jugantor
ঢামেক বার্ন ইউনিট
পোড়া চামড়ার গন্ধ ক্ষতবিক্ষত মানুষের গোঙানির শব্দ

  শিপন হাবীব  

০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

ঢামেক বার্ন ইউনিটের বাতাসে পোড়া মাংস আর চামড়ার গন্ধ। ক্ষতবিক্ষত মানুষের গোঙানির শব্দ। ভয়ে আঁতকে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, ঘুমাতে পারে না তারা। জেগে থাকলেও চোখে-মুখে আতংকের ছাপ স্পষ্ট তাদের। পেট্রলবোমা আতংক ছড়িয়ে পড়ছে দগ্ধদের মাংসে, শিরা-উপশিরায়। বিশেষ করে শিশুদের ছোট্ট হৃদয়ে এই আঘাত যে কী মারাত্মক তা কল্পনাতীত।

প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে ভর্তি পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। গত ১ মাসে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢামেক বার্ন ইউনিটে হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৪ জন। যাদের মধ্যে ৪১ জনেরই ১৫ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত শরীর পুড়ে গেছে। চরম শংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি রয়েছে ১২ জন। ডাক্তারদের ভাষ্য, ভর্তি দগ্ধ রোগীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকেই আশংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না। ১৫-২০ শতাংশ পোড়া রোগীও মারা যায়।

এদিকে বুধবার রাতে গাজীপুর এলাকায় বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে আসা ৬ জনের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা খুবই শংকটাপন্ন। এমন অবস্থায় বার্ন ইউনিটে একাধিক আইসিইউ ইউনিট না থাকা, কিংবা যে আইসিইউ ইউনিটটি রয়েছে সেখানে সিট না থাকায় চিকিৎসা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তাররা। আইসিইউতে সিট না থাকায় এইচডিইউ ইউনিট ও সাধারণ ওয়ার্ডে শংকটাপন্ন দগ্ধ রোগীদের রাখতে হচ্ছে। যেখানে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে দগ্ধরা।

দগ্ধ ছয় বছরের শিশু মরিয়মের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। বুধবার মধ্যরাতে ছোট্ট এ শিশুকে ৪৫ শতাংশ পোড়া শরীরসহ ভর্তি করা হয়েছিল বার্ন ইউনিটে। বৃহস্পতিবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেই থেকে তার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে একই বাসে শিশু মরিয়মের সঙ্গে পুড়ে যাওয়া ১১ বছরের শিশু রাকিব মিয়া (৩৪ শতাংশ পোড়া শরীর) ও ২৪ বছর বয়সী রং মিস্ত্রি নুরুন্নবীকে (৬৪ শতাংশ পোড়া শরীর) বৃহস্পতিবারই আইসিইউতে ভর্তি করার কথা ছিল। কিন্তু ওখানে সিট খালি না হওয়ায় শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এইচডিইউ ইউনিটে রাখা হচ্ছিল।

শুক্রবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে আইসিইউর বারান্দার দেয়ালে মাথা ঠুকছিলেন শিশু মরিয়মের মা নার্গিস আক্তার। কণ্ঠ ভেঙে যাওয়ায় কান্নার শব্দ বের হচ্ছিল না। তবে বাঁধ মানছিল না চোখের জল। খুব আস্তে করে বললেন, ভাই আমার মেয়েরে বাঁচান, মেয়ের কিছু হলে আমি বাঁচব না। আমি টেহা-পয়সা চাই না, অনেকেই হাতে টেহা দিতাছে। আমি কিছুই চাই না, শুধু আমার মনারে (মরিয়ম) চাই। মা নার্গিসের সঙ্গে আইসিইউর ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, শিশু মরিয়ম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বুক-ফাটা কান্নায় মেয়ের পাশে আছড়ে পড়ছিলেন মা নার্গিস।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মরিয়মের ক্ষতগুলো বৃহস্পতিবার যে অবস্থায় ছিল শুক্রবার তার চেয়ে ভয়াবহ হয়। ক্ষতগুলো অবশ্য ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা। কিন্তু ব্যান্ডেজ বেয়ে রক্ত বেডে পড়ছিল। নাকে-মুখে অক্সিজেন লাগানো। পুরো শরীর হলদে হয়ে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে ‘মা, মা...’ ডেকে উঠছিল। আবার অচেতন হয়ে পড়ছিল। তখনই দৌড়-ঝাঁপ করছেন মা নার্গিস আক্তার। নার্সদের টেনে এনে মেয়ে মরিয়মের সামনে দাঁড় করাচ্ছিল। কাতর কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আপনেদের পায়ে পড়ি, আপনেরা আমার মেয়ের সামনে থাকেন।’ সব মানবিক অনুভূতিকে এক লহমায় স্তব্ধ করে দেয়া সেই মায়ের আকুতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন নার্স, ডাক্তাররা। মা নার্গিস দু’হাত ওপরের দিকে তুলে বলছিল, আল্লাহ তুমি আমার জান নিয়ে নেও, আমার মেয়েরে ভালো করে দাও। পরক্ষণেই এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে বললেন, দেশের মানুষ যাতে তার মেয়ের জন্য দোয়া করেন। মেয়ে যেন দ্রুত সুস্থ হয়।

এইচডিইউ ইউনিটে ছোট ছেলে রাকিব মিয়ার (১১) পাশে বুক থাপড়াচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা মা। টানা কেঁদে যাচ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন, তার মানিককে যেন (রাকিব) যে করেই সুস্থ করে তোলা হয়। শিশু রাকিব মিয়ার শরীর ৩৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার পুরো মুখমণ্ডল, মাথা, গলা, বুক, দু’হাত ও দু’পা পুড়ে গেছে। বুধবারই তাকে আইসিইউ’তে ভর্তি করার কথা ছিল। সিট খালি না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিটে দায়িত্বরত ডা. হুমায়রা। বললেন, তার অবস্থা শংকটাপন্ন, তার শ্বাসনালি ভয়াবহ আকারে পুড়ে গেছে।

মা রাশেদা বেগম জানান, শিশু সন্তান রাকিব মিয়ার যখন বয়স ৩ বছর তখনই তার বাবা জামালউদ্দিন মারা যান। ৩ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাকিব। অন্য ছেলেরা দিনমজুরের কাজ করে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। তিনি ভিক্ষা করেন। আর ১১ বছরের রাকিব গাজীপুর কাঁচামাল বাজারে কাঁচামাল টানতো। রাতে ওখানেই কোনো ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়তো। বুধবার বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে রাকিব আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বললেন, রাকিব তাকে প্রায়ই ২-৩শ’ টাকা দিতেন। তিনি না বলতেন, তবু মায়ের জন্য আলাদা করে টাকা জমাতেন।

বৃদ্ধা মা ক্ষোভ উগড়ে বললেন, তার ছেলের কী দোষ ছিল? কেন তাকে পুড়িয়ে দেয়া হল? তখন রাকিব চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন দেখছিল। মুখের সামনে কান পাততেই বলল, আপনি কে, আমাকে বাঁচান...। তার এমন আকুতিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এ প্রতিবেদক। আর বৃদ্ধা মা বলল, কেন জানোয়ারদের (পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী) পোড়া হচ্ছে না। আমার ছেলের এখন কি হবে...।

শিশু রাকিবের বেডের পাশেই কাতরাচ্ছিলেন রং মিস্ত্রি নুরুন্নবী। তার শরীরের ৬৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকেও আইসিইউতে বৃহস্পতিবার ভর্তি করার কথা ছিল। তার পুরো মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে। চোখগুলো পুড়ে ফেঁপে উঠেছে। পাশে থাকা ভাগ্নে রমিজুল ইসলাম বললেন, ৬ মাস আগে মামা (নুরুন্নবী) ভাগ্নে মিলে ঢাকায় আসেন রং মিস্ত্রির কাজে। এতদিন কাজও করছিলেন।

