jugantor
দেশপ্রেমের চশমা
জাতি দুর্নীতির ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত

  মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার  

০৯ ডিসেম্বর ২০১৫, ০০:০০:০০  | 

আজ ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতিবিরোধী দিবসে বিশ্বের ও বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। এ ভাবনার আগে বলে নেয়া দরকার যে, দুর্নীতি হল একটি নিরাময়যোগ্য সামাজিক ব্যাধি যা সুপরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দুর্নীতি হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হলে এবং সে প্রচেষ্টায় নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতা থাকলে দুর্নীতি গুটি বসন্তের মতো নির্মূল করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলোকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনকালে দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুর্নীতি দমনের কথা ভুলে যান এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশকে এ রকম দেশের তালিকাভুক্ত করলে মোটেও ভুল করা হবে না।

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টা কার্যকর হয় না। এসব দেশের সরকারকে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে এ রকম সরকার প্রশাসকদের দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। এ কারণে এসব দেশে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের শাস্তির কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও সেক্রেটারি বা বড় প্রশাসনিক আমলাদের দুর্নীতির শাস্তির নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা নির্বাচনের আগে ও পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিলেও তাদের সে বক্তব্যে আন্তরিকতা থাকে না। লক্ষণীয়, সরকারি নেতাদের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে দুর্নীতি গবেষকদের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা ও মন্ত্রীরা প্রায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ, জিরো টলারেন্স নীতি, দুর্নীতি নির্মূল, দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দেন। কিন্তু দুর্নীতি গবেষকদের এ ক্ষেত্রের বক্তব্যের ভাষা হয় ভিন্নরকম। তারা দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে চান। দুর্নীতিকে দমন করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা না করে এ সামাজিক ব্যাধি হ্রাসে সুপরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান। এ প্রসঙ্গে আরও লক্ষণীয়, যেসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে যত বেশি দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য আসে, সেসব দেশে দুর্নীতির তত বেশি চর্চা হয় এবং দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে ততই বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতির দিকে তাকালে আমরা এমন চিত্রের প্রতিফলন লক্ষ্য করি।

বাংলাদেশে আমরা সামাজিকভাবে সবাই মিলে এক দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলেছি। এখানে আমরা প্রায় সবাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এ দেশে দুর্নীতিমুক্তভাবে থাকা বড়ই কষ্টসাধ্য কাজ। আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই দুর্নীতি। থানা, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স অফিসে দুর্নীতি। শিক্ষা বিভাগও এখন দুর্নীতির ভাইরাসে আক্রান্ত। চাকরি পেতে হলে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতা দিয়ে কাজ হচ্ছে না। গড়তে হচ্ছে অবৈধ যোগাযোগ এবং করতে হচ্ছে আর্থিক লেনদেন। ছোট ছোট চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কোর্ট-কাছারিতে আজ দুর্নীতির মহামারী। বিরক্ত হয়ে শহরের এই দুর্নীতির চক্র থেকে মুক্ত হয়ে কিছুদিন গ্রামের মুক্ত বাতাসে ঘুরতে চান? সে লক্ষ্যে ট্রেনে টিকিট কাটতে গেলেও আপনাকে কালোবাজারিকে দিতে হবে কিছু ঘুষ। না হলে সময় মতো ট্রেনের টিকিট পাবেন না। এ পরিবেশে অবৈধ অর্থ দিয়ে সামাজিক মর্যাদা ক্রয় করে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করা যায়। এ কারণে মসজিদের উন্নয়ন কাজে কয়েক লাখ টাকা সাহায্য করতে চাইলে ইমাম সাহেব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদত্ত অর্থের বর্ণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করে দানকারীর জন্য দোয়া করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সৎ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারের পরিবর্তে বিত্তশালী বড় আমলা দাওয়াত পান। সরকারও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে প্রতিবছর বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নীতি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন আর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ নয়। এ সামাজিক ভাইরাস এখন সমাজের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় শাখা বিস্তার করেছে। আক্রমণ করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রকেও। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ২০০৯ সালে সাবরেজিস্ট্রার, সেবিকা বা পলিটিক্যাল ইনফরমার হিসেবে চাকরিপ্রাপ্তদের ১৯৭১ সালে বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম। দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছলে জন্মগ্রহণ করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায় তার ব্যাখ্যা কেবল ওইসব চাকরিপ্রাপ্ত শিশু মুক্তিযোদ্ধারাই দিতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশী-বিদেশী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি রুপা নির্মিত ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করার মহান কাজটিকেও এ দেশের দুর্নীতিবাজরা কলংকিত করেছে। সোনা-রুপার পরিবর্তে দস্তা, তামা, পিতলের ক্রেস্ট বানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে ওই নকল ক্রেস্ট সম্মানিত অতিথিদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতির প্রতি কত বেশি সহনশীল হলে এমন দুর্নীতিবাজদেরও শাস্তি না দিয়ে পারেন তা বুঝতে দুর্নীতি গবেষক হওয়া লাগে না। এ দুর্নীতি অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে যথেষ্ট তথ্য পাওয়ার পরও দুদক ক্রেস্ট জালিয়াতির অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যে মন্ত্রণালয়ে এ দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, সে মন্ত্রণালয়ই হয়তো ওই দুর্নীতির দায়সারা অনুসন্ধান করবে।

পুলিশের দুর্নীতির বিচার পুলিশের ওপর, র‌্যাবের দুর্নীতির ভার র‌্যাবের ওপর অর্পণ করে দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার একটি প্রবণতা রাজনীতিকদের মধ্যে বেশ লক্ষণীয়। সে সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতাদের দুর্নীতির কোনোরকম সন্ধান পেলে সেসব দুর্নীতি বেশ জোরালোভাবে বিচার করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। এ জন্য সরকারের দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সরকার দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করতে মোটেও দ্বিধা করে না। এ জন্যই আর্থিক ক্ষেত্রে সংঘটিত মহাজোট আমলের দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারের লুটপাট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লা গ্র“পসহ বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার করা সম্ভব হয়নি। এসব দেখে এ সমাজের দুর্নীতিবাজরা বেশ প্রশ্রয় পাচ্ছে এবং দুর্নীতি করে আরও বেশি অবৈধ টাকা উপার্জন করে সরকার ঘোষিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গ্রহণ করে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করছে।

দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতিতে। সরকারের সঙ্গে সখ্য আছে এমন বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ছাড় দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের ছোট ছোট দুর্নীতিকে বড় করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের দুর্নীতিকে না দেখার ভান করে বিরোধীদলীয় নেতাদের দুর্নীতি বড় করে দেখার প্রবণতা সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমনকারী সংস্থার কাছে বেশ প্রিয় একটি কাজ। যে ফখরুদ্দীন সরকার সংবিধান লংঘন করে ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের দুই বড় নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নাজেহাল করল, তাদের একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে খাবারের সঙ্গে ধীর গতির বিষ প্রয়োগ করে এবং আরেকজনকে ঘুম পাড়ানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে নির্যাতন করল, সে সংবিধান লংঘনকারীদের আজও বিচারের আওতায় আনা হয়নি। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, সে নির্বাচনী ব্যবস্থা আজ দুর্নীতির ভারে জর্জরিত। প্রতিটি নির্বাচনেই আজ দুর্নীতি-কারচুপি এবং সন্ত্রাস-সহিংসতা হচ্ছে। ভোটের আগের রাতেই অনেক ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে আয়ত্তে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরে কিছু ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হচ্ছে। ভোটের দিন সরকারদলীয় কর্মী-ক্যাডাররা বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে নিজ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিচ্ছেন। দুর্নীতি অনেক দেশের নির্বাচনেই হয়। কিন্তু অন্য দেশে নির্বাচনে যারা দুর্নীতি করে তাদের বিচার করা হয়, শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনে দুর্নীতিকারীদের কোনো বিচার বা শাস্তি হতে দেখা যায় না। ফলে এক নির্বাচনে যারা দুর্নীতি করে, শাস্তি না হওয়ায় পরের নির্বাচনে তারা উৎসাহ পেয়ে আরও অধিক দুর্নীতি করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন, পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং তিন সিটি নির্বাচনে যারা ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি করে, তাদের প্রায় কাউকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয়নি। ফলে এ দুর্নীতিবাজরা যে পরোক্ষ উৎসাহ পেয়ে পরের নির্বাচনে অধিকতর দুর্নীতি-কারচুপিতে নিমজ্জিত হবে তা আগেই বলে দেয়া যায়।

বাংলাদেশে যারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চান তারা সমাজের ও দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি দেখে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সৎ থাকার চেষ্টা করেও এ দেশে সৎ থাকা যাচ্ছে না। রাজনীতি ও প্রশাসনে যারা সৎ থাকার চেষ্টা করছেন তারা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। একা হয়ে পড়ছেন। কারণ, চারদিকে আজ দুর্নীতিবাজদেরই জয়জয়কার। কালো টাকা তাদের সামাজিকভাবে ভালো রাখছে। সমাজের বুদ্ধিজীবীরাও হয়ে পড়েছেন বিবেকবর্জিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র দেশ। এর মধ্যে অনেক কষ্ট করে যে দু’চারজন সৎ মানুষ আছেন, প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা আর ভালো থাকতে পারবেন কি-না। দুর্নীতিবাজদের চাপে তারাও একপর্যায়ে দুর্নীতি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যদি দুর্নীতির স্রোতে গা ভাসান, তাহলে সমগ্র দেশটি দুর্নীতির এক নরকরাজ্যে পরিণত হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সততা ও গণতন্ত্রের পথে এসে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি মোকাবেলায় না নামলে এ পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com



সাবমিট
দেশপ্রেমের চশমা

জাতি দুর্নীতির ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত

 মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার 
০৯ ডিসেম্বর ২০১৫, ১২:০০ এএম  | 
আজ ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতিবিরোধী দিবসে বিশ্বের ও বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। এ ভাবনার আগে বলে নেয়া দরকার যে, দুর্নীতি হল একটি নিরাময়যোগ্য সামাজিক ব্যাধি যা সুপরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দুর্নীতি হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হলে এবং সে প্রচেষ্টায় নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতা থাকলে দুর্নীতি গুটি বসন্তের মতো নির্মূল করা সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলোকে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনকালে দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুর্নীতি দমনের কথা ভুলে যান এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশকে এ রকম দেশের তালিকাভুক্ত করলে মোটেও ভুল করা হবে না।

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টা কার্যকর হয় না। এসব দেশের সরকারকে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করতে দেখা যায়। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে এ রকম সরকার প্রশাসকদের দুর্নীতি দমনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। এ কারণে এসব দেশে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের শাস্তির কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও সেক্রেটারি বা বড় প্রশাসনিক আমলাদের দুর্নীতির শাস্তির নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা নির্বাচনের আগে ও পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিলেও তাদের সে বক্তব্যে আন্তরিকতা থাকে না। লক্ষণীয়, সরকারি নেতাদের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে দুর্নীতি গবেষকদের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা ও মন্ত্রীরা প্রায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ, জিরো টলারেন্স নীতি, দুর্নীতি নির্মূল, দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দেন। কিন্তু দুর্নীতি গবেষকদের এ ক্ষেত্রের বক্তব্যের ভাষা হয় ভিন্নরকম। তারা দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে চান। দুর্নীতিকে দমন করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা না করে এ সামাজিক ব্যাধি হ্রাসে সুপরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান। এ প্রসঙ্গে আরও লক্ষণীয়, যেসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে যত বেশি দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য আসে, সেসব দেশে দুর্নীতির তত বেশি চর্চা হয় এবং দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে ততই বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতির দিকে তাকালে আমরা এমন চিত্রের প্রতিফলন লক্ষ্য করি।

বাংলাদেশে আমরা সামাজিকভাবে সবাই মিলে এক দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলেছি। এখানে আমরা প্রায় সবাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এ দেশে দুর্নীতিমুক্তভাবে থাকা বড়ই কষ্টসাধ্য কাজ। আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই দুর্নীতি। থানা, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স অফিসে দুর্নীতি। শিক্ষা বিভাগও এখন দুর্নীতির ভাইরাসে আক্রান্ত। চাকরি পেতে হলে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতা দিয়ে কাজ হচ্ছে না। গড়তে হচ্ছে অবৈধ যোগাযোগ এবং করতে হচ্ছে আর্থিক লেনদেন। ছোট ছোট চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কোর্ট-কাছারিতে আজ দুর্নীতির মহামারী। বিরক্ত হয়ে শহরের এই দুর্নীতির চক্র থেকে মুক্ত হয়ে কিছুদিন গ্রামের মুক্ত বাতাসে ঘুরতে চান? সে লক্ষ্যে ট্রেনে টিকিট কাটতে গেলেও আপনাকে কালোবাজারিকে দিতে হবে কিছু ঘুষ। না হলে সময় মতো ট্রেনের টিকিট পাবেন না। এ পরিবেশে অবৈধ অর্থ দিয়ে সামাজিক মর্যাদা ক্রয় করে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করা যায়। এ কারণে মসজিদের উন্নয়ন কাজে কয়েক লাখ টাকা সাহায্য করতে চাইলে ইমাম সাহেব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদত্ত অর্থের বর্ণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করে দানকারীর জন্য দোয়া করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সৎ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারের পরিবর্তে বিত্তশালী বড় আমলা দাওয়াত পান। সরকারও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে প্রতিবছর বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নীতি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন আর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ নয়। এ সামাজিক ভাইরাস এখন সমাজের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় শাখা বিস্তার করেছে। আক্রমণ করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রকেও। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ২০০৯ সালে সাবরেজিস্ট্রার, সেবিকা বা পলিটিক্যাল ইনফরমার হিসেবে চাকরিপ্রাপ্তদের ১৯৭১ সালে বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম। দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছলে জন্মগ্রহণ করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায় তার ব্যাখ্যা কেবল ওইসব চাকরিপ্রাপ্ত শিশু মুক্তিযোদ্ধারাই দিতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী দেশী-বিদেশী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি রুপা নির্মিত ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করার মহান কাজটিকেও এ দেশের দুর্নীতিবাজরা কলংকিত করেছে। সোনা-রুপার পরিবর্তে দস্তা, তামা, পিতলের ক্রেস্ট বানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে ওই নকল ক্রেস্ট সম্মানিত অতিথিদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতির প্রতি কত বেশি সহনশীল হলে এমন দুর্নীতিবাজদেরও শাস্তি না দিয়ে পারেন তা বুঝতে দুর্নীতি গবেষক হওয়া লাগে না। এ দুর্নীতি অনুসন্ধানে কাজ শুরু করে যথেষ্ট তথ্য পাওয়ার পরও দুদক ক্রেস্ট জালিয়াতির অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যে মন্ত্রণালয়ে এ দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, সে মন্ত্রণালয়ই হয়তো ওই দুর্নীতির দায়সারা অনুসন্ধান করবে।

পুলিশের দুর্নীতির বিচার পুলিশের ওপর, র‌্যাবের দুর্নীতির ভার র‌্যাবের ওপর অর্পণ করে দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার একটি প্রবণতা রাজনীতিকদের মধ্যে বেশ লক্ষণীয়। সে সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতাদের দুর্নীতির কোনোরকম সন্ধান পেলে সেসব দুর্নীতি বেশ জোরালোভাবে বিচার করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। এ জন্য সরকারের দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সরকার দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করতে মোটেও দ্বিধা করে না। এ জন্যই আর্থিক ক্ষেত্রে সংঘটিত মহাজোট আমলের দুর্নীতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারের লুটপাট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লা গ্র“পসহ বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার করা সম্ভব হয়নি। এসব দেখে এ সমাজের দুর্নীতিবাজরা বেশ প্রশ্রয় পাচ্ছে এবং দুর্নীতি করে আরও বেশি অবৈধ টাকা উপার্জন করে সরকার ঘোষিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গ্রহণ করে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করছে।

দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতিতে। সরকারের সঙ্গে সখ্য আছে এমন বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ছাড় দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের ছোট ছোট দুর্নীতিকে বড় করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের দুর্নীতিকে না দেখার ভান করে বিরোধীদলীয় নেতাদের দুর্নীতি বড় করে দেখার প্রবণতা সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমনকারী সংস্থার কাছে বেশ প্রিয় একটি কাজ। যে ফখরুদ্দীন সরকার সংবিধান লংঘন করে ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের দুই বড় নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নাজেহাল করল, তাদের একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে খাবারের সঙ্গে ধীর গতির বিষ প্রয়োগ করে এবং আরেকজনকে ঘুম পাড়ানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে নির্যাতন করল, সে সংবিধান লংঘনকারীদের আজও বিচারের আওতায় আনা হয়নি। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, সে নির্বাচনী ব্যবস্থা আজ দুর্নীতির ভারে জর্জরিত। প্রতিটি নির্বাচনেই আজ দুর্নীতি-কারচুপি এবং সন্ত্রাস-সহিংসতা হচ্ছে। ভোটের আগের রাতেই অনেক ভোট কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে আয়ত্তে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরে কিছু ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হচ্ছে। ভোটের দিন সরকারদলীয় কর্মী-ক্যাডাররা বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে নিজ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিচ্ছেন। দুর্নীতি অনেক দেশের নির্বাচনেই হয়। কিন্তু অন্য দেশে নির্বাচনে যারা দুর্নীতি করে তাদের বিচার করা হয়, শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনে দুর্নীতিকারীদের কোনো বিচার বা শাস্তি হতে দেখা যায় না। ফলে এক নির্বাচনে যারা দুর্নীতি করে, শাস্তি না হওয়ায় পরের নির্বাচনে তারা উৎসাহ পেয়ে আরও অধিক দুর্নীতি করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন, পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং তিন সিটি নির্বাচনে যারা ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি করে, তাদের প্রায় কাউকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয়নি। ফলে এ দুর্নীতিবাজরা যে পরোক্ষ উৎসাহ পেয়ে পরের নির্বাচনে অধিকতর দুর্নীতি-কারচুপিতে নিমজ্জিত হবে তা আগেই বলে দেয়া যায়।

বাংলাদেশে যারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চান তারা সমাজের ও দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি দেখে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সৎ থাকার চেষ্টা করেও এ দেশে সৎ থাকা যাচ্ছে না। রাজনীতি ও প্রশাসনে যারা সৎ থাকার চেষ্টা করছেন তারা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। একা হয়ে পড়ছেন। কারণ, চারদিকে আজ দুর্নীতিবাজদেরই জয়জয়কার। কালো টাকা তাদের সামাজিকভাবে ভালো রাখছে। সমাজের বুদ্ধিজীবীরাও হয়ে পড়েছেন বিবেকবর্জিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ। দুর্নীতির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সমগ্র দেশ। এর মধ্যে অনেক কষ্ট করে যে দু’চারজন সৎ মানুষ আছেন, প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা আর ভালো থাকতে পারবেন কি-না। দুর্নীতিবাজদের চাপে তারাও একপর্যায়ে দুর্নীতি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যদি দুর্নীতির স্রোতে গা ভাসান, তাহলে সমগ্র দেশটি দুর্নীতির এক নরকরাজ্যে পরিণত হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সততা ও গণতন্ত্রের পথে এসে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি মোকাবেলায় না নামলে এ পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com



 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র