনের কবর রয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব কবর সরিয়ে নেয়ার জন্য গত বছর ১৪ জুলাই একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। এতে জিয়াউর রহমানের কবর মিরপুরের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে স্থানান্তরের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। বাকিদের কবর সুবিধা অনুযায়ী অন্য কোনো কবরস্থানে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। যদিও এখন পর্যন্ত এটি প্রস্তাব আকারেই আটকে আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রলপাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিষয়টি শেষপর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্ট (আইএবি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যৌথভাবে সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্তের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করে। রায় আইএবি এবং বাপার পক্ষে গেলেও নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই নির্মাণ করা হয় স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন।

এখানেই শেষ নয়, তাদের বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চারপাশে আট ফুট উঁচু দেয়ালও নির্মাণ করা হয়। গড়ে তোলা হয় পুলিশ ব্যারাক। তৈরি করা হয় সংসদ সদস্যদের হোস্টেলসহ আরও নিয়মবহির্ভূত নানা ধরনের স্থাপনা। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে লোহার বেষ্টনী উঁচু করা প্রকল্প গ্রহণ করে গণপূর্ত বিভাগ। বর্তমানে ভবনের চারপাশে তিন ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী রয়েছে। পাশাপাশি লুই আই কানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বন্ধ করে দেয়া হয় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা।

মূল ভবনের ভেতরেও হরহামেশাই নকশা পরিবর্তন করে চলছে নানা নির্মাণ কাজ। ইতিমধ্যে সংসদ ভবনের ভেতরে কাচ ও কাঠের বিভাজন দিয়ে অসংখ্য কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এসব নির্মাণ কাজ এখনও অব্যাহত আছে। এখন আবার সংসদ ভবন এলাকার পাশ দিয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এতেও লুই আই কানের মূল নকশার সৌন্দর্যে ব্যাঘাত ঘটবে বলে দাবি করেছেন স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফের নকশায় আঘাত করা হয়। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে সংসদ ভবনের চারপাশে নতুন করে দেয়াল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে শীর্ষস্থানীয় স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত মহাজোট সরকার দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

সম্প্রতি নিরাপত্তার নামে সংসদ সচিবালয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণের জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। এ দেয়ালের উপরে থাকবে মোটা লোহার শলাকা। অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদলে তৈরি করা হবে এ প্রাচীর। প্রাচীরের উচ্চতা হবে আট ফুট। যার মধ্যে নিচের দুই ফুট ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি পাকা দেয়াল। আর বাকি ছয় ফুট লোহার প্রাচীর। লোহার প্রাচীর ঢেকে দেয়া হবে বিভিন্ন লতা জাতীয় গুল্ম দিয়ে।

জানা গেছে, সংসদ ভবনের চারপাশে আড়াই মাইলজুড়ে নির্মাণ করা হবে এ বেষ্টনী। ২০১৩ সালে জিকে বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজ করে। ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে এর কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি স্থাপত্যবিদ, পরিবেশবিদ ও সৌন্দর্য পিপাসুদের চরম বিরোধিতার মুখে একপর্যায়ে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। দেয়াল নির্মাণের জন্য তৈরি করা হয় নতুন নকশা।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, লুই আই কান যে দর্শন থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা করেছিলেন তা এক কথায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। লুই আই কান চেয়েছিলেন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মানুষ ঘুরবে, বেড়াবে, সংসদ ভবনের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দক্ষিণ প্লাজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মূল নকশায় নেই এমন অনেক কিছুই হয়েছে সংসদ ভবনকে ঘিরে। এতে যেমন সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তেমনি জাতীয় সংসদ ভবনও তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

জানা গেছে, ওই সময়কার বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা স্থপতি লুই আই কান ১৯৬২ সালে সংসদ ভবনসহ পুরো শেরেবাংলা এলাকার একটি নকশা পাকিস্তান সরকারের কাছে জমা দেন। ১৯৬৪ সালে এ নকশা অনুসারে ভবনটি তৈরির জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অনুমোদন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুদিনের জন্য এর নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহ ও ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে লুই আই কানের মূল পরিকল্পনা অনুসারে কাজটি আবার শুরু হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এ কাজে তার সঙ্গে ছিলেন। এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ লুই আই কান মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৯ সালে এটি ‘আর্কিটেকচার ফর দ্যা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং’ হিসেবে স্থাপত্যবিদ্যার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘দ্যা আগা খান’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।

