অজানা হুমকি টল্যুইন
বাজার থেকে প্যাকেটজাত কোনো খাদ্যপণ্য কেনার সময় সেটি খাওয়ার জন্য নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে আমরা বেশিরভাগ সময় পণ্যের উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লক্ষ করি।
কিন্তু সাধারণভাবে যে বিষয়টি আমাদের চিন্তার বাইরে থাকে তা হচ্ছে পণ্যের প্যাকেজিং। বিভিন্ন প্যাকেজিং উপকরণে ব্যবহৃত মুদ্রণের কালি বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত জটিল মিশ্রণ, যার মধ্যে কয়েকটি মানবদেহের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বিভিন্ন নকশা ও রঙ তৈরিতে এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে মুদ্রণ কালি প্রস্তুতকারকরা উপাদান হিসাবে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। যদিও এর ভেতর কিছু রাসায়নিক নিরাপদ বলে প্রমাণিত, তবে অনেক সময় প্যাকেজিংয়ে সস্তা বিকল্প ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হয়।
এসব উপাদানের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় টল্যুইন। এই বর্ণহীন তরল পদার্থটি রঙ, রঙ পাতলাকরণ, নেইলপলিশ ও বার্নিশের বৃহৎ স্কেলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। এটি মুদ্রণ কালি উৎপাদনের মূল উপাদান। ক্ষতিকর দিকগুলো আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সস্তা উপাদান হিসাবে টল্যুইন ব্যবহার করে আসছিল।
বিষাক্ততার জন্য টল্যুইন ইউরোপীয় ইউনিয়নে সিএমআর (কার্সিনোজেনিক, মিউটাজেনিক, রেপ্রোটক্সিক) ক্যাটাগরি ২ শ্রেণিভুক্ত, যা অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। বিরূপ প্রকৃতির বিষাক্ত উপাদান থাকার কারণে অনেক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড তাদের পণ্যের খাবার প্যাকেজিংয়ে যে কালি ব্যবহৃত হয়, তা তৈরিতে টল্যুইনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ অথবা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো ভারত ও চীনসহ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো খাদ্য প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত কালিতে টল্যুইনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, টল্যুইন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, হ্যালুসিনেশন, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও বিভ্রান্তির মতো বিভিন্ন অসুস্থতার কারণ হতে পারে। টল্যুইনের কারণে অন্য যেসব স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে ওটোটক্সিসিটি।
এটি শ্রমিকদের হওয়ার আশঙ্কা বেশি; কারণ কারখানার শব্দে ওটোটক্সিক প্রভাব আরও তীব্র হয় এবং ফলস্বরূপ মানুষ সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এর ফলে মুখ, চোখ, গলায় জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট এবং ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে টল্যুইন ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। দেশীয় কালি উৎপাদনকারীদের এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনে চলতে হয় না, যা কিনা মানুষকে টল্যুইনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। মোটকথা, দেশে আমরা এমন অগণিত দ্রব্য প্রতিদিন ব্যবহার করছি যেগুলো আমাদের অজান্তে স্বাস্থ্যের গুরুতর ক্ষতি করছে।
আমাদের পণ্য নিরাপত্তা মানদণ্ডকে উন্নীত করতে হলে আমাদের আইনকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তুলনা করে এগোতে হবে। মুদ্রণ কালিতে টল্যুইনের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দেশে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমরা যাতে ভুলে না যাই-সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।
অংশুমান মুখার্জি : প্রাবন্ধিক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
অজানা হুমকি টল্যুইন
বাজার থেকে প্যাকেটজাত কোনো খাদ্যপণ্য কেনার সময় সেটি খাওয়ার জন্য নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে আমরা বেশিরভাগ সময় পণ্যের উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লক্ষ করি।
কিন্তু সাধারণভাবে যে বিষয়টি আমাদের চিন্তার বাইরে থাকে তা হচ্ছে পণ্যের প্যাকেজিং। বিভিন্ন প্যাকেজিং উপকরণে ব্যবহৃত মুদ্রণের কালি বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত জটিল মিশ্রণ, যার মধ্যে কয়েকটি মানবদেহের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বিভিন্ন নকশা ও রঙ তৈরিতে এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে মুদ্রণ কালি প্রস্তুতকারকরা উপাদান হিসাবে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। যদিও এর ভেতর কিছু রাসায়নিক নিরাপদ বলে প্রমাণিত, তবে অনেক সময় প্যাকেজিংয়ে সস্তা বিকল্প ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হয়।
এসব উপাদানের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় টল্যুইন। এই বর্ণহীন তরল পদার্থটি রঙ, রঙ পাতলাকরণ, নেইলপলিশ ও বার্নিশের বৃহৎ স্কেলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। এটি মুদ্রণ কালি উৎপাদনের মূল উপাদান। ক্ষতিকর দিকগুলো আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সস্তা উপাদান হিসাবে টল্যুইন ব্যবহার করে আসছিল।
বিষাক্ততার জন্য টল্যুইন ইউরোপীয় ইউনিয়নে সিএমআর (কার্সিনোজেনিক, মিউটাজেনিক, রেপ্রোটক্সিক) ক্যাটাগরি ২ শ্রেণিভুক্ত, যা অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। বিরূপ প্রকৃতির বিষাক্ত উপাদান থাকার কারণে অনেক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড তাদের পণ্যের খাবার প্যাকেজিংয়ে যে কালি ব্যবহৃত হয়, তা তৈরিতে টল্যুইনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ অথবা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো ভারত ও চীনসহ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো খাদ্য প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত কালিতে টল্যুইনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, টল্যুইন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, হ্যালুসিনেশন, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও বিভ্রান্তির মতো বিভিন্ন অসুস্থতার কারণ হতে পারে। টল্যুইনের কারণে অন্য যেসব স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে ওটোটক্সিসিটি।
এটি শ্রমিকদের হওয়ার আশঙ্কা বেশি; কারণ কারখানার শব্দে ওটোটক্সিক প্রভাব আরও তীব্র হয় এবং ফলস্বরূপ মানুষ সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এর ফলে মুখ, চোখ, গলায় জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট এবং ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে টল্যুইন ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। দেশীয় কালি উৎপাদনকারীদের এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠিত নিয়ম মেনে চলতে হয় না, যা কিনা মানুষকে টল্যুইনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। মোটকথা, দেশে আমরা এমন অগণিত দ্রব্য প্রতিদিন ব্যবহার করছি যেগুলো আমাদের অজান্তে স্বাস্থ্যের গুরুতর ক্ষতি করছে।
আমাদের পণ্য নিরাপত্তা মানদণ্ডকে উন্নীত করতে হলে আমাদের আইনকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তুলনা করে এগোতে হবে। মুদ্রণ কালিতে টল্যুইনের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দেশে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমরা যাতে ভুলে না যাই-সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।
অংশুমান মুখার্জি : প্রাবন্ধিক