গাড়িচালকের ক্ষমতা

আট বছর ধরে সন্ত্রাসীর দখলে সরকারি সম্পত্তি

উদ্ধারের জন্য ভূমি সংস্কার বোর্ড কেবল চিঠিই দিচ্ছে বাসা বুঝিয়ে দিতে বারবার * সতর্ক করে চিঠি দিলেও আইনগত বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ
 সিরাজুল ইসলাম 
১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ভূমি সংস্কার বোর্ড থেকে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মামুন সরকারের নামে তিন কক্ষের একটি বাসা লিজ দেওয়া হয়। রাজধানীর কোতোয়ালি থানাধীন ওয়াইজঘাট এলাকার র‌্যাকিন ভবনের ওই বাসাটি কোর্ট অব ঢাকা নওয়াব এস্টেটের মালিকানাধীন, যা দেখভালের দায়িত্ব ভূমি সংস্কার বোর্ডের। মামুনের আগে ওই বাসার লিজ মালিক ছিলেন ভূমি সংস্কার বোর্ডের গাড়িচালক মীর শাহীন হোসেন। তিনি প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে বাসাটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে তাকে খুলনা বিভাগীয় উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনারের কার্যালয়ে বদলি করার পর বাতিল করা হয় বাসার বরাদ্দ। বাসার চাবি মামুনকে বুঝিয়ে দিতে বোর্ড থেকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু শাহীন এতে কর্ণপাত না করে আরিফ সন্যামত নামে একজনের কাছে চাবি হস্তান্তর করে খুলনায় চলে যান। নতুন লিজমালিক মামুন বারবার চেষ্টা করলেও বাসাটি অবৈধ দখলদারের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেননি। তিনি যখন বাসা দখল করতে যান, তখনই তার ওপর হামলা চালানো হয়। দেওয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি। বিষয়টি বেশ কয়েকবার জানানো হয়েছে ভূমি সংস্কার বোর্ডকে। থানায় করা হয়েছে একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। অভিযোগ দেওয়া হয়েছে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু গাড়িচালক শাহীনের কাছে যেন সবাই অসহায়। ভূমি সংস্কার বোর্ড কেবল বাসাটি উদ্ধারের জন্য শাহীনকে চিঠিই দিচ্ছে। সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে বারবার সতর্ক করছে। আইনগত এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে চিঠিও দিচ্ছে। কিন্তু প্রায় আট বছরেও তার বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ভূমি সংস্কার বোর্ডের পক্ষ থেকে গাড়িচালক মীর শাহীন হোসেনকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, কোর্ট অব ওয়ার্ডস ঢাকা নওয়াব এস্টেটের মালিকানাধীন আপনার নামে বরাদ্দ করা জায়গাটি বাতিল করা হয়েছে। এটি মামুন সরকারের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে। বাসাটি নতুন লিজ মালিক মামুন সরকারকে আগামী বাংলা ১৪২২ সালের ১ ভাদ্র থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। মীর শাহীন হোসেনকে দেওয়া অপর এক চিঠিতে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর ভূমি সংস্কার বোর্ডের সহকারী কমিশনার আকবর আলী বলেন, আপনি বাসা ত্যাগ করার সময় চাবি কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে না দিয়ে বহিরাগত ব্যক্তিকে দখল দিয়ে যান। বিষয়টি চাকরিবিধি লঙ্ঘন ও অসদাচরণের শামিল। তাই অবিলম্বে বাসাটি খালি করে চাবি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হলো। অন্যথায় আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর এবং ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি একই ধরনের চিঠি দেওয়া হয় বোর্ড থেকে। আরিফ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০১৮ সালের ২১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু হাসনাত মো. মঈনুদ্দিন চিঠি দেন ডিএমপি কমিশনারকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ কার্যালয়কে অবহিত করতে অনুরোধ করা হলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মীর শাহীন হোসেন যাকে বাসার চাবি দিয়েছেন তিনি (আরিফ সন্যামত) ও তার সহযোগীরা অবৈধভাবে সরকারি ওই বাসায় অবস্থান করে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দেওয়া হলেও সুফল মিলছে না ভুক্তভোগীদের। গত ২০ ফেব্রুয়ারি ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে মামুন সরকার বলেন, আরিফ সন্যামত একজন বহিরাগত ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সে জাল-জালিয়াতিতে বিশেষ পারদর্শী। ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট আমার নামে রাজধানীর কোতোয়ালি থানাধীন ওয়াইজঘাট এলাকার সরকারি ভবনে তিন কক্ষের একটি বাসা লিজ দেওয়া হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর সরকারকে লিজমানি পরিশোধ করছি। কিন্তু আমি বাসায় যেতে পারছি না। আমি যতবার বাসাটি বুঝে নেওযার চেষ্টা করেছি, সে ততবারই আমার ওপর হামলা চালিয়েছে।

মামুন সরকার যুগান্তরকে বলেন, কেবল হামলা করে ও হুমকি দিয়েই বসে থাকেনি আরিফ সন্যামত। বাসার দখল টিকিয়ে রাখতে সে নানা কূট-কৌশল অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দুর্নীতিবিরোধী সোসাইটির সঙ্গেও জালিয়াতি করেছে। ২০১৮ সালের ৮ মে ওই প্রতিষ্ঠানের ভুয়া প্যাড, সিল ও মহাসচিবের স্বাক্ষর জাল করে তার (আরিফ) পক্ষে ভূমি সংষ্কার বোর্ডে চিঠিও দিয়েছিল। আরিফকে প্রতারক এবং জালিয়াত চক্রের সদস্য উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ২০১৮ সালের ২৩ মে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারকে চিঠি দেন বোর্ডের ম্যানেজার। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উলটো এলাকায় গড়ে তুলেছে অপরাধ সাম্রাজ্য।

স্থানীয় বাসিন্দা বিউটি আক্তার বলেন, অবৈধ দখলদার আরিফ সন্যামত ও তার সহযোগীদের অপকর্মে আমরা অতিষ্ঠ। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর হামলা চালায় আরিফ বাহিনীর সদস্যরা। মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও প্রাণনাশের হুমকি এই বাহিনীর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ১৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছি।

এ ব্যাপারে জানতে আরিফ সন্যামতের মোবাইল নম্বরে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে গাড়িচালক মীর শাহীন হোসেন বলেন, বাসাটি যখন আমার নামে বরাদ্দ করা হয় তখন কর্তৃপক্ষ আমার দখলে দেয়নি। আরিফের সহযোগিতায় আমি বাসার দখল নিয়েছিলাম। তাই বাসা ছেড়ে আসার সময় আমি চাবি আরিফকে দিয়ে এসেছি। আমার পরে যেহেতু কর্তৃপক্ষ মামুনের নামে বাসাটি বরাদ্দ দেয়, তাই তিনি (মামুন) কীভাবে বাসার দখল নেবেন সেটা তার ব্যাপার। ভূমি সংস্কার বোর্ডের সহকারী ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, বাসাটি এখন যার দখলে আছে তিনি আমাদের স্টাফ না। তাই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিকবার পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মীর শাহীন হোসেন আমাদের স্টাফ। আমরা তাকে বাসার চাবি বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তিনি আনুরোধে সাড়া দিচ্ছে না। বিষয়টি আমাদের প্রশাসন শাখা অবগত। তারা নিশ্চয়ই যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ওসি শাহীনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি এই থানায় নতুন যোগদান করেছি। তাই বিষয়টি আমার নজরে নেই। আপনার মাধ্যমে যেহেতু জানলাম, খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন