কুমিল্লায় অন্যের সনদে ‘দাপুটে’ আইনজীবী

সিআইডির তদন্তে ধরা, আত্মগোপন
 আবুল খায়ের, কুমিল্লা ব্যুরো 
২৪ আগস্ট ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

কুমিল্লায় অন্যের সনদে বছরের পর বছর আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রাম কেশব নামের এক প্রতারক। সাগর ঘোষ নামের কিশোরগঞ্জের এক আইনজীবীর সনদ ব্যবহার ও নিজের নাম পরিবর্তন করে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করতেন এই প্রতারক। কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভসহ ভোটাধিকার প্রয়োগও করেছেন যথারীতি। হাতে ছিল অসংখ্য মোয়াক্কেল এবং বেশ কিছু মামলা।

আদালতের পাশে বাসা এবং চেম্বার স্থাপন করে এ প্রতারণার কাজ চালিয়েছেন রাম কেশব। সম্প্রতি আদালত এবং এক আসামির সঙ্গে প্রতারণার সূত্র ধরে মুখোশ উন্মোচন হতে থাকে কেশবের। সিআইডির অনুসন্ধানে ধরা পড়ে তার সব প্রতারণা। তার এমন প্রতারণায় হতবাক অন্য আইনজীবীরা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় আদালত অঙ্গনে তোলপাড় চলছে।

জানা যায়, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের অনিল চন্দ দাস ও সন্ধ্যা রানী দাস দম্পতির ছেলে রাম কেশব। জাতীয় পরিচয়পত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। নেই আইন পেশার সনদ। সাগর ঘোষ নামে কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এক আইনজীবীর সনদ দাখিল করে নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে দুই বছর কুমিল্লায় আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন রাম কেশব দাস নামে এ প্রতারক। তার হাতে ছিল অনেক মোয়াক্কেল এবং মামলা। কুমিল্লা আইনজীবী সমিতি থেকে নিয়েছেন ভাতাও। দুটি ভিজিটিং কার্ডে রয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টসহ চার চেম্বারের ঠিকানা। ধর্ষণের একটি মামলার সূত্র ধরে প্রতারণার বিষয়টি নজরে আসে সিআইডির। এরপর সপরিবারে লাপাত্তা এ প্রতারক।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সাগর ঘোষ পরিচয়ে কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতিতে যোগ দেন রাম কেশব দাস নামে এক আইনজীবী। সদস্য নম্বর ১৩০২। প্রয়োগ করেছেন সদস্য হিসেবে ভোটাধিকারও। আইন পেশার সনদ না থাকলেও দুই বছর বীরদর্পে চালিয়েছেন স্বাভাবিক কার্যক্রম। গত বছরের ৬ নভেম্বর কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আসামির যোগসাজশে ভুয়া বাদী সাজিয়ে হাসিনা আক্তার নামে এক আইনজীবীর নাম ব্যবহার করে মামলা প্রত্যাহারসহ নিষ্পত্তির আবেদন করেন রাম কেশব দাস। এতে ধার্য তারিখের আগেই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। পরে বাদীপক্ষের আইনজীবী নূর মোহাম্মদ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে রিট করেন।

চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতের বিচারক এমএ আউয়াল বিষয়টি তদন্তপূর্বক ১৫ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় আদালত অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং আইনজীবীর নামও প্রকাশ পায়। এ ঘটনায় আদালতের বিচারকের কাছে ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিতভাবে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন রাম কেশব দাস। এদিকে আদালতের নির্দেশ পেয়ে রাম কেশব দাসের বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কিশোরগঞ্জের দুটি ঠিকানায় অনুসন্ধান চালান সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা। সম্প্রতি উভয় ঠিকানা ভুয়া হলেও কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। ইতোপূর্বে বেরিয়ে আসে তার আসল পরিচয়।

কুমিল্লা সিআইডির পরিদর্শক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অনুসন্ধানে রাম কেশব দাসের দুটি ঠিকানা ভুয়া পাওয়া যায়। পাঁচ-ছয় বছর আগে কিশোরগঞ্জ সদরের খড়মপট্টি এলাকায় ‘মুছা নীড়’ নামে এক বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন রাম কেশব। নাম-পরিচয় গোপন করে কুমিল্লায় এসে সাগর ঘোষ কেশব নামে আইনজীবী হয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে সাগর ঘোষ নামে কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে একজন আইনজীবী রয়েছেন। সিআইডির তদন্তে পরিচয় উদঘাটন হওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে সপরিবারে ভাড়া বাসা এবং চেম্বার ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন রাম কেশব দাস। কিশোরগঞ্জের প্রকৃত আইনজীবী সাগর ঘোষ বলেন, এটা অবৈধ কাজ। কুমিল্লা বারে তৎকালীন যারা নেতৃত্বে এবং দায়িত্বে ছিলেন তাদের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে। এটা কুমিল্লা বারের ব্যর্থতা।

কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শাহ আজিজুল হক বলেন, কেশব দাস এলএলবি পাস করেছেন এমন পরিচয়ে কিশোরগঞ্জ আদালতে ঘোরাফেরা করতেন। পরে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে এলএলবি পাস নয়, এটি প্রমাণিত হয়। এর পরই তাকে কিশোরগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করা হয়।

কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রত্যেকটা কাগজ দেখে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমারও দায় আছে। কিন্তু একজন আইনজীবী এমন কাজ করবেন এটা ভাবিনি। বার কাউন্সিল থেকে চিঠিসহ সব কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন, তাই বিশ্বাস থেকে তাকে সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আমরা যদি তাৎক্ষণিক যাচাই করতাম, তাহলে এমন ভুল হতো না। কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সামছুর রহমান ফারুক বলেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন