তিনি ছিলেন সাহসী কলমযোদ্ধা
মৃত্যু অনিবার্য। সব মৃত্যুই কষ্টের। আবার কিছু মৃত্যু আছে যা অপ্রত্যাশিত, যা মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীর শোকচিহ্ন এঁকে দেয়।
যেমন দিয়েছে প্রথিতযশা গবেষক, সাংবাদিক, লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যু। বারবার মনে হচ্ছে, তার মৃত্যুতে দেশের ও গণমানুষের একজন অভিভাবককে হারালাম আমরা।
দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সুন্দরবন রক্ষা, তেল-গ্যাস-বন্দর জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে তিনি থাকতেন সামনের সারিতে। তার লেখার সাবলীলতায় মুগ্ধ হতাম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, শোষণ-বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজের। তাই তার প্রতিটি লেখায় থাকত গণমানুষের মুক্তির কথা।
একাধারে তিনি ছিলেন রাজপথের সৈনিক এবং আপসহীন কলমযোদ্ধা। তিনি দেখিয়েছেন সত্য সবসময়ই শ্রদ্ধার। তিনি কখনো লোভ ও লাভের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি সবসময় সাহস নিয়ে সত্যটা বলে দিতেন। এই সত্য বলার কারণে তাকে হুমকি শুনতে হয়েছে; কিন্তু তবুও তিনি কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপস করেননি। সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শোষণহীন সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি অগণিত শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন। তাদের দায়িত্ব তার স্বপ্ন পূরণের জন্য অসমাপ্ত কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রাজপথের নানা গণমুখী প্রতিবাদ ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ছিলেন তিনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ নানা সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করে ভিন্নধর্মী পোশাক পরা ধরেছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই পোশাকই ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ দেশের রাজীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদপত্রে কলাম লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এরপর সাপ্তাহিক জনতায় কাজ করেছেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়েই লিখতেন বেশি। কবিতার পাশাপাশি তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমাদের সংস্কৃতির মূলধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির যোদ্ধা। বাঙালি জাতির অভিন্ন, সুদীর্ঘ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা বলেছিলেন তিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার সৃজনশীল কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।
সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
তিনি ছিলেন সাহসী কলমযোদ্ধা
মৃত্যু অনিবার্য। সব মৃত্যুই কষ্টের। আবার কিছু মৃত্যু আছে যা অপ্রত্যাশিত, যা মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীর শোকচিহ্ন এঁকে দেয়।
যেমন দিয়েছে প্রথিতযশা গবেষক, সাংবাদিক, লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যু। বারবার মনে হচ্ছে, তার মৃত্যুতে দেশের ও গণমানুষের একজন অভিভাবককে হারালাম আমরা।
দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সুন্দরবন রক্ষা, তেল-গ্যাস-বন্দর জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে তিনি থাকতেন সামনের সারিতে। তার লেখার সাবলীলতায় মুগ্ধ হতাম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, শোষণ-বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজের। তাই তার প্রতিটি লেখায় থাকত গণমানুষের মুক্তির কথা।
একাধারে তিনি ছিলেন রাজপথের সৈনিক এবং আপসহীন কলমযোদ্ধা। তিনি দেখিয়েছেন সত্য সবসময়ই শ্রদ্ধার। তিনি কখনো লোভ ও লাভের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি সবসময় সাহস নিয়ে সত্যটা বলে দিতেন। এই সত্য বলার কারণে তাকে হুমকি শুনতে হয়েছে; কিন্তু তবুও তিনি কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপস করেননি। সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শোষণহীন সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি অগণিত শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন। তাদের দায়িত্ব তার স্বপ্ন পূরণের জন্য অসমাপ্ত কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রাজপথের নানা গণমুখী প্রতিবাদ ও আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ছিলেন তিনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ নানা সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করে ভিন্নধর্মী পোশাক পরা ধরেছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই পোশাকই ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ দেশের রাজীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদপত্রে কলাম লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এরপর সাপ্তাহিক জনতায় কাজ করেছেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়েই লিখতেন বেশি। কবিতার পাশাপাশি তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমাদের সংস্কৃতির মূলধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির যোদ্ধা। বাঙালি জাতির অভিন্ন, সুদীর্ঘ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা বলেছিলেন তিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার সৃজনশীল কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।
সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর