ক্ষুদ্রঋণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী
একটি দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায় দারিদ্র্য। বাংলাদেশ এর উদাহরণ। দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা। দারিদ্র্য আরও কমিয়ে আনতে না পারলে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সরকার নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে।
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পও কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ বলতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন এক ধরনের ঋণ সুবিধাকে বোঝায়। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মূলত এই ঋণ দেয়া হয়।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সূচনা হয় ১৯৭৬ সালে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু হয় আশির দশকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প কি আদৌ দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরাও একমত হতে পারেননি।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের অবদান রয়েছে; আবার কেউ কেউ বলছেন, অবদান নেই। তবে ক্ষুদ্রঋণ যে দারিদ্র্য বিমোচনে একেবারেই সহায়ক না, তা নয়। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেকেই দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমানের ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠতে পেরেছে। আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট ক্যাম্পেইনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় ৯.৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে।
তবে দেশের বাস্তবচিত্র বলে অন্য কথা। যদি দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখত, তাহলে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সংখ্যায় অনেকটাই কমে যেত। বলা হয়ে থাকে, এনজিওগুলো মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ সেবা দিয়ে থাকে।
কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের অর্থ ব্যয় করে ভোগের পেছনে। মৌলিক চাহিদা মেটানোর কাজে তারা ঋণের অর্থ ব্যয় করে। আবার কেউ কেউ অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধ করার জন্য নতুনভাবে অন্য আরও একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
এ কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণকৃত টাকা নতুন কোনো কাজে লাগাতে পারে না, যা থেকে আয় হবে। আর আয় না হলে সঞ্চয় করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর সঞ্চয় না হলে দারিদ্র্য লাঘব হবে কী করে?
দেশের প্রায় সব এনজিওর কিস্তি শুরু হয় ঋণ গ্রহণের এক সপ্তাহ পর থেকে। এ কারণে ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। ধরে নিলাম, এক ব্যক্তি ঋণের অর্থ দিয়ে একটা মুরগির খামার করল। সেখান থেকে আয় হতে সর্বনিম্ন দুই মাস সময় লাগবে।
এখন কথা হল, এ দুই মাস সে ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করবে? আবার আয় হওয়া শুরু হলেও কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সেই সময় পরিবারের ভরণপোষণসহ সঞ্চয়ের টাকা আসবে কোথা থেকে? আর সঞ্চয় যদি নাই করতে পারে, তাহলে কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন হবে?
আবার এটাও দেখা যায় যে, ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য এনজিওগুলো সামাজিক ও আর্থিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে, যা অনেকেই সহ্য করতে পারে না। অনেকেই একমাত্র সম্বল বসতভিটা বিক্রি করে পরিশোধ করে ঋণের অর্থ।
কাজেই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে পরিবর্তন না এলে এটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো উপকারে আসবে না।
সাইদুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ক্ষুদ্রঋণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী
একটি দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায় দারিদ্র্য। বাংলাদেশ এর উদাহরণ। দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা। দারিদ্র্য আরও কমিয়ে আনতে না পারলে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সরকার নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে।
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পও কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ বলতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন এক ধরনের ঋণ সুবিধাকে বোঝায়। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মূলত এই ঋণ দেয়া হয়।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সূচনা হয় ১৯৭৬ সালে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু হয় আশির দশকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প কি আদৌ দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরাও একমত হতে পারেননি।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের অবদান রয়েছে; আবার কেউ কেউ বলছেন, অবদান নেই। তবে ক্ষুদ্রঋণ যে দারিদ্র্য বিমোচনে একেবারেই সহায়ক না, তা নয়। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেকেই দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমানের ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠতে পেরেছে। আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট ক্যাম্পেইনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় ৯.৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে।
তবে দেশের বাস্তবচিত্র বলে অন্য কথা। যদি দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখত, তাহলে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সংখ্যায় অনেকটাই কমে যেত। বলা হয়ে থাকে, এনজিওগুলো মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে উৎসাহিত করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ সেবা দিয়ে থাকে।
কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের অর্থ ব্যয় করে ভোগের পেছনে। মৌলিক চাহিদা মেটানোর কাজে তারা ঋণের অর্থ ব্যয় করে। আবার কেউ কেউ অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধ করার জন্য নতুনভাবে অন্য আরও একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
এ কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণকৃত টাকা নতুন কোনো কাজে লাগাতে পারে না, যা থেকে আয় হবে। আর আয় না হলে সঞ্চয় করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর সঞ্চয় না হলে দারিদ্র্য লাঘব হবে কী করে?
দেশের প্রায় সব এনজিওর কিস্তি শুরু হয় ঋণ গ্রহণের এক সপ্তাহ পর থেকে। এ কারণে ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। ধরে নিলাম, এক ব্যক্তি ঋণের অর্থ দিয়ে একটা মুরগির খামার করল। সেখান থেকে আয় হতে সর্বনিম্ন দুই মাস সময় লাগবে।
এখন কথা হল, এ দুই মাস সে ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করবে? আবার আয় হওয়া শুরু হলেও কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সেই সময় পরিবারের ভরণপোষণসহ সঞ্চয়ের টাকা আসবে কোথা থেকে? আর সঞ্চয় যদি নাই করতে পারে, তাহলে কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন হবে?
আবার এটাও দেখা যায় যে, ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য এনজিওগুলো সামাজিক ও আর্থিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে, যা অনেকেই সহ্য করতে পারে না। অনেকেই একমাত্র সম্বল বসতভিটা বিক্রি করে পরিশোধ করে ঋণের অর্থ।
কাজেই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে পরিবর্তন না এলে এটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো উপকারে আসবে না।
সাইদুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়