jugantor
মিডিয়ায় নারীর সাফল্যগাথা
সামনে বিশ্ব নারী দিবস। এ দিবসকে নিয়ে তারা ঝিলমিলের আজকের এ আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মিডিয়ায় নারীদের অসামান্য অবদানকে সম্মান জানাতে আমাদের এ প্রচেষ্টা। লিখেছেন-

  পিয়াস রায়  

০৫ মার্চ ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর- কবি নজরুলের ভাষায়, নারীর এমন ক্ষমতায়নের আভাস মেলে বহু বছর আগেই। যদিওবা পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে নারীর সত্যিকার অর্থে মুক্ত হয়ে স্বীকৃতি লাভের বিষয়টি সব সময়ই পুরুষশাষিত সমাজব্যবস্থার কাছে ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ এই সত্যিকে না মেনেই বা উপায় কী। পৃথিবীর অর্ধেক এই জনগোষ্ঠীকে কেটে-ছেঁটে আদৌ কোনো কাজে কতটাই বা উন্মেষ সম্ভব?

আর কর্মযজ্ঞ যখন মিডিয়া তখন নারীর সেখানে উপস্থিতি আর সব ক্ষেত্রের চেয়েও অনেক বেশি আকাক্সিক্ষত। মিডিয়া, তা সে মিডিয়ার আদিতম রূপের সংবাদ অনুসন্ধান কিংবা উপস্থাপনই হোক। নতুবা হোক খবরের বাইরে এসে দর্শক চিত্তকে গান-নৃত্য কিংবা গল্প উপস্থাপনের উপযোগিতায় উপভোগ্য করে তোলা। ক্ষেত্র যাই হোক, নারী বিবর্জিত সেই মাধ্যমের কথাটা একটু ভেবে দেখবেন কি? কতটুকু নিষ্প্রভ হতে পারে তার রূপ! এক এক করে চলুন চোখ বুলাই এক একটা ক্ষেত্রের দিকে।

ভাবুন তো গান শুনছেন। একের পর এক গান গেয়ে চলছেন এক একজন পুরুষ শিল্পী। সুগায়ক অবশ্যই। কিন্তু ক্ষেত্রটিকে একবার নারী বিবর্জিত ভেবে দেখুন তো। যেখানে নেই উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোসলে থেকে অপরাপর কোনো নারীকণ্ঠি। দেশের পরিমণ্ডলে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা থেকে আজকের মিলা, কনা, ন্যান্সিরাও সেখানে পাচ্ছেন না প্রবেশাধিকার। কেমন হতে পারে সেই পুরুষতান্ত্রিক সঙ্গীত জগতের স্বরূপটা। নিশ্চয়ই বলবেন, সেটা কি আদতে ভেবে দেখা সম্ভব?

সম্ভব না অবশ্যই। মিডিয়ার সামগ্রিক রূপরেখায় নারীর সংযুক্তি আসলে তেমনি একটা অকাট্য প্রশ্ন। আজ কোথায় নেই নারী? সংবাদ প্রত্যাশী একজন মানুষের খবরের ক্ষুধা মেটাতে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে ছুটে বেড়ানো ডানপিঠে সাংবাদিক থেকে সেই সংগৃহীত সংবাদকে গ্রাহকের জন্য হজমযোগ্য সংবাদের আকার দেয়া সম্পাদনা পর্ষদ সব ক্ষেত্রেই আজ অবদান রেখে চলেছেন নারীরা। বরং সূক্ষ্ম মনোযোগ কিংবা বিচার বিশ্লেষণাত্মক অনেক জায়গায় নারীরা, টপকে যাচ্ছেন পুরুষ সহকর্মীর পেশাগত ধৈর্যকে। সেই খবরের উপস্থাপন পত্রপত্রিকার ছাপা হরফের চৌকাঠ থেকে যখন পা বাড়ায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বোকাবাক্সের আয়তাকার পরিমণ্ডলে সেখানে বাড়ে আরও একটা কর্মক্ষেত্র। খবর পরিবেশনে নারী, পুরুষের সমকক্ষ কিংবা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখে চলেছেন। বিশ্বের সব দেশ তো বটেই বাংলাদেশের মিডিয়া বিস্ফোরণের শুরু থেকে মুন্নি সাহা, শাহনাজ মুন্নি, সামিয়া জামানদের মতো নারী আজ সাংবাদিকতা আর সংবাদ পরিবেশনের চ্যালেঞ্জকে পরিণত করেছেন যুব সমাজের স্বপ্নাবিষ্ট কর্মক্ষেত্রে।

বিনোদন মিডিয়ার নাটক সিনেমার কথায় যদি আসি, আদৌ কি তা সম্ভব নারীর স্পর্শ ছাড়া? মধ্যযুগের আদর্শবাদীরা বলবেন, নারীরা চলবেন আবডালের ইশারায়। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, যে মধ্যযুগের আদর্শে এতটাই নিজেকে হারাচ্ছেন সেই যুগের সঙ্গে আজকের যুগের বাস্তবতার ফারাকটা কতটুকু। শিক্ষা কিংবা অপরাপর নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত নারীর সেই গৃহস্থালি দাসবৃত্তি থেকে নারীর জাগরণের উন্মেষের হাত ধরে এই বেরিয়ে আসাটা যখন সফলতার মুখ দেখেছে তখন সেই স্রোতের মুখে বাঁধ দেবে কার সাধ্য! হ্যাঁ, এটা সত্যি পশ্চিমা সিনেমা ইতিহাসের দেখাদেখি ভারত উপমহাদেশে সিনেমা নির্মাণের সময় পয়লা পয়লা নারীর উপস্থিতির বিষয়টা ছিল বড্ড আকাশ-কুসুম কল্পনা। যে কারণে যাত্রা থিয়েটারের আদলে পুরুষকেই রূপ নিতে হতো নারীর। শেষ অব্দি লজ্জাভাঙা নারী অন্বেষণে তখনকার সিনেমা মিডিয়া হাত পেতেছিল বাইজী বাড়ির নারীদের কাছে। কিন্তু আজকের দিনে এসে মিডিয়ার নারীদের বাইজী ভাবাটা যে কোনো পুরুষতন্ত্র পুজারীর অমার্জনীয় অপরাধ হবে সেটা মুক্তবুদ্ধির যে কেউই বলে দিতে পারবেন বিনা সংকোচে। আরে সিনেমার গল্প যদি হয় সমাজের বাস্তবতারই এক অবাস্তব পরিস্ফুটন, তবে সেখানে নারী থাকবে না কেন শুনি? আর এত বছরের হেসেলে বন্দি থাকা নারীরা জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে এখন শুধু শুধু রূপের ছটাতেই না, সিনেমা, টেলিভিশন কিংবা বিজ্ঞাপন শিল্পকে ঋদ্ধ করে চলেছেন তাদের সৃষ্টিশীল মনের নানা উপযোগিতার মাধ্যমে। নারী শুধু আজ চওড়া মেকআপের আড়ালে মুখস্থ সংলাপ আওড়ানো বার্বি ডল না। বরং ক্যামেরার পেছনে নির্দেশনা, আলোকপ্রক্ষেপণ, চিত্রনাট্য, শব্দগ্রহণ কিংবা প্রডাকশনের হাজারও ব্যবস্থাপনার কাজেও দিন দিন নারীর এগিয়ে আসা একঘেয়ে পুরুষতান্ত্রিকতায় এনে দিচ্ছে বৈচিত্র্য। বৈশ্বিক চিত্রের সঙ্গে তুলনায় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে নারীদের টেলিভিশন-সিনেমার নেপথ্য কারিগর হিসেবে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি এখনও সাংখ্যিক বিচারে কম হলেও দিন দিন এসব জায়গায় নারীর ভিড় বাড়ছে সেটা স্বীকার করবেন যে কেউ। আর তাতে বদলেও যাচ্ছে অনেক কিছু। ভেবে দেখুন তো একবার ভারতের দীপা মেহতা, মিরা নায়ার, অপর্ণা সেন কিংবা হালের ফারাহ খান অথবা জোয়া আখতারের মতো নারীর ছবিতে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন সমাজ বাস্তবতাকে, সেটা কি অনেকটাই আলাদা নয় প্রথাগত পুরুষের দৃষ্টির পৃথিবীর চেয়ে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী নির্মাতার তালিকাটা অনেকটা ছোট হয়তো কিন্তু নার্গিস আখতার, চয়নিকা চৌধুরী, শাহনেওয়াজ কাকলী, সামিয়া জামানের মতো অনেকেই ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ উপহার দেবেন।

হ্যাঁ, তবে চিরন্তন ‘মিডিয়াতে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন’-এর ফতোয়া দিয়ে যদি কেউ এই স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চান তবে দুটো কথা জেনে নেয়া আজকের বিশ্বে খুব জরুরি। নিশ্চয়ই নারীকে পুরুষের কামতাড়িত যৌনাকাঙ্ক্ষা নিবারণের ভোগ্যবস্তু হিসেবে সিনেমা-নাটকের পর্দায় উপস্থাপনটা নারীর মুক্তির ফল নয়। বরং সেখানে সৌন্দর্যের ভাঁওতাবাজিতে নারীকে সেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হতে। একটু সুস্থমস্তিষ্কে ভেবে দেখবেন কি, এই যে অসুস্থ একটি শিল্পধারার সামান্য একটা ফল্গুধারা, তার অস্তিত্বটা টিকে আছে কাদের হাত ধরে? সাময়িক বিত্তলোভে হয়তো কিছু নারী গা ভাসাচ্ছেন সেই স্রোতে উপায়ান্তর চিন্তা না করেই, কিন্তু সেই পুতুলনাচের কলকাঠিটা যাদের হাতে তাদের আদৌ কি কেউ নারী? একজন সৃষ্টিশীলা রমণীর অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস থেকে বলুন তো, টপ অ্যাঙ্গেলে একজন স্ফীতবক্ষা নারীর বক্ষখাঁজের কদর্য উপস্থাপনের নেপথ্যের দৃশ্যধারণকারী কিংবা নির্দেশনা কি চরমমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনারই ফল নয়?

সব মিলিয়ে অন্তত এতটুকু সত্যি আরোপিত উপায়ে নারীবিহীন মিডিয়ার স্বরূপ আজকের দিনে বসে হয়তো ভেবে ওঠাটাই দুষ্কর। যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিডিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে উদ্যমী নারীরাও এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। সামাজিকতার ধোঁয়াশা আর ধর্মীয় কুসংস্কারের নামে আজ জাগ্রত এই নারীসত্তাকে রুখবে কে?


 

সাবমিট

মিডিয়ায় নারীর সাফল্যগাথা

সামনে বিশ্ব নারী দিবস। এ দিবসকে নিয়ে তারা ঝিলমিলের আজকের এ আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মিডিয়ায় নারীদের অসামান্য অবদানকে সম্মান জানাতে আমাদের এ প্রচেষ্টা। লিখেছেন-
 পিয়াস রায় 
০৫ মার্চ ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর- কবি নজরুলের ভাষায়, নারীর এমন ক্ষমতায়নের আভাস মেলে বহু বছর আগেই। যদিওবা পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে নারীর সত্যিকার অর্থে মুক্ত হয়ে স্বীকৃতি লাভের বিষয়টি সব সময়ই পুরুষশাষিত সমাজব্যবস্থার কাছে ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ এই সত্যিকে না মেনেই বা উপায় কী। পৃথিবীর অর্ধেক এই জনগোষ্ঠীকে কেটে-ছেঁটে আদৌ কোনো কাজে কতটাই বা উন্মেষ সম্ভব?

আর কর্মযজ্ঞ যখন মিডিয়া তখন নারীর সেখানে উপস্থিতি আর সব ক্ষেত্রের চেয়েও অনেক বেশি আকাক্সিক্ষত। মিডিয়া, তা সে মিডিয়ার আদিতম রূপের সংবাদ অনুসন্ধান কিংবা উপস্থাপনই হোক। নতুবা হোক খবরের বাইরে এসে দর্শক চিত্তকে গান-নৃত্য কিংবা গল্প উপস্থাপনের উপযোগিতায় উপভোগ্য করে তোলা। ক্ষেত্র যাই হোক, নারী বিবর্জিত সেই মাধ্যমের কথাটা একটু ভেবে দেখবেন কি? কতটুকু নিষ্প্রভ হতে পারে তার রূপ! এক এক করে চলুন চোখ বুলাই এক একটা ক্ষেত্রের দিকে।

ভাবুন তো গান শুনছেন। একের পর এক গান গেয়ে চলছেন এক একজন পুরুষ শিল্পী। সুগায়ক অবশ্যই। কিন্তু ক্ষেত্রটিকে একবার নারী বিবর্জিত ভেবে দেখুন তো। যেখানে নেই উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোসলে থেকে অপরাপর কোনো নারীকণ্ঠি। দেশের পরিমণ্ডলে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা থেকে আজকের মিলা, কনা, ন্যান্সিরাও সেখানে পাচ্ছেন না প্রবেশাধিকার। কেমন হতে পারে সেই পুরুষতান্ত্রিক সঙ্গীত জগতের স্বরূপটা। নিশ্চয়ই বলবেন, সেটা কি আদতে ভেবে দেখা সম্ভব?

সম্ভব না অবশ্যই। মিডিয়ার সামগ্রিক রূপরেখায় নারীর সংযুক্তি আসলে তেমনি একটা অকাট্য প্রশ্ন। আজ কোথায় নেই নারী? সংবাদ প্রত্যাশী একজন মানুষের খবরের ক্ষুধা মেটাতে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে ছুটে বেড়ানো ডানপিঠে সাংবাদিক থেকে সেই সংগৃহীত সংবাদকে গ্রাহকের জন্য হজমযোগ্য সংবাদের আকার দেয়া সম্পাদনা পর্ষদ সব ক্ষেত্রেই আজ অবদান রেখে চলেছেন নারীরা। বরং সূক্ষ্ম মনোযোগ কিংবা বিচার বিশ্লেষণাত্মক অনেক জায়গায় নারীরা, টপকে যাচ্ছেন পুরুষ সহকর্মীর পেশাগত ধৈর্যকে। সেই খবরের উপস্থাপন পত্রপত্রিকার ছাপা হরফের চৌকাঠ থেকে যখন পা বাড়ায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বোকাবাক্সের আয়তাকার পরিমণ্ডলে সেখানে বাড়ে আরও একটা কর্মক্ষেত্র। খবর পরিবেশনে নারী, পুরুষের সমকক্ষ কিংবা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখে চলেছেন। বিশ্বের সব দেশ তো বটেই বাংলাদেশের মিডিয়া বিস্ফোরণের শুরু থেকে মুন্নি সাহা, শাহনাজ মুন্নি, সামিয়া জামানদের মতো নারী আজ সাংবাদিকতা আর সংবাদ পরিবেশনের চ্যালেঞ্জকে পরিণত করেছেন যুব সমাজের স্বপ্নাবিষ্ট কর্মক্ষেত্রে।

