jugantor
বিক্ষিপ্ত ভাবনা
নিরুদ্দেশ যাত্রা

  ধীরাজ কুমার নাথ  

২৬ মার্চ ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

একাত্তর শুধু বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বছর নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক মহান সন্ধিক্ষণ এবং স্বাধিকার অর্জনেরও বছর। আমাদের জীবনে এ বছরটি বারবার ফিরে আসে, আর স্মৃতিতে ভেসে আসে এমন ঘটনাপ্রবাহ, যা ভাবলে এখনও রাতে ঘুম ভেঙে যায়, কেঁপে উঠি আশংকায়। তখন ছিল যৌবন, যুদ্ধে যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। তাই বোধহয় পেরেছি সব বিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বাধীন মাতৃভূমিকে গৌরবের মহিমায় ভরে দিতে। সেদিনের কথা বারবার বলি, তবুও শেষ হয় না, আবারও বলতে ইচ্ছা করে। কারও ভালো লাগা বা না লাগার কথা তোয়াক্কা না করে বলতেই থাকব একাত্তরের কথা, যতদিন দেহে আছে প্রাণ।

বর্তমানে যেমন গণমাধ্যম ও যোগাযোগের ভুবনে মহাবিপ্লব ঘটেছে, তখনকার পরিস্থিতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সড়ক, নৌ-পরিবহন ও রেলপথে জনগণের যাতায়াত ছিল সময়সাপেক্ষ এবং সমস্যাসংকুল। সত্যি কথা বলতে কী, ২৫ মার্চ কালোরাতে ঢাকায় কী ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল, তা পটুয়াখালীতে আমরা তিন দিনেও জানতে পারিনি। বিচ্ছিন্ন কিছু খবর পেলেও তা ছিল বিভ্রান্তিতে ভরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ও মহাকাব্যিক ভাষণ জনগণের মনে যেমন স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল, উজ্জীবিত করেছিল সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে, তেমনি এক ভয়াবহ দিনের আভাস দিয়েছিল প্রতি জনে, প্রতি ঘরে। একটা ভয়াবহ দিনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দেশবাসী, তা অনুধাবন করতে পেরেছিল তারা; কিন্তু তার ব্যাপকতা ও বিধ্বংসী রূপ কেউ অনুধাবন করতে পারেনি সঠিকভাবে। কুকুর গভীর রাতে কেঁদে উঠত, কাক দিনরাত কা কা শব্দে অশুভ দিনের বার্তা জানাত। জনগণের মুখে হাসি নেই, রাস্তাঘাটে শুধু এক কথা- কী হবে এরপর? তবে ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর দেশবাসীকে জানান দিয়েছিল, আমরা অবতীর্ণ হয়েছি রক্তক্ষয়ী এক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে, অজানা ভবিষ্যৎকে বাজি রেখে।

দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রকারান্তরে আশীর্বাদ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল ওই সময়ে। পাকিস্তানি গণহত্যাকারীরা গ্রামে-গঞ্জে দ্রুতগতিতে পৌঁছাতে পারেনি, যতটা আশা করেছিল। এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ করে দিয়েছিল সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অভিযান চালাতে।

নিরীহ জনতার ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি, তার শিকার হয়েছি। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ এপ্রিল অর্থাৎ এক মাস পর আক্রমণ করে পটুয়াখালী জেলা সদর, ডিসি অফিসসহ সব বৃহৎ অবকাঠামোয়। আকাশ থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে করতে ৬টি হেলিকপ্টার নেমে আসে শহরে। দুটি জেট বিমান ওপর থেকে নিচে নামে প্রচণ্ড শব্দে অনর্গল গুলিবর্ষণ করতে করতে আবার ওপরে উঠে। অবিরাম গোলাবর্ষণ ও বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের আক্রমণে রাস্তার দু’ধারে মৃত মানুষের কাফেলা তৈরি হয় চোখের নিমিষে। মুহূর্তেই গোলপাতার শহর আগুনে জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাওয়া যায় দূরদূরান্ত থেকে। জেলখানা ভেঙে কয়েদিসহ হাজারও শহরবাসী, নারী-পুরুষ দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জেট বিমান থেকে চলে নদীতে ভাসমান মানুষের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ। নদীর জল লাল হয়ে যায় মুহূর্তে। নিরীহ মানুষকে এমন নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ইতিহাস বিশ্বে বিরল।

এমনই এক সন্ধিক্ষণে মৃত্যুকে বাজি রেখে বেরিয়ে পড়ি ডাকবাংলো ছেড়ে। আশ্রয় নেই নদীর ওপারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে। তারপর শুরু হয় অজানা ভবিষ্যৎকে ভর করে নিরুদ্দেশ যাত্রা। প্রায় ২২ দিন পর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম জগন্নাথ দীঘির পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ি ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানকার রাজনগর থানার ওসি সাময়িকভাবে ভারতে অবস্থানের একটি সার্টিফিকেট দেয় এবং আমাদের কাছে নির্যাতনের কথা শুনে আঁতকে ওঠে। আমরা লক্ষ্য করেছি অগণিত শরণার্থীর কাফেলা মিছিল ধরে ভারতে প্রবেশ করছে, তারা সবাই ক্লান্ত, সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বিলোনিয়া থেকে উদয়পুর, তারপর আগরতলা- দীর্ঘ শত মাইল, তার দু’পাশে শরণার্থী শিবির আর শিবির। কয়েকদিন আগেও যাদের বাড়িতে ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর সম্পদের ছড়াছড়ি, তাদের এখন আশ্রয়স্থল রাস্তার পাশে বস্তি। কী খাবে, কোথায় যাবে, কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

সৌভাগ্যক্রমে এমন অনেক শরণার্থী শিবির, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মুচলেকা দানের পর আমার নিয়োগ হয় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। লবণ হ্রদে অবস্থিত লাখো মানুষের শরণার্থী শিবির (বর্তমানে সল্টলেক) এবং উত্তরবঙ্গের অনেক ত্রাণ শিবির পরিদর্শন করেছি কয়েকবার। অক্টোবর মাসে হাজির হই মেখলিগঞ্জ জেলার ডাকবাংলোতে। পরদিন মন্ত্রী মহোদয় দেখতে যাবেন দহগ্রাম, আঙ্গরপোতাসহ অনেক মুক্তাঞ্চল।

যাত্রার দিন সকালে একদল যুবক এসে হাজির হয় ডাকবাংলোতে মন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসেবে। তারা নকশালপন্থী। চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের অনুসারী। তারা মন্ত্রীকে সরাসরি বলল, আপনারা হলেন পাতি বুর্জোয়া গোষ্ঠী, নব্য পুঁজিপতি বণিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। নিরীহ মানুষের জীবনকে বাজি করে, তাদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত করে ক্ষমতা গ্রহণে অভিলাষী। আপনারা কবে এ নাটকের অবসান ঘটাবেন? মন্ত্রী এএইচ এম কামরুজ্জামান এতে একটুও বিচলিত হননি। তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ২৫ মার্চের কালোরাতের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার কথা তাদের কাছে অনর্গল বলে গেলেন। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকল। পরিশেষে তিনি বললেন, এটা হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সামরিক জান্তার হাত থেকে অসহায় নিরন্ন মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। এ যুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ও সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম থেকে গণমানুষের উদ্ধারকল্পে যুদ্ধ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানি সামরিক সরকার অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে, তাই অস্ত্রের ভাষায় আমাদের জবাব দিতে হবে। মনে হল, তারা কিছুটা হলেও বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছে। তবে আমি যখন মেখলিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড়ে যাই, রাস্তার পাশে দেখতে পাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে পাতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামনকে ভারত ছাড়ার দাবিতে পোস্টার। আমি আঁতকে উঠি। মনে মনে ভাবি, এরা জানে না আমাদের ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা, ১৯৬৬-এর ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনতার রায়ের কথা। এ নকশালপন্থীরাও ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়েই তাদের আদর্শের বাস্তবায়ন চায়। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে কেন?

আরেকটি ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমরা পৌঁছলাম আসামের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবরীতে অক্টোবরের এক রাতে। সভা শুরু হল সার্কিট হাউসে। সেখানে এলেন মন্ত্রী কামরুজ্জমান, আসামের শিল্পমন্ত্রী সুলতান আহমেদ এবং ভারতের লোকসভার সদস্য কোচবিহার থেকে নির্বাচিত শ্রীসন্তোষ রায়। আলোচনায় সহায়তা করছেন গোয়ালপাড়া জেলার প্রশাসক এবং তাকে সহায়তা করছেন জেলার আইন-শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা। আলোচনার বিষয়- বেশকিছু দিন থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের চিলমারী, রৌমারীসহ রংপুর

থেকে আগত শরণার্থীদের ক্যাম্পে মুসলিমপ্রধান এলাকার মানুষ গরম পানি ঢেলে দিয়ে তাদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, কিছু বিভ্রান্ত বাংলাদেশী নেতা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে অনেক কষ্টে অর্জিত পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে উদ্যত হয়েছে।

বিষয়টি এমনই নাজুক যে, খবর ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র ভারতবর্ষে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হতে পারে। কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভারতীয়দের উত্তেজিত করে। এমন অবস্থায় যদি জানতে পারে ভারতীয় মুসলমানরাও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করছে, তখন বিপদ হতে পারে। তাই অনেক রাত অবধি আলোচনা করে স্থির হয়, কামরুজ্জামান এবং শ্রী সন্তোষ রায় স্পর্শকাতর এলাকায় সভা করবেন এবং বোঝাবেন স্বাধীনতার যুদ্ধ কেন করতে হচ্ছে। মন্ত্রী সুলতান আহমেদ গোয়ালপাড়া জেলা এবং পার্শ্ববতী এলাকায় গিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসবেন।

এসব ঘটনার উল্লেখ করার কারণ, অনেক ভারতীয়ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারেনি। যেমন পারেনি বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু নেতা ও তাদের অনুসারীরা। তারা অনেকেই রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস হয়েছেন। তাদের বোঝানোর লোক ছিল না। স্বাধীনতার পর তাদের ভুল ভেঙেছে। তবে আমরা কিছু মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে পুনর্মিলনের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ

হয়েছি। বিজয়ীরা সব উপভোগ করবে (Winner takes all) এমন মানসিকতা

নিয়ে সর্বত্র বিচরণ করেছি, তাই ৪৪ বছর পরও সেই বিদ্বেষ ও হিংসা আমাদের তাড়া করছে।

স্বাধীনতা অর্জন সহজ ছিল না। শুধু আমেরিকা সপ্তম নৌবহর নিয়ে উপনীত হয়েছিল তাই নয়, অনেক দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত। এখনও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণের তাৎপর্য বুঝতে পারছি না আমরা অনেকে। যেসব নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন, যারা নির্যাতিত হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে নীরবে অশ্রু বির্সজন করেছেন, তাদের কথা ভেবে স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রেখে সামনে এগোতে হবে। দেশ এখন নব প্রজন্মের, তাদের সুস্থভাবে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে।

ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব




 

সাবমিট
বিক্ষিপ্ত ভাবনা

নিরুদ্দেশ যাত্রা

 ধীরাজ কুমার নাথ 
২৬ মার্চ ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

একাত্তর শুধু বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বছর নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক মহান সন্ধিক্ষণ এবং স্বাধিকার অর্জনেরও বছর। আমাদের জীবনে এ বছরটি বারবার ফিরে আসে, আর স্মৃতিতে ভেসে আসে এমন ঘটনাপ্রবাহ, যা ভাবলে এখনও রাতে ঘুম ভেঙে যায়, কেঁপে উঠি আশংকায়। তখন ছিল যৌবন, যুদ্ধে যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। তাই বোধহয় পেরেছি সব বিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বাধীন মাতৃভূমিকে গৌরবের মহিমায় ভরে দিতে। সেদিনের কথা বারবার বলি, তবুও শেষ হয় না, আবারও বলতে ইচ্ছা করে। কারও ভালো লাগা বা না লাগার কথা তোয়াক্কা না করে বলতেই থাকব একাত্তরের কথা, যতদিন দেহে আছে প্রাণ।

বর্তমানে যেমন গণমাধ্যম ও যোগাযোগের ভুবনে মহাবিপ্লব ঘটেছে, তখনকার পরিস্থিতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সড়ক, নৌ-পরিবহন ও রেলপথে জনগণের যাতায়াত ছিল সময়সাপেক্ষ এবং সমস্যাসংকুল। সত্যি কথা বলতে কী, ২৫ মার্চ কালোরাতে ঢাকায় কী ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল, তা পটুয়াখালীতে আমরা তিন দিনেও জানতে পারিনি। বিচ্ছিন্ন কিছু খবর পেলেও তা ছিল বিভ্রান্তিতে ভরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ও মহাকাব্যিক ভাষণ জনগণের মনে যেমন স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল, উজ্জীবিত করেছিল সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে, তেমনি এক ভয়াবহ দিনের আভাস দিয়েছিল প্রতি জনে, প্রতি ঘরে। একটা ভয়াবহ দিনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দেশবাসী, তা অনুধাবন করতে পেরেছিল তারা; কিন্তু তার ব্যাপকতা ও বিধ্বংসী রূপ কেউ অনুধাবন করতে পারেনি সঠিকভাবে। কুকুর গভীর রাতে কেঁদে উঠত, কাক দিনরাত কা কা শব্দে অশুভ দিনের বার্তা জানাত। জনগণের মুখে হাসি নেই, রাস্তাঘাটে শুধু এক কথা- কী হবে এরপর? তবে ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর দেশবাসীকে জানান দিয়েছিল, আমরা অবতীর্ণ হয়েছি রক্তক্ষয়ী এক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে, অজানা ভবিষ্যৎকে বাজি রেখে।

দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রকারান্তরে আশীর্বাদ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল ওই সময়ে। পাকিস্তানি গণহত্যাকারীরা গ্রামে-গঞ্জে দ্রুতগতিতে পৌঁছাতে পারেনি, যতটা আশা করেছিল। এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ করে দিয়েছিল সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অভিযান চালাতে।

নিরীহ জনতার ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি, তার শিকার হয়েছি। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ এপ্রিল অর্থাৎ এক মাস পর আক্রমণ করে পটুয়াখালী জেলা সদর, ডিসি অফিসসহ সব বৃহৎ অবকাঠামোয়। আকাশ থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে করতে ৬টি হেলিকপ্টার নেমে আসে শহরে। দুটি জেট বিমান ওপর থেকে নিচে নামে প্রচণ্ড শব্দে অনর্গল গুলিবর্ষণ করতে করতে আবার ওপরে উঠে। অবিরাম গোলাবর্ষণ ও বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের আক্রমণে রাস্তার দু’ধারে মৃত মানুষের কাফেলা তৈরি হয় চোখের নিমিষে। মুহূর্তেই গোলপাতার শহর আগুনে জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাওয়া যায় দূরদূরান্ত থেকে। জেলখানা ভেঙে কয়েদিসহ হাজারও শহরবাসী, নারী-পুরুষ দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জেট বিমান থেকে চলে নদীতে ভাসমান মানুষের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ। নদীর জল লাল হয়ে যায় মুহূর্তে। নিরীহ মানুষকে এমন নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ইতিহাস বিশ্বে বিরল।

এমনই এক সন্ধিক্ষণে মৃত্যুকে বাজি রেখে বেরিয়ে পড়ি ডাকবাংলো ছেড়ে। আশ্রয় নেই নদীর ওপারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে। তারপর শুরু হয় অজানা ভবিষ্যৎকে ভর করে নিরুদ্দেশ যাত্রা। প্রায় ২২ দিন পর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম জগন্নাথ দীঘির পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ি ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানকার রাজনগর থানার ওসি সাময়িকভাবে ভারতে অবস্থানের একটি সার্টিফিকেট দেয় এবং আমাদের কাছে নির্যাতনের কথা শুনে আঁতকে ওঠে। আমরা লক্ষ্য করেছি অগণিত শরণার্থীর কাফেলা মিছিল ধরে ভারতে প্রবেশ করছে, তারা সবাই ক্লান্ত, সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বিলোনিয়া থেকে উদয়পুর, তারপর আগরতলা- দীর্ঘ শত মাইল, তার দু’পাশে শরণার্থী শিবির আর শিবির। কয়েকদিন আগেও যাদের বাড়িতে ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর সম্পদের ছড়াছড়ি, তাদের এখন আশ্রয়স্থল রাস্তার পাশে বস্তি। কী খাবে, কোথায় যাবে, কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

সৌভাগ্যক্রমে এমন অনেক শরণার্থী শিবির, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মুচলেকা দানের পর আমার নিয়োগ হয় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। লবণ হ্রদে অবস্থিত লাখো মানুষের শরণার্থী শিবির (বর্তমানে সল্টলেক) এবং উত্তরবঙ্গের অনেক ত্রাণ শিবির পরিদর্শন করেছি কয়েকবার। অক্টোবর মাসে হাজির হই মেখলিগঞ্জ জেলার ডাকবাংলোতে। পরদিন মন্ত্রী মহোদয় দেখতে যাবেন দহগ্রাম, আঙ্গরপোতাসহ অনেক মুক্তাঞ্চল।

যাত্রার দিন সকালে একদল যুবক এসে হাজির হয় ডাকবাংলোতে মন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসেবে। তারা নকশালপন্থী। চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের অনুসারী। তারা মন্ত্রীকে সরাসরি বলল, আপনারা হলেন পাতি বুর্জোয়া গোষ্ঠী, নব্য পুঁজিপতি বণিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। নিরীহ মানুষের জীবনকে বাজি করে, তাদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত করে ক্ষমতা গ্রহণে অভিলাষী। আপনারা কবে এ নাটকের অবসান ঘটাবেন? মন্ত্রী এএইচ এম কামরুজ্জামান এতে একটুও বিচলিত হননি। তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ২৫ মার্চের কালোরাতের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার কথা তাদের কাছে অনর্গল বলে গেলেন। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকল। পরিশেষে তিনি বললেন, এটা হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সামরিক জান্তার হাত থেকে অসহায় নিরন্ন মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। এ যুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ও সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম থেকে গণমানুষের উদ্ধারকল্পে যুদ্ধ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানি সামরিক সরকার অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে, তাই অস্ত্রের ভাষায় আমাদের জবাব দিতে হবে। মনে হল, তারা কিছুটা হলেও বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছে। তবে আমি যখন মেখলিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড়ে যাই, রাস্তার পাশে দেখতে পাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে পাতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামনকে ভারত ছাড়ার দাবিতে পোস্টার। আমি আঁতকে উঠি। মনে মনে ভাবি, এরা জানে না আমাদের ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা, ১৯৬৬-এর ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনতার রায়ের কথা। এ নকশালপন্থীরাও ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়েই তাদের আদর্শের বাস্তবায়ন চায়। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে কেন?

আরেকটি ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমরা পৌঁছলাম আসামের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবরীতে অক্টোবরের এক রাতে। সভা শুরু হল সার্কিট হাউসে। সেখানে এলেন মন্ত্রী কামরুজ্জমান, আসামের শিল্পমন্ত্রী সুলতান আহমেদ এবং ভারতের লোকসভার সদস্য কোচবিহার থেকে নির্বাচিত শ্রীসন্তোষ রায়। আলোচনায় সহায়তা করছেন গোয়ালপাড়া জেলার প্রশাসক এবং তাকে সহায়তা করছেন জেলার আইন-শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা। আলোচনার বিষয়- বেশকিছু দিন থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের চিলমারী, রৌমারীসহ রংপুর

থেকে আগত শরণার্থীদের ক্যাম্পে মুসলিমপ্রধান এলাকার মানুষ গরম পানি ঢেলে দিয়ে তাদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, কিছু বিভ্রান্ত বাংলাদেশী নেতা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে অনেক কষ্টে অর্জিত পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে উদ্যত হয়েছে।

বিষয়টি এমনই নাজুক যে, খবর ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র ভারতবর্ষে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হতে পারে। কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভারতীয়দের উত্তেজিত করে। এমন অবস্থায় যদি জানতে পারে ভারতীয় মুসলমানরাও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করছে, তখন বিপদ হতে পারে। তাই অনেক রাত অবধি আলোচনা করে স্থির হয়, কামরুজ্জামান এবং শ্রী সন্তোষ রায় স্পর্শকাতর এলাকায় সভা করবেন এবং বোঝাবেন স্বাধীনতার যুদ্ধ কেন করতে হচ্ছে। মন্ত্রী সুলতান আহমেদ গোয়ালপাড়া জেলা এবং পার্শ্ববতী এলাকায় গিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসবেন।

এসব ঘটনার উল্লেখ করার কারণ, অনেক ভারতীয়ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারেনি। যেমন পারেনি বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু নেতা ও তাদের অনুসারীরা। তারা অনেকেই রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস হয়েছেন। তাদের বোঝানোর লোক ছিল না। স্বাধীনতার পর তাদের ভুল ভেঙেছে। তবে আমরা কিছু মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে পুনর্মিলনের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ

হয়েছি। বিজয়ীরা সব উপভোগ করবে (Winner takes all) এমন মানসিকতা

নিয়ে সর্বত্র বিচরণ করেছি, তাই ৪৪ বছর পরও সেই বিদ্বেষ ও হিংসা আমাদের তাড়া করছে।

স্বাধীনতা অর্জন সহজ ছিল না। শুধু আমেরিকা সপ্তম নৌবহর নিয়ে উপনীত হয়েছিল তাই নয়, অনেক দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত। এখনও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণের তাৎপর্য বুঝতে পারছি না আমরা অনেকে। যেসব নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন, যারা নির্যাতিত হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে নীরবে অশ্রু বির্সজন করেছেন, তাদের কথা ভেবে স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রেখে সামনে এগোতে হবে। দেশ এখন নব প্রজন্মের, তাদের সুস্থভাবে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে।

ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব




 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র