শুক্রবার মামার বাড়ি কুড়িগ্রাম যাওয়ার কথা ছিল। বুধবার গাজীপুর বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয় মামা। তার বাবা জয়মুদ্দিন ও মা তন্নী বেগম তার ছোট বেলায় মারা গেছেন। স্ত্রী সাবিহা ও ৬ বছরের সন্তান নিলুফা রয়েছে তার। ডাক্তার বলেছে, মামার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। তারা খুবই দরিদ্র। চেষ্টা করেও গত দু’দিনে কুড়িগ্রাম থেকে স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনরা আসতে পারছে না। মামার কিছু হয়ে গেলে কী জবাব দেবেন। এমন আতংকে কেঁদে উঠেন রমিজুল।

বার্ন ইউনিট সার্জারি ও বার্ন বিভাগ প্রধান প্রফেসর ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার যুগান্তরকে জানান, ঢাকার পার্শ্ববর্তী হাসপাতালগুলোতে বার্ন ইউনিট থাকলেও সেসব ইউনিটগুলোতে আইসিইউ ইউনিট নেই। আইসিইউতে ভর্তি রোগীরাও চরম শংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। শিশু রাকিবসহ নুরুন্নবী, সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া এবং আরও ২-৩ জন রোগীকে পর্যায়ক্রমে আইসিইউতে ভর্তি করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ডাক্তার, নার্সরা যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করছেন। চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হচ্ছে না। তবে পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীদের বেশিরভাগেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। ফলে তাদের নিয়ে ভয় থাকছেই। ভর্তিকৃত ৪-৭ জন ছাড়া বাকি কাউকেই আশংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না।


 

সাবমিট
ঢামেক বার্ন ইউনিট

পোড়া চামড়ার গন্ধ ক্ষতবিক্ষত মানুষের গোঙানির শব্দ

 শিপন হাবীব 
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

ঢামেক বার্ন ইউনিটের বাতাসে পোড়া মাংস আর চামড়ার গন্ধ। ক্ষতবিক্ষত মানুষের গোঙানির শব্দ। ভয়ে আঁতকে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, ঘুমাতে পারে না তারা। জেগে থাকলেও চোখে-মুখে আতংকের ছাপ স্পষ্ট তাদের। পেট্রলবোমা আতংক ছড়িয়ে পড়ছে দগ্ধদের মাংসে, শিরা-উপশিরায়। বিশেষ করে শিশুদের ছোট্ট হৃদয়ে এই আঘাত যে কী মারাত্মক তা কল্পনাতীত।

প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে ভর্তি পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। গত ১ মাসে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢামেক বার্ন ইউনিটে হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৪ জন। যাদের মধ্যে ৪১ জনেরই ১৫ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত শরীর পুড়ে গেছে। চরম শংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি রয়েছে ১২ জন। ডাক্তারদের ভাষ্য, ভর্তি দগ্ধ রোগীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকেই আশংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না। ১৫-২০ শতাংশ পোড়া রোগীও মারা যায়।

এদিকে বুধবার রাতে গাজীপুর এলাকায় বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে আসা ৬ জনের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা খুবই শংকটাপন্ন। এমন অবস্থায় বার্ন ইউনিটে একাধিক আইসিইউ ইউনিট না থাকা, কিংবা যে আইসিইউ ইউনিটটি রয়েছে সেখানে সিট না থাকায় চিকিৎসা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে ডাক্তাররা। আইসিইউতে সিট না থাকায় এইচডিইউ ইউনিট ও সাধারণ ওয়ার্ডে শংকটাপন্ন দগ্ধ রোগীদের রাখতে হচ্ছে। যেখানে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে দগ্ধরা।

দগ্ধ ছয় বছরের শিশু মরিয়মের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। বুধবার মধ্যরাতে ছোট্ট এ শিশুকে ৪৫ শতাংশ পোড়া শরীরসহ ভর্তি করা হয়েছিল বার্ন ইউনিটে। বৃহস্পতিবার তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেই থেকে তার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে একই বাসে শিশু মরিয়মের সঙ্গে পুড়ে যাওয়া ১১ বছরের শিশু রাকিব মিয়া (৩৪ শতাংশ পোড়া শরীর) ও ২৪ বছর বয়সী রং মিস্ত্রি নুরুন্নবীকে (৬৪ শতাংশ পোড়া শরীর) বৃহস্পতিবারই আইসিইউতে ভর্তি করার কথা ছিল। কিন্তু ওখানে সিট খালি না হওয়ায় শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এইচডিইউ ইউনিটে রাখা হচ্ছিল।

শুক্রবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে আইসিইউর বারান্দার দেয়ালে মাথা ঠুকছিলেন শিশু মরিয়মের মা নার্গিস আক্তার। কণ্ঠ ভেঙে যাওয়ায় কান্নার শব্দ বের হচ্ছিল না। তবে বাঁধ মানছিল না চোখের জল। খুব আস্তে করে বললেন, ভাই আমার মেয়েরে বাঁচান, মেয়ের কিছু হলে আমি বাঁচব না। আমি টেহা-পয়সা চাই না, অনেকেই হাতে টেহা দিতাছে। আমি কিছুই চাই না, শুধু আমার মনারে (মরিয়ম) চাই। মা নার্গিসের সঙ্গে আইসিইউর ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, শিশু মরিয়ম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বুক-ফাটা কান্নায় মেয়ের পাশে আছড়ে পড়ছিলেন মা নার্গিস।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মরিয়মের ক্ষতগুলো বৃহস্পতিবার যে অবস্থায় ছিল শুক্রবার তার চেয়ে ভয়াবহ হয়। ক্ষতগুলো অবশ্য ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা। কিন্তু ব্যান্ডেজ বেয়ে রক্ত বেডে পড়ছিল। নাকে-মুখে অক্সিজেন লাগানো। পুরো শরীর হলদে হয়ে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে ‘মা, মা...’ ডেকে উঠছিল। আবার অচেতন হয়ে পড়ছিল। তখনই দৌড়-ঝাঁপ করছেন মা নার্গিস আক্তার। নার্সদের টেনে এনে মেয়ে মরিয়মের সামনে দাঁড় করাচ্ছিল। কাতর কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আপনেদের পায়ে পড়ি, আপনেরা আমার মেয়ের সামনে থাকেন।’ সব মানবিক অনুভূতিকে এক লহমায় স্তব্ধ করে দেয়া সেই মায়ের আকুতিতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন নার্স, ডাক্তাররা। মা নার্গিস দু’হাত ওপরের দিকে তুলে বলছিল, আল্লাহ তুমি আমার জান নিয়ে নেও, আমার মেয়েরে ভালো করে দাও। পরক্ষণেই এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে বললেন, দেশের মানুষ যাতে তার মেয়ের জন্য দোয়া করেন। মেয়ে যেন দ্রুত সুস্থ হয়।

এইচডিইউ ইউনিটে ছোট ছেলে রাকিব মিয়ার (১১) পাশে বুক থাপড়াচ্ছিলেন এক বৃদ্ধা মা। টানা কেঁদে যাচ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন, তার মানিককে যেন (রাকিব) যে করেই সুস্থ করে তোলা হয়। শিশু রাকিব মিয়ার শরীর ৩৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার পুরো মুখমণ্ডল, মাথা, গলা, বুক, দু’হাত ও দু’পা পুড়ে গেছে। বুধবারই তাকে আইসিইউ’তে ভর্তি করার কথা ছিল। সিট খালি না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিটে দায়িত্বরত ডা. হুমায়রা। বললেন, তার অবস্থা শংকটাপন্ন, তার শ্বাসনালি ভয়াবহ আকারে পুড়ে গেছে।

মা রাশেদা বেগম জানান, শিশু সন্তান রাকিব মিয়ার যখন বয়স ৩ বছর তখনই তার বাবা জামালউদ্দিন মারা যান। ৩ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাকিব। অন্য ছেলেরা দিনমজুরের কাজ করে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। তিনি ভিক্ষা করেন। আর ১১ বছরের রাকিব গাজীপুর কাঁচামাল বাজারে কাঁচামাল টানতো। রাতে ওখানেই কোনো ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়তো। বুধবার বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে রাকিব আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বললেন, রাকিব তাকে প্রায়ই ২-৩শ’ টাকা দিতেন। তিনি না বলতেন, তবু মায়ের জন্য আলাদা করে টাকা জমাতেন।

বৃদ্ধা মা ক্ষোভ উগড়ে বললেন, তার ছেলের কী দোষ ছিল? কেন তাকে পুড়িয়ে দেয়া হল? তখন রাকিব চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন দেখছিল। মুখের সামনে কান পাততেই বলল, আপনি কে, আমাকে বাঁচান...। তার এমন আকুতিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এ প্রতিবেদক। আর বৃদ্ধা মা বলল, কেন জানোয়ারদের (পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী) পোড়া হচ্ছে না। আমার ছেলের এখন কি হবে...।

শিশু রাকিবের বেডের পাশেই কাতরাচ্ছিলেন রং মিস্ত্রি নুরুন্নবী। তার শরীরের ৬৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকেও আইসিইউতে বৃহস্পতিবার ভর্তি করার কথা ছিল। তার পুরো মুখমণ্ডল পুড়ে গেছে। চোখগুলো পুড়ে ফেঁপে উঠেছে। পাশে থাকা ভাগ্নে রমিজুল ইসলাম বললেন, ৬ মাস আগে মামা (নুরুন্নবী) ভাগ্নে মিলে ঢাকায় আসেন রং মিস্ত্রির কাজে। এতদিন কাজও করছিলেন।

শুক্রবার মামার বাড়ি কুড়িগ্রাম যাওয়ার কথা ছিল। বুধবার গাজীপুর বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয় মামা। তার বাবা জয়মুদ্দিন ও মা তন্নী বেগম তার ছোট বেলায় মারা গেছেন। স্ত্রী সাবিহা ও ৬ বছরের সন্তান নিলুফা রয়েছে তার। ডাক্তার বলেছে, মামার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। তারা খুবই দরিদ্র। চেষ্টা করেও গত দু’দিনে কুড়িগ্রাম থেকে স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনরা আসতে পারছে না। মামার কিছু হয়ে গেলে কী জবাব দেবেন। এমন আতংকে কেঁদে উঠেন রমিজুল।

বার্ন ইউনিট সার্জারি ও বার্ন বিভাগ প্রধান প্রফেসর ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার যুগান্তরকে জানান, ঢাকার পার্শ্ববর্তী হাসপাতালগুলোতে বার্ন ইউনিট থাকলেও সেসব ইউনিটগুলোতে আইসিইউ ইউনিট নেই। আইসিইউতে ভর্তি রোগীরাও চরম শংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। শিশু রাকিবসহ নুরুন্নবী, সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া এবং আরও ২-৩ জন রোগীকে পর্যায়ক্রমে আইসিইউতে ভর্তি করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ডাক্তার, নার্সরা যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করছেন। চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হচ্ছে না। তবে পেট্রলবোমায় দগ্ধ রোগীদের বেশিরভাগেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। ফলে তাদের নিয়ে ভয় থাকছেই। ভর্তিকৃত ৪-৭ জন ছাড়া বাকি কাউকেই আশংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না।


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র