সিলেটে ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন আতঙ্কে যাত্রীরা
আজমল খান, সিলেট ব্যুরো
২৩ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সিলেটের রেললাইন লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনোভাবেই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই মিলছে না।
এতে ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হওয়ার পর কয়েকদিন তোড়জোড় চলে। তদন্ত কমিটিও গঠন হয়, এরপর যেই সেই। ব্রিটিশ আমলের তৈরি এ রেললাইন ও ব্রিজগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক জায়গায় রেললাইনের নাটবল্টু খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কোথাও রেললাইনের পাথর সরে গেছে। এ লাইনে সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৩টি সেতু রয়েছে। সবক’টি সেতু অনেক আগেই মহাঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং উল্টো ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সংশ্লিষ্টরা। ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে এ সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
সূত্র জানায়, এক সপ্তাহে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গলে ৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ২৫ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়। ১১ নভেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও রেলস্টেশনের অদূরে মোমিনছড়া চা বাগান এলাকায় মালবাহী একটি ট্রেনের দুটি চাকা লাইনচ্যুত হয়। জানা গেছে, ৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় চট্টগ্রাম পাহাড়তলী স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি তেলবাহী ট্রেনের সাতটি বগি দুর্ঘটনায় পড়ে। এ সময় সিলেট-ঢাকা, সিলেট-চট্টগ্রাম ও সিলেট-আখাউড়াগামী ৫টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। ২২ ঘণ্টা পর সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। এ সময় রেললাইনে ওয়াগান থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পড়ে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়। এর আগে পাঁচ মাসে অন্তত ১১টি দুর্ঘটনায় বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সিলেট স্টেশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন। নির্মাণের ৫৫ বছর পর রেল সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ রুটের সেতুর বয়স প্রায় শত বছরের কাছাকাছি। তালিকা অনুযায়ী ১৩টি সেতুকে ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে সেতু অতিক্রম করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জানা যায়, ২৩ জুন কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের অদূরে বড়ছড়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন। এ দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত ও দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়। ক্ষতি হয় রেলের ২৮ কোটি টাকা। এ দুর্ঘটনার ১৫ দিনের মাথায় একই এলাকায় ৭ জুলাই গরুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন জয়ন্তিকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এর ৯ দিন পর ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন কালনি এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পর ছিঁড়ে যায় ব্রেকের তার। পরে জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে ট্রেনটি সিলেটে এসে পৌঁছে। ১৯ জুলাই কুলাউড়া আউটার সিগন্যালের কাছে লাইনচ্যুত হয় জয়ন্তিকা ট্রেন। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার একই জায়গায় সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।
সিলেট নগরীর কুয়ারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আজিজুল হক সুজা বলেন, তিনি ব্যবসার কাজে ট্রেনে নিয়মিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যাত্রীসেবার মান নেই বললেই চলে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও রেললাইন থাকায় মহা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সিলেট রেলস্টেশনের ম্যানেজার খলিলুর রহমান বলেন, যেসব এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে সেসব এলাকা ডেড স্পট নয়, হয়তো অন্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ ও যাত্রীদের আতঙ্কের কথা স্বীকার করে বলেন, ট্রেন ছাড়ার আগে পরিচালকের হাতে নির্দেশনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। এ নির্দেশনামতেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হয়। তবে জরুরি ভিত্তিতে রেললাইনের উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এ রেল কর্মকর্তা।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সিলেটে ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন আতঙ্কে যাত্রীরা
সিলেটের রেললাইন লক্কড়ঝক্কড় হওয়ায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনোভাবেই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই মিলছে না।
এতে ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হওয়ার পর কয়েকদিন তোড়জোড় চলে। তদন্ত কমিটিও গঠন হয়, এরপর যেই সেই। ব্রিটিশ আমলের তৈরি এ রেললাইন ও ব্রিজগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক জায়গায় রেললাইনের নাটবল্টু খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কোথাও রেললাইনের পাথর সরে গেছে। এ লাইনে সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৩টি সেতু রয়েছে। সবক’টি সেতু অনেক আগেই মহাঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং উল্টো ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সংশ্লিষ্টরা। ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে এ সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনে আগে ট্রেন চলত ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন তা অর্ধেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
সূত্র জানায়, এক সপ্তাহে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গলে ৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ২৫ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়। ১১ নভেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও রেলস্টেশনের অদূরে মোমিনছড়া চা বাগান এলাকায় মালবাহী একটি ট্রেনের দুটি চাকা লাইনচ্যুত হয়। জানা গেছে, ৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় চট্টগ্রাম পাহাড়তলী স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি তেলবাহী ট্রেনের সাতটি বগি দুর্ঘটনায় পড়ে। এ সময় সিলেট-ঢাকা, সিলেট-চট্টগ্রাম ও সিলেট-আখাউড়াগামী ৫টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। ২২ ঘণ্টা পর সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। এ সময় রেললাইনে ওয়াগান থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পড়ে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়। এর আগে পাঁচ মাসে অন্তত ১১টি দুর্ঘটনায় বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সিলেট স্টেশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি ও আঁকাবাঁকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন। নির্মাণের ৫৫ বছর পর রেল সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ রুটের সেতুর বয়স প্রায় শত বছরের কাছাকাছি। তালিকা অনুযায়ী ১৩টি সেতুকে ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে সেতু অতিক্রম করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি ও মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জানা যায়, ২৩ জুন কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের অদূরে বড়ছড়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন। এ দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত ও দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়। ক্ষতি হয় রেলের ২৮ কোটি টাকা। এ দুর্ঘটনার ১৫ দিনের মাথায় একই এলাকায় ৭ জুলাই গরুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন জয়ন্তিকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এর ৯ দিন পর ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন কালনি এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পর ছিঁড়ে যায় ব্রেকের তার। পরে জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে ট্রেনটি সিলেটে এসে পৌঁছে। ১৯ জুলাই কুলাউড়া আউটার সিগন্যালের কাছে লাইনচ্যুত হয় জয়ন্তিকা ট্রেন। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার একই জায়গায় সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।
সিলেট নগরীর কুয়ারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আজিজুল হক সুজা বলেন, তিনি ব্যবসার কাজে ট্রেনে নিয়মিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যাত্রীসেবার মান নেই বললেই চলে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও রেললাইন থাকায় মহা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সিলেট রেলস্টেশনের ম্যানেজার খলিলুর রহমান বলেন, যেসব এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে সেসব এলাকা ডেড স্পট নয়, হয়তো অন্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ ও যাত্রীদের আতঙ্কের কথা স্বীকার করে বলেন, ট্রেন ছাড়ার আগে পরিচালকের হাতে নির্দেশনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। এ নির্দেশনামতেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো হয়। তবে জরুরি ভিত্তিতে রেললাইনের উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এ রেল কর্মকর্তা।