মুক্তিযুদ্ধের এক বিদেশি বন্ধুর কথা

 তানজিল আমির 
২৩ মার্চ ২০১৮, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়েছেন। ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমও রয়েছেন এ তালিকায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন, নৃশংস গণহত্যা দেখে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেননি তারা। মুক্তিপাগল বীর সেনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন নির্ভয়ে। অথচ এক অজানা কারণে আজকের প্রজন্ম এ স¤পর্কে তেমন কিছুই জানে না। ১৯৭১ সালে এদেশের নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর পাকবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সভাপতি এবং ভারতীয় লোকসভার সদস্য মাওলানা আসআদ মাদানী (র.)। গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোয় সফর করে এ যুদ্ধ যে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু নয়, এ বিষয়টি তিনি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে তার নেতৃত্বে কলকাতায় অনেক সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনে কাজ করেন মাওলানা আসআদ মাদানী। দিল্লিতে বিশাল মহাসমাবেশসহ ভারতজুড়ে প্রায় ৩০০ সমাবেশ করেন তিনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার অপরিসীম সহায়তা এবং গণনির্যাতন বন্ধে তার বিরামহীন দুঃসাহসী ভূমিকা স্বভাবতই তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বন্ধুর মহিমা দিয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকহানাদার বাহিনীর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন সপ্তম নৌবহর এ উপমহাদেশ অভিমুখে পাঠায়, তখন মাওলানা আসআদ মাদানী পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মুসলমান নিয়ে দিল্লির রাজপথে মিছিল করেন এবং তার নেতৃত্বে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ও ১৮ আগস্ট কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেনশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে দু’দফায় দুটি রেজুলেশন পাস করেন তিনি। এছাড়া তিনি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এলাকায় বাংলাদেশীদের জন্য শরণার্থী শিবির ও নিয়মিত রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছু অদূরদর্শী ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি ধর্মের নামে শুধু পাকবাহিনীকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের জুলুম-নির্যাতনে মদদ জুগিয়েছে, নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। স্বাধীনতার পর তাদের অধিকাংশ মুখোশ পাল্টালেও সেসব অপকর্মের কারণেই নিরীহ মুসলমান আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নেমে আসে দুর্যোগ। সেই দুঃসময়েও শান্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হন মাওলানা আসআদ মাদানী। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন। মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহসহ বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে একথা বোঝাতে সক্ষম হন যে, অধিকাংশ আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল না, বরং বহু উলামায়ে কেরাম মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। দূরদর্শী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু বিষয়টি উপলব্ধি করায় এদেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমান্বয়ে দুর্যোগের কালো মেঘ দূরীভূত হয়ে যায়।

মাওলানা আসআদ মাদানী (র.) উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোর প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শূরা কমিটির সভাপতি ও দীর্ঘদিন শিক্ষা সচিব ছিলেন। এছাড়া তার তত্ত্বাবধানেই মুসলিম পার্সোনাল আইন প্রণীত হয়। মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারি জেনারেল পরবর্তীকালে সভাপতি ছিলেন বহু বছর। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে ইন্তেকাল করেন তিনি। ২০১৩ সারের ১ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার তাকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করে।

তানজিল আমির : গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মী

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন