jugantor
নেপাল এগিয়ে যাবে

  ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক  

১৬ মে ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

গত ২৫ এপ্রিল নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি হয়েছে তার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। নেপাল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ওখানে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা এবং এ ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল ৮০ বছর আগে ১৯৩৪ সালে, যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। নেপালে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হলেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটল প্রায় এক শতাব্দী পর। বিগত দিনে যেভাবে নেপালের জনগণ বড় বড় ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে, এ দুর্যোগও তেমনভাবে মোকাবেলা করবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক, আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের সমান এ রাষ্ট্রটি নানা কারণে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। শক্তি-সংঘাতে বিপর্যয় হয়, আবার এ সংঘাতই নতুনের সৃষ্টি করে। মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করলে তা-ই দেখা যায়। বিগব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় চৌদ্দশ’ কোটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। নক্ষত্ররাজি, গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। আমাদের সূর্য-পৃথিবীসহ গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণন ও মহাশক্তির কারণে প্রায় পাঁচশ’ কোটি বছর আগে।

জড় জগৎ ও জীবজগৎ নিয়েই আমাদের পৃথিবী। কোটি কোটি বছরের বিকাশের মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান পর্যায়ে এসেছি। ভারতীয় উপমহাদেশের হিমালয় পর্বতমালা, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর জীবন প্রবাহকে সচল রাখতে এবং অগ্রগতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। হিমালয় পর্বত শক্তির সংঘাতের ফলে এক কোটি বছর আগে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এর বরফ এবং বরফ গলা পানি আমাদের নদ-নদীকে সচল রেখেছে, যা ১০ লাখ বছর আগে এ অবস্থায় এসেছে বলে অনেকের ধারণা। হিমালয়ের কারণেই একদিকে যেমন নদ-নদী সচল রয়েছে, অন্যদিকে মেরু অঞ্চলের হিমবাহের শৈত্য থেকে এ অঞ্চল রক্ষা পাচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালা এবং তার প্রভাব নেপাল এবং এ অঞ্চলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে এবং পাশাপাশি ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সংঘাত এবং অন্যান্য কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগও হচ্ছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নেপালকে হিমালয়ের দুহিতা বলা হয়। হিমালয়ের দুহিতা নেপালের এ বিপর্যয়ে তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে প্রায় আশি লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার বছরের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো এবং কয়েকশ’ বছরের ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, ২০ হাজার লোক আহত হয়েছে, ৩ লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত, ১৬ হাজার স্কুল ধ্বংস, ২৮ লাখ লোক গৃহহীন এবং ৮০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ভূ-জরিপ সংস্থা বলছে, ক্ষতির পরিমাণ একশ’ থেকে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে হতাহত লোকদের উদ্ধার, পুনর্বাসন ও সাহায্যের কাজ চলছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশসহ সার্কের দেশগুলো সাহায্য পাঠিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া সাহায্য দিয়েছে। ভারত শুরু থেকেই সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী পাঠাচ্ছে ও বিতরণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হেলিকপ্টার দিয়ে সাহায্য বিতরণ করছে। এরই মধ্যে নেপালের প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থা সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে সমন্বয়ের পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

নেপালের জনগণের রয়েছে দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নেপালের ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলো বিশ্ব সভ্যতার অংশ। এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার এগিয়ে আসা উচিত। এরই মধ্যে অনেক দেশ ও সংস্থা সাহায্যের প্রতিশ্র“তি ঘোষণা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এরই মধ্যে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে বারবার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। আমরা আশা করব, বিশ্ববাসী এগিয়ে আসবে এবং নেপাল এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং পুনর্বাসন, পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা করে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে।

বাংলাদেশও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। তাই পরিকল্পনা, নির্মাণ ও বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলা করে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।

ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নেপালে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত






 

সাবমিট

নেপাল এগিয়ে যাবে

 ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক 
১৬ মে ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 

গত ২৫ এপ্রিল নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি হয়েছে তার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। নেপাল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ওখানে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা এবং এ ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল ৮০ বছর আগে ১৯৩৪ সালে, যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। নেপালে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হলেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটল প্রায় এক শতাব্দী পর। বিগত দিনে যেভাবে নেপালের জনগণ বড় বড় ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে, এ দুর্যোগও তেমনভাবে মোকাবেলা করবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক, আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের সমান এ রাষ্ট্রটি নানা কারণে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। শক্তি-সংঘাতে বিপর্যয় হয়, আবার এ সংঘাতই নতুনের সৃষ্টি করে। মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করলে তা-ই দেখা যায়। বিগব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় চৌদ্দশ’ কোটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। নক্ষত্ররাজি, গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। আমাদের সূর্য-পৃথিবীসহ গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণন ও মহাশক্তির কারণে প্রায় পাঁচশ’ কোটি বছর আগে।

জড় জগৎ ও জীবজগৎ নিয়েই আমাদের পৃথিবী। কোটি কোটি বছরের বিকাশের মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান পর্যায়ে এসেছি। ভারতীয় উপমহাদেশের হিমালয় পর্বতমালা, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর জীবন প্রবাহকে সচল রাখতে এবং অগ্রগতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। হিমালয় পর্বত শক্তির সংঘাতের ফলে এক কোটি বছর আগে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এর বরফ এবং বরফ গলা পানি আমাদের নদ-নদীকে সচল রেখেছে, যা ১০ লাখ বছর আগে এ অবস্থায় এসেছে বলে অনেকের ধারণা। হিমালয়ের কারণেই একদিকে যেমন নদ-নদী সচল রয়েছে, অন্যদিকে মেরু অঞ্চলের হিমবাহের শৈত্য থেকে এ অঞ্চল রক্ষা পাচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালা এবং তার প্রভাব নেপাল এবং এ অঞ্চলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে এবং পাশাপাশি ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সংঘাত এবং অন্যান্য কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগও হচ্ছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নেপালকে হিমালয়ের দুহিতা বলা হয়। হিমালয়ের দুহিতা নেপালের এ বিপর্যয়ে তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে প্রায় আশি লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার বছরের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো এবং কয়েকশ’ বছরের ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, ২০ হাজার লোক আহত হয়েছে, ৩ লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত, ১৬ হাজার স্কুল ধ্বংস, ২৮ লাখ লোক গৃহহীন এবং ৮০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ভূ-জরিপ সংস্থা বলছে, ক্ষতির পরিমাণ একশ’ থেকে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে হতাহত লোকদের উদ্ধার, পুনর্বাসন ও সাহায্যের কাজ চলছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশসহ সার্কের দেশগুলো সাহায্য পাঠিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া সাহায্য দিয়েছে। ভারত শুরু থেকেই সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী পাঠাচ্ছে ও বিতরণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হেলিকপ্টার দিয়ে সাহায্য বিতরণ করছে। এরই মধ্যে নেপালের প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থা সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে সমন্বয়ের পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

নেপালের জনগণের রয়েছে দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নেপালের ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলো বিশ্ব সভ্যতার অংশ। এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার এগিয়ে আসা উচিত। এরই মধ্যে অনেক দেশ ও সংস্থা সাহায্যের প্রতিশ্র“তি ঘোষণা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এরই মধ্যে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে বারবার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। আমরা আশা করব, বিশ্ববাসী এগিয়ে আসবে এবং নেপাল এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং পুনর্বাসন, পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা করে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করবে।

বাংলাদেশও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। তাই পরিকল্পনা, নির্মাণ ও বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলা করে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।

ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নেপালে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত






 

 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র