এক.
কাদেরের ডান হাতের কনুইয়ের ওপর টিউমারটা বেশ কিছুদিন ধরে যন্ত্রণা দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে সে তার পরিচিত বড় ভাই ডাক্তার বাপ্পির কাছে গিয়েছিল। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন অপারেশন করাতে হবে। কাটা-ছেঁড়ার ভয়ে কাদের আর যায়নি। কিছুদিন হোমিও আর কবিরাজী ওষুধ খেয়েছে। তাতে মনের সান্ত্বনা কেবল, দেহের কোনো শান্তি হয়নি। বাধ্য হয়ে কাদের সিদ্ধান্ত নিল বাপ্পির কাছে যাবে। একদিন বিকালে কাদের বাপ্পির চেম্বারে গিয়ে হাজির হল।
বাপ্পি তখন ব্যাগ গুছিয়ে বের হচ্ছিলেন। কাদেরকে দেখে বাপ্পি বললেন, ‘তোমার টিউমারের কী অবস্থা? এখনো অপারেশন করাওনি?’
‘ভাই, ভয়ে করাইনি। এখন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আপনার কাছে এলাম।’ বাপ্পি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘আজকে তো সম্ভব না। পরিচিত এক রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। তার বাসায় যেতে হবে। তুমি অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়ে পরে এসো। আমাকে এখনি যেতে হবে।’
‘ভাই, অন্তত ওষুধ লিখে দিয়ে যান। রাতে অনেক ব্যথা হয়।’
‘একটা নাপা খেয়ে নিও।’ এই বলে দ্রুত চলে গেলেন বাপ্পি।
দুই.
‘হায় হায়! এ কী অবস্থা আপনার হাতের।’ বাপ্পি নাহারের ডান হাত ধরে আর্তনাদ করে উঠলেন।
নাহার ঠোঁট কামড়ে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বাম হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখেন, এই হাতেও বেশ কয়েকটা হয়েছে?’
বাপ্পি ডান হাত ছেড়ে নাহারের বাম হাতের কনুই পর্যন্ত ভালোভাবে দেখে আহাজারী করে বললেন, ‘এমন সুন্দর ত্বক নিয়ে কেউ অবহেলা করে? আমি তো ফেসবুকে হাতের ছবি ও পোস্ট পড়ে এতোটা খারাপ অবস্থা ভাবি নাই।’
নাহার বলল, ‘আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আপনাদের মতো হৃদয়বান মানুষ থাকতে আমার কিছু হবে না।’ বাপ্পি এবার দুই হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এখনো ব্যথা আছে। আমার ব্যাগে নাপা আছে। দেব একটা?’
‘আপনি একটা খেয়ে নেন।’ বলে খিল খিল করে হাসল নাহার।
বাপ্পি হাত ছেড়ে একটু ইতস্তত হয়ে বললেন, ‘আপনি বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে নিয়ে মজা করছেন।’
‘ভাইয়া, আপনি অযথা রাগ করছেন। আমার ফেসবুকের পোস্ট দেখে অনেকে ইনবক্স করেছেন। কমেন্টে/দুই একজন নাপা খেতে পরামর্শ দিয়েছেন।’
‘আপনি তাদের কথায় ওষুধ খেয়েছেন?’
‘না খেয়ে উপায় কী!’
‘দেখেন আমি চেম্বার বন্ধ করে চলে এসেছি। এসব ওষুধে সারবে না। আপনার হাতের ড্রেসিং করাতে হবে।’
নাহার একটু চমকে বলল, ‘মানে অপারেশন করাতে বলছেন?’
‘ছোটখাটো অপারেশন বলতে পারেন। আমি নিজেই করে দেব।’
‘আমার ভয় হচ্ছে। ওষুধ থাকলে বলেন।’
‘আপনি বিষয়টাকে তাচ্ছিল্য করছেন। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। হাতের লোম সরানোর মতো, কিছুই টের পাবেন না।’
‘কবে যাব তাহলে?’ জানতে চাইল নাহার।
‘আগামিকাল বিকালে চলে আসেন। আমি আপনার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখব।’
‘আজকে রাতে যদি ব্যথা হয়?’
‘একটা নাপা খেয়ে নিও।’
তিন.
‘অপারেশনে ব্যস্ত থাকায় আজ কোনো রোগী দেখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’ বাপ্পির চেম্বারের দরজায় শাটানো এমন নোটিশ দেখে হতবাক হয়ে গেল কাদের। চেম্বারের সামনে বাপ্পির সহযোগির কাছ থেকে অপারেশ থিয়েটারের কথা জেনে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। তার বিশ্বাস অন্য রোগীর সঙ্গে সে নিজের টিউমারের অপারেশন করাতে পারবে।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে একজন অ্যাটেনডেন্সকে দেখে সে বাপ্পির কথা জানতে চাইল।
অ্যাটেনডেন্স বললেন, ‘স্যার উনার ব্যক্তিগত রোগীর অপারেশন করছেন। সময় লাগবে। আজকে দেখা করা যাবে না।’
‘ভাই, আমি উনার পরিচিত ছোটভাই। আপনি গিয়ে আমার কথা বলেন।’
‘আমার চাকরি থাকবে না। আপনি বরং এখানে অপেক্ষা করেন। স্যার বের হলে দেখা করতে পারবেন।’ এ বলে আ্যাটেনডেন্স একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন কাদেরকে।
সময় যাচ্ছিল না কাদেরের। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুক স্ক্রল শুরু করল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল বান্ধবী নাহারের একটা পোস্ট।
ডান হাতের ছবি সম্বলিত পোস্টের নিচে কমেন্ট পড়তে শুরু করল কাদের।
ফারুক আহমেদ নামে একজন লিখেছেন-আহারে! কতো সুন্দর হাত! এমন হাতের যন্ত্রনা দেখলে কলিজায় লাগে।
রাশেদ লিখেছেন-আমার চেম্বারে চলে আসেন। ইনবক্সে প্রাথমিক চিকিৎিসা ও চেম্বারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
জমির পরামর্শ দিয়েছেন-একটা নাপা খেয়ে নিও।
কমেন্ট পড়তে পড়তে কাদের মুচকি হেসে ভাবল শুধু সে ছাড়া নাহারের ফেসবুকের সব বন্ধুই দেখছি ডাক্তারি জানে।
এমন সময় বাপ্পি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলেন। কাদেরকে দেখে বাপ্পি চমকে উঠে বললেন, ‘তুমি এখানে?’
‘ভাই, চেম্বারে না পেয়ে চলে এলাম। আমার টিউমারের অপারেশন করে দেন। ব্যথা কমছে না।’
বাপ্পি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আজকে সম্ভব না। ফোনে যোগাযোগ করে পরে একদিন এসো।’
ঠিক তখনি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলো নাহার। তার দুই হাতে
ব্যান্ডেজ করা।
কাদের তাকে দেখে চমকে উঠে বলল, ‘কী রে, তুই এখানে? হাতে কী হল?’
নাহার মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না রে। হাতে ঘামাছি হয়েছিল। ঘামাছির অপারেশন করিয়েছি।’