Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দৃষ্টিপাত

শিক্ষার্থীদের এখন ক্লাসরুমে ফিরে যেতে হবে

Icon

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার্থীদের এখন ক্লাসরুমে ফিরে যেতে হবে

গত বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার সফল আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট জুলুমবাজ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের নিকৃষ্টতম শাসনের অবসান ঘটায় বর্তমানে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ৮ আগস্ট।

বর্তমান সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা। এর আগে এমন কিছু সংস্কারকার্য সম্পন্ন করতে হবে, যেন আগামীতে যারা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করবেন, তারা আর কখনোই জনগণের প্রত্যাশাকে ভূলুণ্ঠিত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে না পারেন। কারণ জনগণ বারবার প্রতারিত হতে চায় না।

তারা বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ও মানবকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। যে কোনো সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য স্বস্তিদায়ক ও অনুকূল পরিবেশ দরকার হয়। অনুকূল পরিবেশ না থাকলে কোনোভাবেই সংস্কার কার্যক্রম গতি লাভ করতে পারবে না।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইতোমধ্যেই প্রায় ৯ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অনুকূল পরিবেশের অভাবে সংস্কার কার্যক্রম যেভাবে গতিশীল হওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের যেন কোনো আগ্রহ নেই।

সর্বত্রই কম-বেশি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ সুযোগে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে নানা ধরনের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করা হচ্ছে। এমনকি যেসব দাবি রাজনৈতিক সরকারের কাছে উত্থাপন করার কথা, সেগুলোও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে একশ্রেণির শিক্ষার্থীর নানা ইস্যুতে হঠাৎ হঠাৎ আন্দোলনে নেমে পড়া।

স্বাধীনতার আগে থেকেই এ দেশের আন্দোলনের ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের গৌরবময় অংশগ্রহণের ঐতিহ্য রয়েছে। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলন এবং সর্বশেষ গত জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছে, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রতিবারই আন্দোলন শেষে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে গেছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ অবসানের পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম আবারও শুরু হয়। এ অবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন এবং যথারীতি পুর্ণোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, কিছুদিন আগেও অস্ত্র হাতে শত্রু নিধনে ব্যস্ত ছিল যে ছাত্রটি, সেও ক্লাসে উপস্থিত হয়ে সুবোধ বালকের মতো শিক্ষা গ্রহণ করছে। যে ছাত্রটি অস্ত্র হাতে য্দ্ধু করেছে, সে তার অস্ত্র জমা না দিয়ে সমাজবিরোধী কাজে তা ব্যবহার করতে পারত। অর্থাৎ প্রতিটি আন্দোলন শেষেই ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে বিদ্যার্জনে মনোযোগী হয়েছে।

এটি স্বাভাবিক হলেও নিঃসন্দেহে গৌরবময় দৃষ্টান্ত। কিন্তু এবার কিছুটা হলেও এর ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী যদি প্রথাগত রাজনীতিতে যুক্ত হতে চায়, সে তা হতে পারে। এটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, কিছু শিক্ষার্থী নানা ইস্যুতে আন্দোলনের নামে রাজপথে নেমে আসছে। এতে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনের বিদ্যার্জনের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

কোনো জাতীয় ইস্যুতে আন্দোলনের জন্য রাজপথে নেমে আসা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য রাস্তায় নেমে আসা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি ছাত্রদের সমস্যার সমাধান না করতে পারেন, তাহলে তারা তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে পারেন। একমাত্র জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু ছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অজুহাতে রাস্তায় নেমে আসা কোনোভাবেই যৌক্তিক আচরণ নয় বলেই মনে হয়।

আমাদের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য আছে, এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে অন্যান্য সেক্টরের মতো ছাত্ররাজনীতিকেও কলুষিত ও বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেশিশক্তি বলে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। হলের সিট বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা কর্মে তারা হস্তক্ষেপ করত। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি করা হতো।

অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কর্র্মীদের সিট দখলে নেওয়া, তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ফলে ভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী ছাত্রলীগের পরিচয়ে হলে বসবাস করতে বাধ্য হতো। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতা হতে পারলেই কোটি কোটি টাকা কামানোর সুযোগ পাওয়া যেত। ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি উত্থাপন করবে। প্রয়োজনে আন্দোলন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলোর মাঝে দলীয় লেজুড়বৃত্তির প্রবণতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব ডেলিগেটদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় না। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাই নির্ধারণ করে দেন কারা ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে থাকবেন। ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার কারণে যারা ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসীন হন, পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করতে পারেন না। বিগত সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদের নিয়মিত নির্বাচন হতো না। ফলে ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না।

কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি নির্বাচিত ছাত্র সংসদ কার্যকর থাকে, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ছাত্র সংসদের নেতাদের কাছে তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই বলে ছাত্ররা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। নিজেদের হীন স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র অসন্তোষ জিইয়ে রাখে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের একশ্রেণির নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়।

বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গত সাড়ে ১৫ বছর শিক্ষাঙ্গনে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। তারা সম্ভাব্য ছাত্র আন্দোলন দমানোর জন্য শুধু অস্ত্রই ব্যবহার করেনি, এমনকি সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা পুলিশ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের হত্যা করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ভিন্ন মতাদর্শের কোনো ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে আন্দোলন করলে ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে তাদের ধাওয়া করত-এমন ছবি বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগের নামে ছিনতাইসহ নানা ধরনের সমাজবিরোধী কাজে এরা লিপ্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির যে একটি ঐতিহ্য ছিল, তা গত সাড়ে ১৫ বছরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন ছাত্রনেতাদের নাম শুনলে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। ছাত্ররাজনীতির এ কলুষিত চরিত্র প্রত্যক্ষ করে অনেকেই বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করাই উত্তম। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এ মত সমর্থন করি না। মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা যেমন যৌক্তিক সমাধান নয়, তেমনি কলুষতার কারণে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যৌক্তিক হবে না।

বরং ছাত্ররাজনীতিকে আদর্শিক ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এজন্য প্রথমেই ছাত্রসংগঠনগুলোকে জাতীয় রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিকরণ বন্ধ করতে হবে। উপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে না দিয়ে ডেলিগেটদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা নিয়মিত ছাত্র নয়, তাদের কোনোভাবেই ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসতে দেওয়া যাবে না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদকে কার্যকর এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠান করা গেলে দায়িত্বশীল ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারবে। গণতান্ত্রিক পন্থায় ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচিত করা সম্ভব হলে তারাই পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারবেন।

বর্তমানে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন, যা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এতে দক্ষ ও উপযুক্ত প্রার্থীরা অধিকাংশ সময়ই বাদ পড়ে যান। এসব অদক্ষ ও অনুপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান তাদের পদ টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্রসংগঠনের নেতাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। একজন শিক্ষক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি যদি দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তার প্রতি একটি মহলের শ্রদ্ধা থাকলেও অন্যরা তাদের ঘৃণার চোখে দেখতে পারেন।

বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পরিবর্তে পাশের সংখ্যা (হার) বাড়ানোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার পরও একজন শিক্ষার্থী কর্মজীবনে ভালো করতে পারছে না। আমরা প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন।

বর্তমানে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বেরোচ্ছে, তাদের অধিকাংশই আসলে অর্ধশিক্ষিত। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আসলে অহমিকাপূর্ণ বেকার তৈরি করছে মাত্র। যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন, তাদের বেশিরভাগই কর্মজীবনে গিয়ে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মোটেও কর্মমুখী নয়। তাই উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরও একজন শিক্ষার্থী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। দেশে বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত বেকার থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসাবে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক শিল্প-কারখানা আছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের কর্মীরা কাজ করছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকরা প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছে বেতন-ভাতা বাবদ।

এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিবেচনায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। এ অর্থের বেশিরভাগই গবেষণা কাজে ব্যয়িত হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর শিক্ষা খাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে। এ অর্থের বেশিরভাগই অবকাঠামোগত নির্মাণকাজে ব্যয়িত হয়।

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। একবারে জিডিপির ৬ শতাংশ হয়তো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা সম্ভব হবে না, তবে ক্রমশ শিক্ষা খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিশ্বে এমন একটি দেশের দৃষ্টান্ত দেখানো যাবে না, যারা শিক্ষা-গবেষণার ওপর জোর না দিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করলেও অদৃশ্য কারণে শিক্ষা খাতের সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন আজও গঠন করেনি।

শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য ছাত্ররাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের প্রধান উপলক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায়, সেই লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা। সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি চর্চা করা না গেলে দেশে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে গড়ে উঠবে না। তাই আমাদের এখনই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থার এহেন করুণ দশায় আমি সত্যি মর্মাহত। গত ৬০ বছর আমি দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষার জগতে বিচরণ করেছি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষার করুণ হাল আমাকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। এদেশের একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসাবে আমি শিক্ষার মান ও পরিবেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কোনোভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে আমার উদাত্ত আহ্বান, আপনারা ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ পরিহার করে ক্লাসরুমে ফিরে আসুন এবং জ্ঞানচর্চা ও নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করুন। তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার আবেদন, তোমরাই আগামী দিনে সমাজ পরিবর্তনে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করবে। তাই এ মুহূর্তে তোমাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে ক্লাসরুমে ফিরে গিয়ে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে নিজেকে উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা।

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

শিক্ষার্থী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম