মলাট বৃত্তান্ত
কাঁচামরিচ নিয়ে পাকা কথা
বেনজির কাণ্ড যত বেশি ঘটবে দেশে, নজির হকের মতো মানুষের ততই সুখ! সোনার দাম মাত্রাতিরিক্ত বেশি বলেই লোকে নিজ সামর্থ্য (মতান্তরে ফুটানি) জানান দিতে ভরি ভরি সোনা কেনে। রূপসচেতন নারী-পুরুষরা অঙ্গে সোনার গহনা পরে বাড়িয়ে নেয় সামাজিক জ্যোতি।
এবার কাঁচামরিচের কেজি যখন হাজার টাকা অঙ্ক স্পর্শ করল, ঈদানন্দ বোধ করলেন নজির। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেশি থাকাই ভালো, তাতে ধনবান হিসাবে সমাজে আলাদা সম্মান পাওয়া যায়। টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় সুখবরটা শুনেই বাজারে ছুটলেন তিনি। কয়েক দোকান মিলে ৩৫ কেজি কাঁচামরিচ কিনলেন। ক্রয়-যজ্ঞ দেখে ব্যবসায়ীদের চোখ টমোটোর মতো গোল হয়ে উঠল। একজন সাহস দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ছার, মরিচ বিরানির দোকান দিবেন নাকি?’
‘না রে! মরিচ দিয়ে ইমারত বানানো যায় না। সম্ভব হলে সেটাই করতাম। বাড়ির নাম হতো- মরিচ নিবাস, ইংরেজিতে দ্য গ্রিন চিলি রেসিডেন্ট!’ এমন জবাবে কৌতূহল নিবৃত্ত না হলেও সম্মান ও সম্ভ্রমে তার দিকে তাকিয়ে রইল ব্যবসায়ীটি।
গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে নির্দেশনা দিলেন অন্তত দশ কেজি মরিচ যেন গাড়ির পেছন অংশে রাখে, যেন বাইরের লোকজনের চোখে পড়ে। গাড়ির পেছনে তিনটা সৃজনশীল বই রেখেছেন জনদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য; এবার বইয়ের জায়গা হলো সামনের অংশে। ত্বরিৎকর্মা ড্রাইভার কোত্থেকে একটা বই বের করল- মরিচ চাষের কঠিন কৌশল। বইগুলোর সঙ্গে কিছু মরিচ ছিটিয়ে দেওয়া হলো সামনের অংশে। এতেই দর্শনার্থীদের চোখ ডাঁসা লিচু হয়ে উঠতে দেখলেন নজির। আনন্দটা উপভোগের সময় কানে এল ড্রাইভারের প্রভুভক্তি ঋদ্ধ বচন, ‘স্যার, বাইরে লুঙ্গি পরা লোকটা আপনাকে অপমান করেছে।’
‘নিশ্চয়ই মরিচ কেনার সুযোগ পায়নি! দেখুক সে, দেখেও যদি ঝাল-তৃষ্ণা মেটাতে পারে।’
‘বলেছে নিশ্চয়ই ঘুসখোর বা কালোটাকার মালিক। নইলে এত মরিচ কেনার টাকা পেলে কোত্থেকে? ওকে দুইটা চটকানা মেরে আসি?’
‘যাও। দুইটা মরিচও নিয়ে যাও। চোখে ডলে দেবে। যেন বিনা দুঃখেও কাঁদতে পারে।’
তিনটা লাল পাকা মরিচ নিয়ে বের হলো ড্রাইভার। হুড়মুড় হাঁটন্ত জনৈককে পাকড়াও করল, ‘মরিচখোর ডাইকা আমার স্যারেরে অপমান করছস তুই। এখন পাঁচশ’ টাকা দিবি নাকি মরিচ-ডলা খাবি?’
‘ওহ মরিচ, গ্রিন চিলি! এতদিন কোথায় ছিলি? মরিচগুলো দিয়ে যান ভাইজান। তারপর আমার কান বরাবর থাবড়া মারেন, পেটে খেলে কানে সয়!’
বিনা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করার পরও লোকটা আনন্দিত! রাগী ড্রাইভার কলার চেপে বলল, ‘রঙ্গতামাশা করিস! টাকা ছাড় তাড়াতাড়ি; তিনটা মরিচের দাম তিনশ টাকা। থাবড়া খাবি ফাও!’
দুই.
হাজার টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ কিনেছেন নজির। চারদিন না যেতেই দাম কমে নামল চারশ টাকায়। এরচেয়ে মাথায় ঠাডা পড়লেই ভালো হতো। নজিরের ভাবনায় ছিল- দাম উপর্যুপরি বাড়তেই থাকবে। ১২০০, ২৪০০, ৩৬০০- এভাবে ওঠা-নামা করবে গণিতের অঙ্ক। তাতে মরিচের মালিক হিসাবে তার দামও বাড়ত। প্রচারমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হতো। টকশোতে ডাক পড়লে কী বলবেন, আগ থেকেই স্ক্রিপ্ট রেডি করেছেন-‘কাঁচামরিচের বংশপরিচয় এখনো আমরা নির্ণয় করতে পারিনি। এটি মসলা নাকি সবজিজাতীয় উদ্ভিদ! দাম কম থাকার কারণে এটি অবহেলিত। ফ্যাশনসচেতন মানুষরা লকেটের অগ্রভাগে কাঁচামরিচ ঝোলাতে পারছেন না। কানের ঝুমকা, মাথার টিকলি, কানফুল হিসাবেও বঙ্গললনারা মরিচ ব্যবহার করতে পারতেন। তাজা ফুলের মালা যদি নারীরা খোঁপায় গুঁজতে পারেন, একগুচ্ছ কাঁচা মরিচ দিয়ে মালা বানিয়ে কেন চুল সাজাবেন না? সমস্যাটা মূল্যকেন্দি ক অবমূল্যায়নে...।’
কল্পনাবিলাসের মধ্যেই নিরাপত্তাকর্মী খবর দিল, একজন সাংবাদিক এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর এক অনতি তরুণ তাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আমি ইউটিউব ছাম্বাদিক; আমাদের চ্যানেলে আপনার একটি ছাক্ষাৎকার প্রচার করতে চাই।’
‘খুব ভালো, বেশ ভালো।’ কাঁধ ঝাঁকালেন নজির।
‘আপনি মণ-মণ, টন-টন কাঁচামরিচ সংগ্রহ করেছেন, আমাদের কাছে খবর আছে...।’
‘ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতেই মরিচ কিনি। পৃথিবীর প্রথম কাঁচামরিচটা জন্মেছিল আমার নানাবাড়িতে। অনেক হাজার বছর আগে...।’
দেড়ঘণ্টার সাক্ষাৎকার শেষে কিছু খরচাপাতি নিয়ে ছাম্বাদিক নিষ্ক্রান্ত হলো। আনন্দে চোখ মুদলেন নজির। আলোচিত ব্যক্তি হওয়া ঠেকানো যাবে না এবার। ফের চনমন করে উঠল তার মন। কাগজগুলো খবর ছেপেছে, ফের বাড়ছে মরিচের দাম!
তিন.
দামের উত্থান-পতনের মধ্যেই পঁচাশি ট্রাক মরিচ কিনে গোপনে নষ্ট করেছেন নজির। অর্থনীতির সূত্র বলে, জোগান না থাকলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। মরিচের দাম কেজি প্রতি কয়েক হাজার টাকা হলে আসল খেলাটা দেখাতে পারবেন তিনি।
উঠতি-পড়তির মধ্যেই আরেকজন ইউটিউব ছাম্বাদিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মরিচ-লীলা ফাঁস করে দিল। শাপেবরই হলো, দেশবাসী এখন নজিরকে ‘মরিচ বাবা’ ডাকে। জন্ম না দিয়েও বাবা হতে পারা সৌভাগ্যেরই লক্ষণ!
shafique_hasan79@yahoo.com
কাঁচামরিচ নিয়ে পাকা কথা
মলাট বৃত্তান্ত
শফিক হাসান
০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বেনজির কাণ্ড যত বেশি ঘটবে দেশে, নজির হকের মতো মানুষের ততই সুখ! সোনার দাম মাত্রাতিরিক্ত বেশি বলেই লোকে নিজ সামর্থ্য (মতান্তরে ফুটানি) জানান দিতে ভরি ভরি সোনা কেনে। রূপসচেতন নারী-পুরুষরা অঙ্গে সোনার গহনা পরে বাড়িয়ে নেয় সামাজিক জ্যোতি।
এবার কাঁচামরিচের কেজি যখন হাজার টাকা অঙ্ক স্পর্শ করল, ঈদানন্দ বোধ করলেন নজির। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেশি থাকাই ভালো, তাতে ধনবান হিসাবে সমাজে আলাদা সম্মান পাওয়া যায়। টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় সুখবরটা শুনেই বাজারে ছুটলেন তিনি। কয়েক দোকান মিলে ৩৫ কেজি কাঁচামরিচ কিনলেন। ক্রয়-যজ্ঞ দেখে ব্যবসায়ীদের চোখ টমোটোর মতো গোল হয়ে উঠল। একজন সাহস দেখিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ছার, মরিচ বিরানির দোকান দিবেন নাকি?’
‘না রে! মরিচ দিয়ে ইমারত বানানো যায় না। সম্ভব হলে সেটাই করতাম। বাড়ির নাম হতো- মরিচ নিবাস, ইংরেজিতে দ্য গ্রিন চিলি রেসিডেন্ট!’ এমন জবাবে কৌতূহল নিবৃত্ত না হলেও সম্মান ও সম্ভ্রমে তার দিকে তাকিয়ে রইল ব্যবসায়ীটি।
গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে নির্দেশনা দিলেন অন্তত দশ কেজি মরিচ যেন গাড়ির পেছন অংশে রাখে, যেন বাইরের লোকজনের চোখে পড়ে। গাড়ির পেছনে তিনটা সৃজনশীল বই রেখেছেন জনদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য; এবার বইয়ের জায়গা হলো সামনের অংশে। ত্বরিৎকর্মা ড্রাইভার কোত্থেকে একটা বই বের করল- মরিচ চাষের কঠিন কৌশল। বইগুলোর সঙ্গে কিছু মরিচ ছিটিয়ে দেওয়া হলো সামনের অংশে। এতেই দর্শনার্থীদের চোখ ডাঁসা লিচু হয়ে উঠতে দেখলেন নজির। আনন্দটা উপভোগের সময় কানে এল ড্রাইভারের প্রভুভক্তি ঋদ্ধ বচন, ‘স্যার, বাইরে লুঙ্গি পরা লোকটা আপনাকে অপমান করেছে।’
‘নিশ্চয়ই মরিচ কেনার সুযোগ পায়নি! দেখুক সে, দেখেও যদি ঝাল-তৃষ্ণা মেটাতে পারে।’
‘বলেছে নিশ্চয়ই ঘুসখোর বা কালোটাকার মালিক। নইলে এত মরিচ কেনার টাকা পেলে কোত্থেকে? ওকে দুইটা চটকানা মেরে আসি?’
‘যাও। দুইটা মরিচও নিয়ে যাও। চোখে ডলে দেবে। যেন বিনা দুঃখেও কাঁদতে পারে।’
তিনটা লাল পাকা মরিচ নিয়ে বের হলো ড্রাইভার। হুড়মুড় হাঁটন্ত জনৈককে পাকড়াও করল, ‘মরিচখোর ডাইকা আমার স্যারেরে অপমান করছস তুই। এখন পাঁচশ’ টাকা দিবি নাকি মরিচ-ডলা খাবি?’
‘ওহ মরিচ, গ্রিন চিলি! এতদিন কোথায় ছিলি? মরিচগুলো দিয়ে যান ভাইজান। তারপর আমার কান বরাবর থাবড়া মারেন, পেটে খেলে কানে সয়!’
বিনা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করার পরও লোকটা আনন্দিত! রাগী ড্রাইভার কলার চেপে বলল, ‘রঙ্গতামাশা করিস! টাকা ছাড় তাড়াতাড়ি; তিনটা মরিচের দাম তিনশ টাকা। থাবড়া খাবি ফাও!’
দুই.
হাজার টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ কিনেছেন নজির। চারদিন না যেতেই দাম কমে নামল চারশ টাকায়। এরচেয়ে মাথায় ঠাডা পড়লেই ভালো হতো। নজিরের ভাবনায় ছিল- দাম উপর্যুপরি বাড়তেই থাকবে। ১২০০, ২৪০০, ৩৬০০- এভাবে ওঠা-নামা করবে গণিতের অঙ্ক। তাতে মরিচের মালিক হিসাবে তার দামও বাড়ত। প্রচারমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হতো। টকশোতে ডাক পড়লে কী বলবেন, আগ থেকেই স্ক্রিপ্ট রেডি করেছেন-‘কাঁচামরিচের বংশপরিচয় এখনো আমরা নির্ণয় করতে পারিনি। এটি মসলা নাকি সবজিজাতীয় উদ্ভিদ! দাম কম থাকার কারণে এটি অবহেলিত। ফ্যাশনসচেতন মানুষরা লকেটের অগ্রভাগে কাঁচামরিচ ঝোলাতে পারছেন না। কানের ঝুমকা, মাথার টিকলি, কানফুল হিসাবেও বঙ্গললনারা মরিচ ব্যবহার করতে পারতেন। তাজা ফুলের মালা যদি নারীরা খোঁপায় গুঁজতে পারেন, একগুচ্ছ কাঁচা মরিচ দিয়ে মালা বানিয়ে কেন চুল সাজাবেন না? সমস্যাটা মূল্যকেন্দি ক অবমূল্যায়নে...।’
কল্পনাবিলাসের মধ্যেই নিরাপত্তাকর্মী খবর দিল, একজন সাংবাদিক এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর এক অনতি তরুণ তাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আমি ইউটিউব ছাম্বাদিক; আমাদের চ্যানেলে আপনার একটি ছাক্ষাৎকার প্রচার করতে চাই।’
‘খুব ভালো, বেশ ভালো।’ কাঁধ ঝাঁকালেন নজির।
‘আপনি মণ-মণ, টন-টন কাঁচামরিচ সংগ্রহ করেছেন, আমাদের কাছে খবর আছে...।’
‘ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতেই মরিচ কিনি। পৃথিবীর প্রথম কাঁচামরিচটা জন্মেছিল আমার নানাবাড়িতে। অনেক হাজার বছর আগে...।’
দেড়ঘণ্টার সাক্ষাৎকার শেষে কিছু খরচাপাতি নিয়ে ছাম্বাদিক নিষ্ক্রান্ত হলো। আনন্দে চোখ মুদলেন নজির। আলোচিত ব্যক্তি হওয়া ঠেকানো যাবে না এবার। ফের চনমন করে উঠল তার মন। কাগজগুলো খবর ছেপেছে, ফের বাড়ছে মরিচের দাম!
তিন.
দামের উত্থান-পতনের মধ্যেই পঁচাশি ট্রাক মরিচ কিনে গোপনে নষ্ট করেছেন নজির। অর্থনীতির সূত্র বলে, জোগান না থাকলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। মরিচের দাম কেজি প্রতি কয়েক হাজার টাকা হলে আসল খেলাটা দেখাতে পারবেন তিনি।
উঠতি-পড়তির মধ্যেই আরেকজন ইউটিউব ছাম্বাদিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মরিচ-লীলা ফাঁস করে দিল। শাপেবরই হলো, দেশবাসী এখন নজিরকে ‘মরিচ বাবা’ ডাকে। জন্ম না দিয়েও বাবা হতে পারা সৌভাগ্যেরই লক্ষণ!
shafique_hasan79@yahoo.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023