করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাব

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির

 হামিদ বিশ্বাস  
২৯ মার্চ ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ক্রেতারা আগের দেয়া রফতানির আদেশ বাতিল করে দিচ্ছেন। নতুন করে অর্ডার দেয়াও প্রায় বন্ধ রয়েছে। পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। আগের এলসিও নিষ্পত্তি কমে গেছে। উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোও সীমিত আকারে সচল রয়েছে। পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাও হয়ে পড়েছে শিথিল। এর মধ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ১০ দিনের লক ডাউনের কারণে ব্যাংকিং সেবাও যেমন খুব সীমিত হয়ে পড়েছে, তেমনি মানুষের চলাচলও কমে বলতে গেলে বন্ধই হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মানুষই অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়। সরকার নীতিগত সহায়তা দেয়। এখন করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের চলাচল একেবারেই কমে গেছে। দোকানপাট বন্ধ। এতে মানুষের চাহিদা ও সেবা নেয়ার প্রবণতা কমে গেছে। ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাপী করোনার যে ভয়াবহ থাবা তাতে বিশ্ব অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছে। এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতির এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে। এই শক্তির কারণে অর্থনীতি আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, টানা হরতাল, অবরোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর একটা পর্যায়ে এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতি কখনই কোনো সরলরেখায় চলেনি। বার বারই হোঁচট খেয়েছে। এবারও করোনার হোঁচট থেকে ঘুরে দাঁড়াবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই পরিচালিত হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ১০ দিনের জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। ফলে ঋণ বিতরণ, এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রয়েছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারি সময়ে রেমিটেন্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা বজায় থাকলেও একক হিসাবে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১০ শতাংশ। মূলত রেমিটেন্স প্রবাহে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়ায় এ খাতে প্রবাহ বাড়ছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে কমতে শুরু করেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ বছরের ফেরুয়ারিতে বেড়েছে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এক মাসে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ। মার্চের শুরুতেও এর প্রবাহ আরও কমতে শুরু করেছে।

দেশের মোট রেমিটেন্সের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর- এ চার দেশ থেকে আসে ১১ শতাংশ। এ চারটি দেশেও করোনার থাবা বসেছে। ফলে এসব দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসে সোয়া ১২ শতাংশ। এসব দেশে করোনা মহামারী রূপ নিয়েছে। ফলে ওইসব দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে সৌদি আরব থেকে। এখানে করোনার প্রভাবে প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম থমকে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে সাড়ে ১১ শতাংশ। একই অবস্থা বিরাজ করছে এখানে। এসব কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ সামনের দিনগুলোতে কমে যেতে পারে। এদিকে রফতানি আয়েও বড় ধরনের মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশের রফতানি আয়ের বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। এই দুটি অঞ্চলেই এখন করোনার করাল গ্রাসে আক্রান্ত। ফলে রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রফতানি বেড়েছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৪ দশমকি ৭৯ শতাংশ। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছিল ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাড়ার পরিবর্তে কমেছে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ক্রেতারা রফতানি অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছেন। অনেকে স্থগিত করেছেন। এভাবে আর কিছুদিন চললে কারখানা চালু রাখা কঠিন হবে। নতুন কোনো অর্ডার আসছে না।

বিজিএমইএ সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ২৬৯ কোটি ডলারের রফতানির আদেশ বাতিল হয়েছে। এর ফলে ১৯ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ইতিমধ্যে বেশকিছু ক্রেতা আগের অর্ডারের পণ্য উৎপাদন স্থগিত করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ তারা তা নিতে পারবেন না। এছাড়া নতুন কোনো পণ্য উৎপাদন করতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, গভীর সংকটে পড়ে গেলাম। তবে পুরো ক্ষতির চিত্র এখনও বলা যাচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও অবনতি হচ্ছে।

গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমদানি বেড়েছিল ৭ দশমকি ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে কমেছে ৪ দশমকি ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে বেড়েছিল ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে কমেছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ৪৬৩ কোটি ২৮ লাখ ডলারের আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই মাসে এলসি খোলা হয় ৬১১ কোটি ৬১ লাখ ডলারের। সে হিসাবে এলসি খোলা কমেছে ৩২ শতাংশের বেশি। আর এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ৭৪ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আমদানি হয়েছে মোট ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য। ফেব্রুয়ারি মাসের আমদানির তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে করোনা বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ফেব্রুয়ারিতে আমদানি আরও কমেছে বলে জানা গেছে। মার্চের আমদানি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের

আমদানি-রফতানির ওপর বড় ধাক্কা আসছে। এটা দৃশ্যমান হবে মার্চ-এপ্রিল শেষে। এখন বিভিন্ন পোশাক কারখানায় অর্ডার স্থগিত এবং বাতিল করা হচ্ছে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন