Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নির্বাচনের নাটাই কার হাতে?

Icon

সাঈদ খান

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনের নাটাই কার হাতে?

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের কথা মনে আছে? ২০১০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তারা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ১৯৬৬-২০১০ সময়কার আড়াই লাখেরও বেশি মার্কিন গোপন নথি প্রকাশ করে। এসব নথিতে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, ইয়েমেনে গোপন ড্রোন হামলা, সৌদি রাজপরিবারের ইরানে হামলার আহ্বান এবং রাশিয়াকে ‘মাফিয়া রাষ্ট্র’ হিসাবে উল্লেখ করার তথ্য প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে উইকিলিকস ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ই-মেইল ফাঁস করে, যা মার্কিন নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলে।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বিশ্বরাজনীতির গোপন যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও দ্বিচারী চরিত্র উন্মোচনে নির্ভীক ভূমিকা রাখেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে সাহসী অবস্থানের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হন।

যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই নানা দেশের রাজনীতিতে নাক গলায়, কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দীর্ঘকাল ধরে কতিপয় নেতা মার্কিনিদের মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন এবং আছেন। তবে তাদের পরিচয় স্পষ্টভাবে সামনে আসে উইকিলিকসের নথি ফাঁসের পর। আমরা প্রচারমাধ্যমে রাজনীতিকদের যেসব মুখ দেখি, তা তাদের আসল রূপ নয়; মুখোশ পরে জনগণের সামনে আসেন তারা। সভা-সমাবেশে দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের অঙ্গীকার ও জনদরদের কথা বললেও, বাস্তবে তাদের অবস্থান ভিন্ন। এ দুর্বলতার সুযোগ নেয় সামরিক বাহিনীর একাংশ, যাদের সহায়তা করে কিছু শিক্ষাবিদ, এনজিওকর্তা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। তারা ১/১১-এর সময় দুই নেত্রীকেই ‘মাইনাস’ করে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে-ভয় দেখানো, সুবিধার প্রলোভন দেখানো এবং বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তখন দুই বড় দলের অনেক পরিচিত নেতাও এ ষড়যন্ত্রে অংশ নেন, যার বিশদ বিবরণ উইকিলিকসের তথ্য থেকে জানা যায়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের জরুরি অবস্থার সরকার ‘কিংস পার্টি’ গঠনের যে পরিকল্পনা করেছিল, তা ছিল গণতন্ত্রবিরোধী এক জঘন্য নীলনকশা। তবে নেতাদের রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে নয়, বরং গণতন্ত্রকামী জনগণের দৃঢ় সচেতনতার ফলেই সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়, এমনকি সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিতেও যুক্তরাষ্ট্র বিলম্ব করে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং খন্দকার মোশতাকের সরকার গঠনে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তার পাশে থাকে। ২০২৫ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, আরাকান আর্মি ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ায় এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘মানবিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগ রক্ষায়, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ মোকাবিলায় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে কৌশলগত অংশীদার করতে চায়। গত তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং এ সময় বাংলাদেশের কিছু স্থানে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’, ‘ট্রেনিং বেস’ অথবা ‘রিফুয়েলিং স্টেশন’ নির্মাণের আগ্রহের কথা বলেছিল। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা কক্সবাজারের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল ‘কৌশলগত প্রবেশপথ’ তৈরি করার বিষয়ে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক (বড় বড় প্রকল্পে) বাড়ার পর বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রস্তাবকে অপ্রকাশ্যে বা নরমভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলগত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি শক্তির বিশেষ কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়া বর্তমানে এক সংকটময় সময়ে রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক শক্তির চাপের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ওপর নির্ভর করবে, যেমন-গণতন্ত্র, জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এ কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।

গত ২৩ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ সময় ধরে শরণার্থী হিসাবে অবস্থান তাদের মধ্যে হতাশা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়াচ্ছে। দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। মিয়ানমারের জাতিগত নিধন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের প্রক্রিয়া সমর্থন করে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাতার ও ওআইসির ভূমিকা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানান ড. ইউনূস। ১৫ মার্চ তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ইফতার করেন। ওই সময় জাতিসংঘের মহাসচিব এখানে একটি আন্তর্জাতিক হিউম্যানিটারিয়ান করিডরের কথা বলেছিলেন। ১৬ ও ১৭ এপ্রিল ইউনিফর্মড ও অস্ত্রধারী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সার্বভৌম সীমা লঙ্ঘন করে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের রেমাক্রি মুখ এলাকায় (প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে) অনুপ্রবেশ করে। সেখানে তারা স্থানীয় উপজাতিদের নিয়ে জলকেলি উৎসব আয়োজন করে। উৎসবের সচিত্র ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়। এ আয়োজনে আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউএলএ এবং স্থানীয় জনগণও অংশ নেয়।

জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অনেক কিছু আমার পছন্দ নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তারা আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশের ঘটনায় যে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে, তার জন্য আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। অন্যদিকে, বামদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ গুরুতর বিষয়ে কোনো নিন্দা বা প্রতিবাদ জানায়নি, যা দেখে হতবাক হয়েছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে-এক্ষেত্রেও কোনো আপসের সুযোগ নেই।

মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের গুরুতর হুমকি। বিজিবির উপস্থিতি সত্ত্বেও কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিতার ইঙ্গিত দেয়। আরাকান আর্মির সশস্ত্র উপস্থিতি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ স্পষ্টভাবে একটি ছায়া-রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা হতে পারে। এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত চ্যালেঞ্জ কিনা, তা ভেবে দেখা অতীব প্রয়োজন। এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কা বাড়তে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি স্পষ্ট অবস্থান দেখা যাচ্ছে-একটি পক্ষ দ্রুত নির্বাচন চায়, অপরপক্ষ মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন চায়। তারেক রহমান সতর্ক করেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে সংকট আরও গভীর হবে। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এখনো নির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়নি। তবে তিনি আগামী ঈদের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে, তবে পারস্পরিক আস্থার সংকট ও দ্বন্দ্ব বাড়ছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্যের অভাব স্পষ্ট। অন্যদিকে, সরকারি সহযোগিতায় গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা নির্বাচন নিয়ে নানা বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে চলেছেন।

গণতন্ত্রে জনগণই সংস্কারের মূল কারিগর, কারণ তারা ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করে, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের শক্তি ব্যবহার করে শাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনে এবং প্রয়োজন হলে আন্দোলন গড়ে তোলে। ফ্যাসিস্ট, দুর্নীতিবাজ, স্বৈরতন্ত্র ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সক্রিয় প্রতিরোধই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে, কোনো বিদেশি শক্তি নয়, জনগণই গণতন্ত্র রক্ষা ও নির্মাণের মূল কারিগর।

ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাড়ে পনেরো বছরের দীর্ঘ লড়াই-যেখানে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ, অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিবাদ এবং ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে হাজারও প্রাণের বিসর্জন-এসব কি বৃথা যাবে? না, কখনোই বৃথা যাবে না। আমরা তা হতে দেব না। এখন, নির্বাচনের নাটাই যাদের হাতেই থাকুক, শেষ পর্যন্ত শহিদদের রক্তের শপথ নিয়ে এ দেশের ছাত্র-জনতা ও সব দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবেই।

সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম