jugantor
চিনি বেগমের ভূমিকম্প ভাবনা

  মোকাম্মেল হোসেন  

১০ মে ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারছি না। নির্বাচনের আগে হলে ভাবা যেত, ভদ্রমহিলা তার কলা-মুলা-ছালা অথবা শিলপাটা মার্কায় ভোট চাইতে এসেছেন। কিঞ্চিৎ বলকারক, রক্তপাতহীন ও আরামদায়ক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। কাজেই ধরে নেয়া যায়, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয় নয়।

তবে কি ভদ্রমহিলা সামনের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে এলেন? সকাল থেকেই সিঁড়ি দিয়ে জিনিসপত্র উঠানোর হৈ-হৈ শব্দ পাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, অনুমান সঠিক। এ মুহূর্তে তিনি তার নিকট-প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। ভূমিকা পর্বের শেষে ভদ্রমহিলা বললেন-

: আসব?

দরজা থেকে কয়েক কদম পেছনে সরে এসে বললাম-

: আসুন, আসুন। প্লিজ...

ভদ্রমহিলা ভেতরে ঢুকলেন। চারপাশের নীরবতা পরখ করে জানতে চাইলেন-

: বাসায় আর কেউ নেই!

-না।

ভদ্রমহিলার মধ্যে উসখুস ভাব দেখা গেল। হাত কচলে বললেন-

: ঠিক আছে, আমি তাহলে পরে আসব।

পরে আসব মানে? ভদ্রমহিলা কি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না? এমনটা ভাবলে অপমানজনক। একটা পিঁপড়াও আমার কাছে অনিরাপদ নয়। আর একজন মানুষ হয়ে উনি আমার সম্পর্কে এসব ভাববেন কেন? অভয় দেয়ার সুরে তাকে বললাম-

: কোনো সমস্যা নেই, আপনি বসুন।

সমস্যা নেই শব্দটার ওপর এত জোর দিলাম, ভদ্রমহিলা আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না। অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসলেন। আপ্যায়ন করার জন্য কৌটা থেকে বিস্কুট-চানাচুর বের করছি দেখে তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন-

: আপনি এসব একদমই করতে যাবেন না! আমি এখন কিছু খাব না।

তার সরবতায় চুপসে গিয়ে আহত কণ্ঠে বললাম-

: আপনি নিশ্চয়ই চান না আমার অকল্যাণ হোক।

- কী আশ্চর্য! আমি আপনার অকল্যাণ চাইব কেন!

: প্রথমবার এসে কিছু মুখে না দিলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।

চিরল দাঁতের মিষ্টি হাসি ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন-

: ও খোদা! আপনি এসব বিশ্বাস করেন?

- জি, করি। আপনি খাওয়া শুরু করুন। আমি চা করছি। আমি অসাধারণ চা বানাই।

ভদ্রমহিলা প্লেট থেকে একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন-

: আমি পরে এসে আপনার অসাধারণ চায়ের স্বাদ উপভোগ করব। এখন যাই।

সন্ধ্যার পর ছেলেদের ওপর মাস্টারি করছি, লবণ বেগম ডাক দিল। ডাক অনুসরণ করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, সেই ভদ্রমহিলা। লবণ বেগম তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হতেই বললাম-

: উনি আমার পূর্বপরিচিত।

লবণ বেগমের চোখ ছোট হয়ে গেল। সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আত্মস্থ হয়ে বলল-

: তোমরা কথাবার্তা বল। আমি নাস্তার আয়োজন করি।

ভদ্রমহিলার পাশের সোফায় উপবেশন করে বললাম-

: তখন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

-আমার নাম চিনি বেগম।

: চিনি! মানে সুগার?

আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে চিনি বেগম মুচকি হেসে বললেন-

: মানুষের নাম মিষ্টি, ক্যান্ডি, টফি, চকোলেট ইত্যাদি হতে পারলে চিনিতে দোষ কোথায়?

- না, দোষ নেই।

চিনি বেগম হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন-

: আমার নাম চিনি বেগম হওয়ার পেছনে একটা ইতিহাস আছে।

- ইতিহাস! কী রকম?

: ছোটবেলায় আমার প্রধান খাবার ছিল চিনি মাখানো ভাত। চিনির প্রতি আমার অত্যধিক দুর্বলতা দেখে নানি আমার নাম রাখলেন চিনি বেগম।

নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে চিনি বেগম আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন। বললেন-

: এবার আপনার হাতের সেই অসাধারণ চা খাব।

লবণ বেগমের চোখ এবার মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেল। আমার মুখের প্রতিটি রেখা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে বলল-

: চুলায় চায়ের পানি দিয়া রাখছি...

রান্নাঘরে গিয়ে তিন কাপ চাপ বানালাম। পরিবেশনের সময় লবণ বেগমের সঙ্গে চোখাচোখি হল। তার চোখের তারায় বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। চিনি বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন-

: সত্যি, অসাধারণ।

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এখন চা নিয়ে কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না। চায়ের কাপ রেখে চিনি বেগম জানতে চাইলেন-

: আপনারা এ বাসায় কতদিন ধরে আছেন?

উত্তর দিল লবণ বেগম। গম্ভীর মুখে সে জানালো-

: এপ্রিলে ১০ বছর পার হইছে।

চিনি বেগম এবার আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন-

: আপনারা এসে কি বাড়িওয়ালাকে এ বাসায় পেয়েছিলেন?

- না।

: তিনি কেন এ বাসায় থাকেন না- এ কথা কি তাকে কখনও জিজ্ঞেস করেছিলেন?

- এইটা ছাড়া ঢাকা শহরে ওনার আরও দুইটা বাড়ি আছে। উনি ওনার সুবিধামতো কোনো একটায় থাকেন হয়তো।

: এই বাসা কী দোষ করছে?

- এইটা তো আমি জানি না।

: জানি না বলে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। জানতে হবে।

- কেন বলুন তো?

: এমন হতে পারে, ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় বাড়িওয়ালা এ বাসায় থাকেন না।

- এ রকম মনে করবে কেন! এ এলাকার পরিবেশ খুবই ভালো। চোর-ছ্যাঁচড় বা কোনো আজেবাজে লোকের উপদ্রব নেই।

: আমি এই ঝুঁকির কথা বলছি না।

- তাহলে?

: ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ির নির্মাণকাজই ত্র“টিপূর্ণ হয়। বাড়িওয়ালারা চারতলার নকশা পাস করে আটতলা নির্মাণ করে। নিুমানের রড ব্যবহার করে। সিমেন্ট-বালু মিশ্রণের অনুপাতে গরমিল করে। এ বাড়ির ক্ষেত্রেও এ রকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। হয়তো এজন্যই বাড়িওয়ালা এ বাড়িকে বসবাসের উপযোগী মনে করেন না।

- কী বলেন! এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ একটা বাড়ি উনি ভাড়া দিতে যাবেন কেন?

: ভাড়া দিতে তো সমস্যা নেই। ভূমিকম্পে ওনার পরিবারের কারও মাথার ওপর তো ছাদ ভেঙে পড়ছে না।

- ভূমিকম্প!

চিনি বেগম কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন-

: হ্যাঁ, ভূমিকম্প। এতদিন শুনছি, তুরস্কে ভূমিকম্প হচ্ছে। ইরানে হচ্ছে। জাপানে হচ্ছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় হচ্ছে। আর দেখুন, এখন সে নেপাল পর্যন্ত চলে এসেছে। সার্কভুক্ত একটা দেশে পা রাখার পর বাংলাদেশের ব্যাপারে যদি ভূমিকম্পের আগ্রহ জন্মায়, তাহলে উপায় কী হবে- চিন্তা করতে পারেন?

- জ্বি, না।

: জ্বি-না বলে ঘাড় ছেড়ে দেবেন না, প্লিজ।

- কী করব?

: এই বাসার বাসিন্দাদের সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। রাজউক কয়তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদন দিয়েছে, কোন আর্কিটেক্ট এই বাড়ির ডিজাইন করেছে, কোন ইঞ্জিনিয়ার নির্মাণ কাজ তদারকি করেছে, কী ধরনের রড-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, বালু-খোয়া-সিমেন্ট মিশ্রণের অনুপাত কত, কোন কোম্পানির বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে, কোন রাজমিস্ত্রি-জোগালি কাজ করেছে- ইত্যাদি সব তথ্য বাড়িওয়ালার কাছে চাইতে হবে।

- বাড়িওয়ালা কি এসব তথ্য দেবেন?

: কেন দেবেন না? একটা ওষুধে কী কী উপাদান আছে, কোন কোম্পানি তৈরি করেছে, কবে তৈরি করেছে, কবে এর মেয়াদ শেষ হবে-এসব যদি লেখা বাধ্যতামূলক হলে বাড়ির ক্ষেত্রে কেন হবে না? সব ডকুমেন্ট হাতে পাওয়ার পর যদি দেখি এ বাড়িতে থাকা নিরাপদ, তবেই এখানে থাকব- নচেৎ নয়।

ঢোক গিলে বললাম-

: কোথায় যাব?

-নতুন কোনো বাসায়।

: সেখানেও যদি গড়বড় পাওয়া যায়? তার চেয়ে আপনে একটা কাজ করেন। ঢাকা শহরে নতুন মেয়র গদিনশীন হইছে। বিষয়টা তার নজরে আনেন। মেয়র যদি একটা আইন পাস করে- শহরের প্রত্যেকটা বাড়ির নির্মাণ সংক্রান্ত সব তথ্য একটা সাইনবোর্ডে লেইখ্যা বাড়ির সামনে টাঙাইয়া রাখতে হবে, তাহলে সেইটা বাস্তবায়িত করা যাবে। প্রত্যেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ভাড়া নেয়ার আগে সাইনবোর্ডের তথ্য দেইখ্যা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

চিনি বেগম হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন-

: চমৎকার। আমরা একটা দরখাস্ত নিয়ে মেয়রের কাছে যাব। অপনাকেও আমার সঙ্গে নগর ভবনে যেতে হবে।

- ঠিক আছে, যাব।

চিনি বেগমকে বিদায় জানিয়ে লবণ বেগম আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল-

: তোমার কাছে আমার দুইটা প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন- চিনি বেগমের সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়? কীভাবে পরিচয়?

স্বামীর বিবাহ-পূর্ব জীবন সম্পর্কে স্ত্রী-জাতির প্রবল আগ্রহ থাকে। চিনি বেগমকে সেই জীবনের নায়িকা বানিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেললে কেমন হয়! উদাস ভঙ্গিতে বললাম-

: চিনি বেগম কলেজে আমার সহপাঠি ছিল।

- সে তোমার সহপাঠী হয় কীভাবে! দেইখ্যা তো মনে হইল, তোমার চাইতে বয়স অনেক কম।

: চিনি বেগম ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতন স্বাস্থ্য সচেতন। এজন্যই তার প্রকৃত বয়স বোঝা যায় না। তোমার মনে সন্দেহ জাগলে, তুমি তার জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করতে পার।

- কোনো মহিলার কাছে তার জন্ম তারিখ জিগাইয়া লাভ নাই। সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না।

: তাইলে সার্টিফিকেট চেক কর।

- আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি চা বানানোর অসাধারণ কারিগর- এইটা সে জানলো কেমনে?

: এইটা এক লম্বা কাহিনী। কলেজে পড়ার সময় চিনি বেগম একদিন তার বান্ধবীর সঙ্গে হোস্টেলে আমার এক রুমমেটের কাছে আসছিল। তখন আমি তাদের চা বানাইয়া খাওয়াইছিলাম। সেই চা খাইয়া তো চিনি বেগম বেহুঁশ। এর পর মাঝেমধ্যেই সে আমার তৈরি চা খাওয়ার জন্য হোস্টেলে আসত।

- শুধু চা-ই খাইছে? আর কিছু খাওয়া-খাওয়ি হয় নাই?

: মানে?

- চায়ের স্বাদে গদগদ হওয়া চিনি বেগমরে তুমি প্রেম নিবেদন কর নাই?

: আরে! ছাত্রজীবনে আমি ছিলাম একটা ভীতুর আণ্ডা। সাহসী না হইলে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করা যায় না।

- এখন তো সাহস হইছে। এখন করবা।

: দুর-উ! কী কও এইসব! এখন কি আর সেই সুযোগ আছে?

- সুযোগ নাই মানে? দরজা খুলবা, আর হাত বাড়াইয়া টাইন্যা নিবা।

: বাদ দেও তো এইসব।

-আইজ থেইক্যা বাসায় তোমার চা বানানো বন্ধ। খাওয়াও বন্ধ।

: হায় আল্লাহ! চা ছাড়া বাঁচব কেমনে?

- চায়ের বদলে তুমি পান-সুপারি খাওয়া শুরু কর।

: পান খাওয়ার অভ্যাস করব?

- করবা। প্রয়োজনে বাঘ হরিণের গোশত ছাইড়া ঘাস খায়।

: আমার ক্ষেত্রে প্রয়োজনটা কি এতই বেশি?

লবণ বেগম কঠিন মুখে বলল-

: হ্যাঁ।

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

onnachitra.bd@gmail.com



সাবমিট

চিনি বেগমের ভূমিকম্প ভাবনা

 মোকাম্মেল হোসেন 
১০ মে ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 
ভদ্রমহিলাকে চিনতে পারছি না। নির্বাচনের আগে হলে ভাবা যেত, ভদ্রমহিলা তার কলা-মুলা-ছালা অথবা শিলপাটা মার্কায় ভোট চাইতে এসেছেন। কিঞ্চিৎ বলকারক, রক্তপাতহীন ও আরামদায়ক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। কাজেই ধরে নেয়া যায়, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয় নয়।

তবে কি ভদ্রমহিলা সামনের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে এলেন? সকাল থেকেই সিঁড়ি দিয়ে জিনিসপত্র উঠানোর হৈ-হৈ শব্দ পাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, অনুমান সঠিক। এ মুহূর্তে তিনি তার নিকট-প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। ভূমিকা পর্বের শেষে ভদ্রমহিলা বললেন-

: আসব?

দরজা থেকে কয়েক কদম পেছনে সরে এসে বললাম-

: আসুন, আসুন। প্লিজ...

ভদ্রমহিলা ভেতরে ঢুকলেন। চারপাশের নীরবতা পরখ করে জানতে চাইলেন-

: বাসায় আর কেউ নেই!

-না।

ভদ্রমহিলার মধ্যে উসখুস ভাব দেখা গেল। হাত কচলে বললেন-

: ঠিক আছে, আমি তাহলে পরে আসব।

পরে আসব মানে? ভদ্রমহিলা কি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না? এমনটা ভাবলে অপমানজনক। একটা পিঁপড়াও আমার কাছে অনিরাপদ নয়। আর একজন মানুষ হয়ে উনি আমার সম্পর্কে এসব ভাববেন কেন? অভয় দেয়ার সুরে তাকে বললাম-

: কোনো সমস্যা নেই, আপনি বসুন।

সমস্যা নেই শব্দটার ওপর এত জোর দিলাম, ভদ্রমহিলা আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না। অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসলেন। আপ্যায়ন করার জন্য কৌটা থেকে বিস্কুট-চানাচুর বের করছি দেখে তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন-

: আপনি এসব একদমই করতে যাবেন না! আমি এখন কিছু খাব না।

তার সরবতায় চুপসে গিয়ে আহত কণ্ঠে বললাম-

: আপনি নিশ্চয়ই চান না আমার অকল্যাণ হোক।

- কী আশ্চর্য! আমি আপনার অকল্যাণ চাইব কেন!

: প্রথমবার এসে কিছু মুখে না দিলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়।

চিরল দাঁতের মিষ্টি হাসি ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন-

: ও খোদা! আপনি এসব বিশ্বাস করেন?

- জি, করি। আপনি খাওয়া শুরু করুন। আমি চা করছি। আমি অসাধারণ চা বানাই।

ভদ্রমহিলা প্লেট থেকে একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন-

: আমি পরে এসে আপনার অসাধারণ চায়ের স্বাদ উপভোগ করব। এখন যাই।

সন্ধ্যার পর ছেলেদের ওপর মাস্টারি করছি, লবণ বেগম ডাক দিল। ডাক অনুসরণ করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি, সেই ভদ্রমহিলা। লবণ বেগম তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হতেই বললাম-

: উনি আমার পূর্বপরিচিত।

লবণ বেগমের চোখ ছোট হয়ে গেল। সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আত্মস্থ হয়ে বলল-

: তোমরা কথাবার্তা বল। আমি নাস্তার আয়োজন করি।

ভদ্রমহিলার পাশের সোফায় উপবেশন করে বললাম-

: তখন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

-আমার নাম চিনি বেগম।

: চিনি! মানে সুগার?

আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে চিনি বেগম মুচকি হেসে বললেন-

: মানুষের নাম মিষ্টি, ক্যান্ডি, টফি, চকোলেট ইত্যাদি হতে পারলে চিনিতে দোষ কোথায়?

- না, দোষ নেই।

চিনি বেগম হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন-

: আমার নাম চিনি বেগম হওয়ার পেছনে একটা ইতিহাস আছে।

- ইতিহাস! কী রকম?

: ছোটবেলায় আমার প্রধান খাবার ছিল চিনি মাখানো ভাত। চিনির প্রতি আমার অত্যধিক দুর্বলতা দেখে নানি আমার নাম রাখলেন চিনি বেগম।

নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে চিনি বেগম আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন। বললেন-

: এবার আপনার হাতের সেই অসাধারণ চা খাব।

লবণ বেগমের চোখ এবার মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেল। আমার মুখের প্রতিটি রেখা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে বলল-

: চুলায় চায়ের পানি দিয়া রাখছি...

রান্নাঘরে গিয়ে তিন কাপ চাপ বানালাম। পরিবেশনের সময় লবণ বেগমের সঙ্গে চোখাচোখি হল। তার চোখের তারায় বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। চিনি বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন-

: সত্যি, অসাধারণ।

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এখন চা নিয়ে কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না। চায়ের কাপ রেখে চিনি বেগম জানতে চাইলেন-

: আপনারা এ বাসায় কতদিন ধরে আছেন?

উত্তর দিল লবণ বেগম। গম্ভীর মুখে সে জানালো-

: এপ্রিলে ১০ বছর পার হইছে।

চিনি বেগম এবার আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন-

: আপনারা এসে কি বাড়িওয়ালাকে এ বাসায় পেয়েছিলেন?

- না।

: তিনি কেন এ বাসায় থাকেন না- এ কথা কি তাকে কখনও জিজ্ঞেস করেছিলেন?

- এইটা ছাড়া ঢাকা শহরে ওনার আরও দুইটা বাড়ি আছে। উনি ওনার সুবিধামতো কোনো একটায় থাকেন হয়তো।

: এই বাসা কী দোষ করছে?

- এইটা তো আমি জানি না।

: জানি না বলে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। জানতে হবে।

- কেন বলুন তো?

: এমন হতে পারে, ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় বাড়িওয়ালা এ বাসায় থাকেন না।

- এ রকম মনে করবে কেন! এ এলাকার পরিবেশ খুবই ভালো। চোর-ছ্যাঁচড় বা কোনো আজেবাজে লোকের উপদ্রব নেই।

: আমি এই ঝুঁকির কথা বলছি না।

- তাহলে?

: ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ির নির্মাণকাজই ত্র“টিপূর্ণ হয়। বাড়িওয়ালারা চারতলার নকশা পাস করে আটতলা নির্মাণ করে। নিুমানের রড ব্যবহার করে। সিমেন্ট-বালু মিশ্রণের অনুপাতে গরমিল করে। এ বাড়ির ক্ষেত্রেও এ রকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। হয়তো এজন্যই বাড়িওয়ালা এ বাড়িকে বসবাসের উপযোগী মনে করেন না।

- কী বলেন! এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ একটা বাড়ি উনি ভাড়া দিতে যাবেন কেন?

: ভাড়া দিতে তো সমস্যা নেই। ভূমিকম্পে ওনার পরিবারের কারও মাথার ওপর তো ছাদ ভেঙে পড়ছে না।

- ভূমিকম্প!

চিনি বেগম কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন-

: হ্যাঁ, ভূমিকম্প। এতদিন শুনছি, তুরস্কে ভূমিকম্প হচ্ছে। ইরানে হচ্ছে। জাপানে হচ্ছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় হচ্ছে। আর দেখুন, এখন সে নেপাল পর্যন্ত চলে এসেছে। সার্কভুক্ত একটা দেশে পা রাখার পর বাংলাদেশের ব্যাপারে যদি ভূমিকম্পের আগ্রহ জন্মায়, তাহলে উপায় কী হবে- চিন্তা করতে পারেন?

- জ্বি, না।

: জ্বি-না বলে ঘাড় ছেড়ে দেবেন না, প্লিজ।

- কী করব?

: এই বাসার বাসিন্দাদের সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। রাজউক কয়তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদন দিয়েছে, কোন আর্কিটেক্ট এই বাড়ির ডিজাইন করেছে, কোন ইঞ্জিনিয়ার নির্মাণ কাজ তদারকি করেছে, কী ধরনের রড-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, বালু-খোয়া-সিমেন্ট মিশ্রণের অনুপাত কত, কোন কোম্পানির বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে, কোন রাজমিস্ত্রি-জোগালি কাজ করেছে- ইত্যাদি সব তথ্য বাড়িওয়ালার কাছে চাইতে হবে।

- বাড়িওয়ালা কি এসব তথ্য দেবেন?

: কেন দেবেন না? একটা ওষুধে কী কী উপাদান আছে, কোন কোম্পানি তৈরি করেছে, কবে তৈরি করেছে, কবে এর মেয়াদ শেষ হবে-এসব যদি লেখা বাধ্যতামূলক হলে বাড়ির ক্ষেত্রে কেন হবে না? সব ডকুমেন্ট হাতে পাওয়ার পর যদি দেখি এ বাড়িতে থাকা নিরাপদ, তবেই এখানে থাকব- নচেৎ নয়।

ঢোক গিলে বললাম-

: কোথায় যাব?

-নতুন কোনো বাসায়।

: সেখানেও যদি গড়বড় পাওয়া যায়? তার চেয়ে আপনে একটা কাজ করেন। ঢাকা শহরে নতুন মেয়র গদিনশীন হইছে। বিষয়টা তার নজরে আনেন। মেয়র যদি একটা আইন পাস করে- শহরের প্রত্যেকটা বাড়ির নির্মাণ সংক্রান্ত সব তথ্য একটা সাইনবোর্ডে লেইখ্যা বাড়ির সামনে টাঙাইয়া রাখতে হবে, তাহলে সেইটা বাস্তবায়িত করা যাবে। প্রত্যেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ভাড়া নেয়ার আগে সাইনবোর্ডের তথ্য দেইখ্যা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

চিনি বেগম হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন-

: চমৎকার। আমরা একটা দরখাস্ত নিয়ে মেয়রের কাছে যাব। অপনাকেও আমার সঙ্গে নগর ভবনে যেতে হবে।

- ঠিক আছে, যাব।

চিনি বেগমকে বিদায় জানিয়ে লবণ বেগম আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল-

: তোমার কাছে আমার দুইটা প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন- চিনি বেগমের সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়? কীভাবে পরিচয়?

স্বামীর বিবাহ-পূর্ব জীবন সম্পর্কে স্ত্রী-জাতির প্রবল আগ্রহ থাকে। চিনি বেগমকে সেই জীবনের নায়িকা বানিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেললে কেমন হয়! উদাস ভঙ্গিতে বললাম-

: চিনি বেগম কলেজে আমার সহপাঠি ছিল।

- সে তোমার সহপাঠী হয় কীভাবে! দেইখ্যা তো মনে হইল, তোমার চাইতে বয়স অনেক কম।

: চিনি বেগম ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতন স্বাস্থ্য সচেতন। এজন্যই তার প্রকৃত বয়স বোঝা যায় না। তোমার মনে সন্দেহ জাগলে, তুমি তার জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করতে পার।

- কোনো মহিলার কাছে তার জন্ম তারিখ জিগাইয়া লাভ নাই। সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না।

: তাইলে সার্টিফিকেট চেক কর।

- আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি চা বানানোর অসাধারণ কারিগর- এইটা সে জানলো কেমনে?

: এইটা এক লম্বা কাহিনী। কলেজে পড়ার সময় চিনি বেগম একদিন তার বান্ধবীর সঙ্গে হোস্টেলে আমার এক রুমমেটের কাছে আসছিল। তখন আমি তাদের চা বানাইয়া খাওয়াইছিলাম। সেই চা খাইয়া তো চিনি বেগম বেহুঁশ। এর পর মাঝেমধ্যেই সে আমার তৈরি চা খাওয়ার জন্য হোস্টেলে আসত।

- শুধু চা-ই খাইছে? আর কিছু খাওয়া-খাওয়ি হয় নাই?

: মানে?

- চায়ের স্বাদে গদগদ হওয়া চিনি বেগমরে তুমি প্রেম নিবেদন কর নাই?

: আরে! ছাত্রজীবনে আমি ছিলাম একটা ভীতুর আণ্ডা। সাহসী না হইলে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করা যায় না।

- এখন তো সাহস হইছে। এখন করবা।

: দুর-উ! কী কও এইসব! এখন কি আর সেই সুযোগ আছে?

- সুযোগ নাই মানে? দরজা খুলবা, আর হাত বাড়াইয়া টাইন্যা নিবা।

: বাদ দেও তো এইসব।

-আইজ থেইক্যা বাসায় তোমার চা বানানো বন্ধ। খাওয়াও বন্ধ।

: হায় আল্লাহ! চা ছাড়া বাঁচব কেমনে?

- চায়ের বদলে তুমি পান-সুপারি খাওয়া শুরু কর।

: পান খাওয়ার অভ্যাস করব?

- করবা। প্রয়োজনে বাঘ হরিণের গোশত ছাইড়া ঘাস খায়।

: আমার ক্ষেত্রে প্রয়োজনটা কি এতই বেশি?

লবণ বেগম কঠিন মুখে বলল-

: হ্যাঁ।

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

onnachitra.bd@gmail.com



 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র