বিনোদন মিডিয়ার নাটক সিনেমার কথায় যদি আসি, আদৌ কি তা সম্ভব নারীর স্পর্শ ছাড়া? মধ্যযুগের আদর্শবাদীরা বলবেন, নারীরা চলবেন আবডালের ইশারায়। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, যে মধ্যযুগের আদর্শে এতটাই নিজেকে হারাচ্ছেন সেই যুগের সঙ্গে আজকের যুগের বাস্তবতার ফারাকটা কতটুকু। শিক্ষা কিংবা অপরাপর নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত নারীর সেই গৃহস্থালি দাসবৃত্তি থেকে নারীর জাগরণের উন্মেষের হাত ধরে এই বেরিয়ে আসাটা যখন সফলতার মুখ দেখেছে তখন সেই স্রোতের মুখে বাঁধ দেবে কার সাধ্য! হ্যাঁ, এটা সত্যি পশ্চিমা সিনেমা ইতিহাসের দেখাদেখি ভারত উপমহাদেশে সিনেমা নির্মাণের সময় পয়লা পয়লা নারীর উপস্থিতির বিষয়টা ছিল বড্ড আকাশ-কুসুম কল্পনা। যে কারণে যাত্রা থিয়েটারের আদলে পুরুষকেই রূপ নিতে হতো নারীর। শেষ অব্দি লজ্জাভাঙা নারী অন্বেষণে তখনকার সিনেমা মিডিয়া হাত পেতেছিল বাইজী বাড়ির নারীদের কাছে। কিন্তু আজকের দিনে এসে মিডিয়ার নারীদের বাইজী ভাবাটা যে কোনো পুরুষতন্ত্র পুজারীর অমার্জনীয় অপরাধ হবে সেটা মুক্তবুদ্ধির যে কেউই বলে দিতে পারবেন বিনা সংকোচে। আরে সিনেমার গল্প যদি হয় সমাজের বাস্তবতারই এক অবাস্তব পরিস্ফুটন, তবে সেখানে নারী থাকবে না কেন শুনি? আর এত বছরের হেসেলে বন্দি থাকা নারীরা জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে এখন শুধু শুধু রূপের ছটাতেই না, সিনেমা, টেলিভিশন কিংবা বিজ্ঞাপন শিল্পকে ঋদ্ধ করে চলেছেন তাদের সৃষ্টিশীল মনের নানা উপযোগিতার মাধ্যমে। নারী শুধু আজ চওড়া মেকআপের আড়ালে মুখস্থ সংলাপ আওড়ানো বার্বি ডল না। বরং ক্যামেরার পেছনে নির্দেশনা, আলোকপ্রক্ষেপণ, চিত্রনাট্য, শব্দগ্রহণ কিংবা প্রডাকশনের হাজারও ব্যবস্থাপনার কাজেও দিন দিন নারীর এগিয়ে আসা একঘেয়ে পুরুষতান্ত্রিকতায় এনে দিচ্ছে বৈচিত্র্য। বৈশ্বিক চিত্রের সঙ্গে তুলনায় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে নারীদের টেলিভিশন-সিনেমার নেপথ্য কারিগর হিসেবে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি এখনও সাংখ্যিক বিচারে কম হলেও দিন দিন এসব জায়গায় নারীর ভিড় বাড়ছে সেটা স্বীকার করবেন যে কেউ। আর তাতে বদলেও যাচ্ছে অনেক কিছু। ভেবে দেখুন তো একবার ভারতের দীপা মেহতা, মিরা নায়ার, অপর্ণা সেন কিংবা হালের ফারাহ খান অথবা জোয়া আখতারের মতো নারীর ছবিতে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন সমাজ বাস্তবতাকে, সেটা কি অনেকটাই আলাদা নয় প্রথাগত পুরুষের দৃষ্টির পৃথিবীর চেয়ে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী নির্মাতার তালিকাটা অনেকটা ছোট হয়তো কিন্তু নার্গিস আখতার, চয়নিকা চৌধুরী, শাহনেওয়াজ কাকলী, সামিয়া জামানের মতো অনেকেই ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ উপহার দেবেন।

হ্যাঁ, তবে চিরন্তন ‘মিডিয়াতে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন’-এর ফতোয়া দিয়ে যদি কেউ এই স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চান তবে দুটো কথা জেনে নেয়া আজকের বিশ্বে খুব জরুরি। নিশ্চয়ই নারীকে পুরুষের কামতাড়িত যৌনাকাঙ্ক্ষা নিবারণের ভোগ্যবস্তু হিসেবে সিনেমা-নাটকের পর্দায় উপস্থাপনটা নারীর মুক্তির ফল নয়। বরং সেখানে সৌন্দর্যের ভাঁওতাবাজিতে নারীকে সেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হতে। একটু সুস্থমস্তিষ্কে ভেবে দেখবেন কি, এই যে অসুস্থ একটি শিল্পধারার সামান্য একটা ফল্গুধারা, তার অস্তিত্বটা টিকে আছে কাদের হাত ধরে? সাময়িক বিত্তলোভে হয়তো কিছু নারী গা ভাসাচ্ছেন সেই স্রোতে উপায়ান্তর চিন্তা না করেই, কিন্তু সেই পুতুলনাচের কলকাঠিটা যাদের হাতে তাদের আদৌ কি কেউ নারী? একজন সৃষ্টিশীলা রমণীর অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস থেকে বলুন তো, টপ অ্যাঙ্গেলে একজন স্ফীতবক্ষা নারীর বক্ষখাঁজের কদর্য উপস্থাপনের নেপথ্যের দৃশ্যধারণকারী কিংবা নির্দেশনা কি চরমমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনারই ফল নয়?

সব মিলিয়ে অন্তত এতটুকু সত্যি আরোপিত উপায়ে নারীবিহীন মিডিয়ার স্বরূপ আজকের দিনে বসে হয়তো ভেবে ওঠাটাই দুষ্কর। যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিডিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে উদ্যমী নারীরাও এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। সামাজিকতার ধোঁয়াশা আর ধর্মীয় কুসংস্কারের নামে আজ জাগ্রত এই নারীসত্তাকে রুখবে কে?


 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র