লুই আই কানের মৃত্যুর পর স্থপতি মাজহারুল ইসলাম অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে লুই কানের সহযোগী স্থপতিরা তাকে সহায়তা করেন। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছর ২৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করতে খরচ হয়েছিল সে সময়কার ৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। ১৯৮২ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি এ ভবনে প্রথম সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে মূল নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। মূলত তখন থেকেই লুই কানের মূল নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার কাজটি শুরু হয়। লুই কানের মূল নকশায় কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝখানে রাখা হয় সংসদ অধিবেশনের মূল ভবনটি। আর এ ভবনটিকে কেন্দ্র করে রাখা হয়েছিল সুপ্রিমকোর্ট, মসজিদ এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন। এছাড়া চন্দ্রিমা লেকের পর বাকি জায়গায় সচিবালয়, জাতীয় জাদুঘর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়। পরিবর্তিত পরিকল্পনায় সুপ্রিমকোর্ট, মসজিদ এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন, জাতীয় জাদুঘর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি প্রভৃতি নির্মাণ পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়। কিন্তু সচিবালয় নির্মাণের জন্য চন্দ্রিমা উদ্যানের পেছনের জায়গটি অক্ষত রাখার কথা বলা হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সেখানে চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এর নাম পরিবর্তন করে, যা এখন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নামে পরিচিত।


 

সাবমিট
সব সরকারের আমলেই পরিবর্তন

লুই কানের নকশা ক্ষতবিক্ষত

বিলম্বে হলেও আট কবর সরানোর উদ্যোগ * দক্ষিণ প্লাজা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবি
 শেখ মামুনূর রশীদ 
১৯ অক্টোবর ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের অমর সৃষ্টি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। কিন্তু এর নকশা দফায় দফায় ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। পঁচাত্তরের পর প্রায় প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই নানান অজুহাতে নকশাবহির্ভূতভাবে সংসদ ভবন এবং এর আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। জরুরি প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে নকশা কাটাছেঁড়া করে আঘাত হানা হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যের সংসদ ভবন এলাকায়। এতে করে সৌন্দর্য ও স্থাপত্য কলাকৌশলের দিক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন সংসদ ভবনের চেয়ে অন্যতম এই স্থাপত্য শিল্প ক্রমেই তার আপন ভুবনের সীমানা হারাতে বসেছে।

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে প্রায় ৮শ’ একর জমি নিয়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। দেশের প্রখ্যাত স্থপতি অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের পরামর্শে তার শিক্ষাগুরু এস্তোনীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন খ্যাতনামা স্থপতি লুইস ইসাডোর কানকে (লুই আই কান) এ জন্য দায়িত্বও দেয়া হয়। সে অনুযায়ী নকশাও প্রণয়ন করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।

কিন্তু এ সংক্রান্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের লে-আউট সেভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। বরং একের পর এক বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। যার সঙ্গে লুই আই কানের মূল নকশার মধ্যে কোনো মিল নেই। আর এর ফলে দীর্ঘ ২০ বছরের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা জাতীয় সংসদ ভবন ক্রমেই তার চরিত্র হারাতে বসেছে। বদলে যাচ্ছে এর আশপাশের চিরচেনা রূপ। সংসদ সচিবালয়, গণপূর্ত অধিদফতর, স্থাপত্য অধিদফতরসহ সরকারের নানা মহলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করায় লুই আই কানের মূল নকশা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বারবার।

লুই আই কানের সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত বরেণ্য স্থপতি অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ১৯৬৪ সাল থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরে এজন্য একটি সাইট অফিস করেন লুই আই কান। বুয়েটের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সাল থেকে তিনিসহ আরও কয়েকজন তরুণ এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

সামসুল ওয়ারেস জানান, শেরেবাংলা নগরকে ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন লুই আই কান। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি নিজেই কয়েক দফা খসড়া নকশা করার পর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৯৭৩ সালে এটি চূড়ান্ত করেন। এরপর এর যাবতীয় নকশা হস্তান্তর করেন সরকারের কাছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সংকীর্ণ স্বার্থে মূল্যবান সেই নকশা বারবার ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এমনকি কয়েক দফায় এই নকশা পরিবর্তনও করা হয়েছে।

প্রায় একই রকম মন্তব্য করেন বিশিষ্ট স্থপতি নুরুর রহমান খান। যিনি লুই আই কানের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, লুই আই কান বঙ্গীয় বদ্বীপ, এর নদী, বিস্তৃত সবুজ, প্রসারিত সমভূমি, উঁচু ভিটায় তৈরি ঘরবাড়ি এবং এর ভূমি-জলে মেশানো ভূ-প্রকৃতি থেকে সংসদ ভবনের নকশা তৈরির প্রেরণা খুঁজছিলেন। ঢাকায় আসার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ান এবং এই মৌসুমী জলবায়ু ঘেরা বাংলাদেশের মানুষের যাপিতজীবন বুঝতে নদীতীরের দৃশ্যাবলীর রেখাচিত্র (স্কেচ) তৈরি করেন। যে কারণে লেকের ওপর সংসদ ভবন তৈরি করা হয়েছে।

তিনি জানান, কয়েক বছর আগে ৪০ জন আমেরিকান স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও বিনিয়োগকারীর একটি দল বাংলাদেশে আসেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ ভবন দেখা। যাদের একজন ছিলেন জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরিতে নিয়োজিত নকশাবিদ দলের সদস্য। তিনি আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় বসে লুই আই কানের কাজের সহযোগী হয়েছিলেন। সংসদ ভবনে প্রবেশ করে তিনি অভিভূত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই প্রথম তিনি এমন একটি ভবনের জাদুকরি সৌন্দর্য প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। দুনিয়ার অপর প্রান্তে বসে যিনি নিজেও এর নকশা তৈরিতে জড়িত ছিলেন। তাই তার কাছে এটা তীর্থ ভ্রমণের চেয়ে কম কিছু ছিল না।

জানা গেছে, মূল নকশায় জাতীয় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের কোথাও কবরস্থানের জায়গা রাখা হয়নি। অথচ পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এ জায়গায় আটজনকে কবর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানের ৭৪ একর এলাকার মধ্যে ৫ বিঘা জমিতে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর বা সমাধি কমপ্লেক্স।

এছাড়া সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে রয়েছে আরও সাতটি কবর। ‘জাতীয় কবরস্থান’ নামে পরিচিত হলেও এসব কবরের অবস্থান আসাদগেট বাস স্ট্যান্ডসংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউর পাশে। এখানে আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খানের কবর। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, খান এ সবুর, সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও তমিজ উদ্দিনের কবর রয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব কবর সরিয়ে নেয়ার জন্য গত বছর ১৪ জুলাই একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। এতে জিয়াউর রহমানের কবর মিরপুরের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে স্থানান্তরের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। বাকিদের কবর সুবিধা অনুযায়ী অন্য কোনো কবরস্থানে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। যদিও এখন পর্যন্ত এটি প্রস্তাব আকারেই আটকে আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

লুই আই কানের নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। লুই আই কানের নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় একটি পেট্রলপাম্প স্থাপনের জন্য তিনি তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে জায়গা বরাদ্দ দেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিষয়টি শেষপর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্ট (আইএবি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যৌথভাবে সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্তের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করে। রায় আইএবি এবং বাপার পক্ষে গেলেও নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই নির্মাণ করা হয় স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন।

এখানেই শেষ নয়, তাদের বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চারপাশে আট ফুট উঁচু দেয়ালও নির্মাণ করা হয়। গড়ে তোলা হয় পুলিশ ব্যারাক। তৈরি করা হয় সংসদ সদস্যদের হোস্টেলসহ আরও নিয়মবহির্ভূত নানা ধরনের স্থাপনা। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে লোহার বেষ্টনী উঁচু করা প্রকল্প গ্রহণ করে গণপূর্ত বিভাগ। বর্তমানে ভবনের চারপাশে তিন ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী রয়েছে। পাশাপাশি লুই আই কানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বন্ধ করে দেয়া হয় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা।

মূল ভবনের ভেতরেও হরহামেশাই নকশা পরিবর্তন করে চলছে নানা নির্মাণ কাজ। ইতিমধ্যে সংসদ ভবনের ভেতরে কাচ ও কাঠের বিভাজন দিয়ে অসংখ্য কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এসব নির্মাণ কাজ এখনও অব্যাহত আছে। এখন আবার সংসদ ভবন এলাকার পাশ দিয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এতেও লুই আই কানের মূল নকশার সৌন্দর্যে ব্যাঘাত ঘটবে বলে দাবি করেছেন স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফের নকশায় আঘাত করা হয়। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে সংসদ ভবনের চারপাশে নতুন করে দেয়াল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে শীর্ষস্থানীয় স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত মহাজোট সরকার দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

সম্প্রতি নিরাপত্তার নামে সংসদ সচিবালয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণের জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। এ দেয়ালের উপরে থাকবে মোটা লোহার শলাকা। অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদলে তৈরি করা হবে এ প্রাচীর। প্রাচীরের উচ্চতা হবে আট ফুট। যার মধ্যে নিচের দুই ফুট ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি পাকা দেয়াল। আর বাকি ছয় ফুট লোহার প্রাচীর। লোহার প্রাচীর ঢেকে দেয়া হবে বিভিন্ন লতা জাতীয় গুল্ম দিয়ে।

জানা গেছে, সংসদ ভবনের চারপাশে আড়াই মাইলজুড়ে নির্মাণ করা হবে এ বেষ্টনী। ২০১৩ সালে জিকে বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজ করে। ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে এর কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি স্থাপত্যবিদ, পরিবেশবিদ ও সৌন্দর্য পিপাসুদের চরম বিরোধিতার মুখে একপর্যায়ে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। দেয়াল নির্মাণের জন্য তৈরি করা হয় নতুন নকশা।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, লুই আই কান যে দর্শন থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা করেছিলেন তা এক কথায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। লুই আই কান চেয়েছিলেন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মানুষ ঘুরবে, বেড়াবে, সংসদ ভবনের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দক্ষিণ প্লাজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মূল নকশায় নেই এমন অনেক কিছুই হয়েছে সংসদ ভবনকে ঘিরে। এতে যেমন সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তেমনি জাতীয় সংসদ ভবনও তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

জানা গেছে, ওই সময়কার বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা স্থপতি লুই আই কান ১৯৬২ সালে সংসদ ভবনসহ পুরো শেরেবাংলা এলাকার একটি নকশা পাকিস্তান সরকারের কাছে জমা দেন। ১৯৬৪ সালে এ নকশা অনুসারে ভবনটি তৈরির জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার অনুমোদন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুদিনের জন্য এর নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহ ও ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে লুই আই কানের মূল পরিকল্পনা অনুসারে কাজটি আবার শুরু হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এ কাজে তার সঙ্গে ছিলেন। এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ লুই আই কান মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৯ সালে এটি ‘আর্কিটেকচার ফর দ্যা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং’ হিসেবে স্থাপত্যবিদ্যার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘দ্যা আগা খান’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।

লুই আই কানের মৃত্যুর পর স্থপতি মাজহারুল ইসলাম অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে লুই কানের সহযোগী স্থপতিরা তাকে সহায়তা করেন। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছর ২৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন করতে খরচ হয়েছিল সে সময়কার ৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। ১৯৮২ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি এ ভবনে প্রথম সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে মূল নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। মূলত তখন থেকেই লুই কানের মূল নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার কাজটি শুরু হয়। লুই কানের মূল নকশায় কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝখানে রাখা হয় সংসদ অধিবেশনের মূল ভবনটি। আর এ ভবনটিকে কেন্দ্র করে রাখা হয়েছিল সুপ্রিমকোর্ট, মসজিদ এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন। এছাড়া চন্দ্রিমা লেকের পর বাকি জায়গায় সচিবালয়, জাতীয় জাদুঘর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়। পরিবর্তিত পরিকল্পনায় সুপ্রিমকোর্ট, মসজিদ এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন, জাতীয় জাদুঘর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি প্রভৃতি নির্মাণ পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়। কিন্তু সচিবালয় নির্মাণের জন্য চন্দ্রিমা উদ্যানের পেছনের জায়গটি অক্ষত রাখার কথা বলা হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সেখানে চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এর নাম পরিবর্তন করে, যা এখন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নামে পরিচিত।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র