কাব্যপ্রেমিক আবু বকর রা.
পৃথিবীর শুরু থেকেই আরবদের কাব্যসাহিত্য ছিল সমাদৃত। কবিতা তাদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-বাস্তবতা, আশা-আনন্দ, শত্রুতা-মিত্রতার বাহন।
কবিতার ভাষায় তারা ফুটিয়ে তুলেছেন মানব মনন, প্রেম, অনুভূতি, আবেগ, ভালোবাসা, সম্প্রদায়, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবগাথা। তাদের কবিতায় ছিল ছন্দের মহিমা ও শব্দবৈভবের কারিশমা, নির্মাণশৈলী ও বর্ণনায়নের রূপময়তা।
আরবের মধ্যে মক্কা ছিল কবি ও কবিতার উর্বর ভূমি। আর মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন নবীজি মুহাম্মদ (সা.)। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ও সাহিত্যমনস্ক।
কবিতার ক্ষেত্রে রাসূলের সাহাবিখ্যাত ‘ত্রয়ী’ হাসসান ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব ইবনে মালিক (রা.)-এর পারঙ্গমতা সাহিত্য মহলে সুবিদিত। প্রধান চার খলিফার তিনজনই সাহিত্যালয়ে ঝলমলে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কবিতা আছে।
কবিতার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি, সমালোচনা ও মতামত ইসলামি সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থ চিন্তাধারার রূপায়ণ করে। সাহিত্যকে সুসংহত ও উপাদেয় করতে তার ভূমিকা ছিল অনেক বেশি।
কবিতার মধ্যে নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা বা তাওহিদ বিশ্বাসকে আঘাত জাতীয় কিছু না থাকলে সেই কবিতা তিনি শুনতেন, সূক্ষ্মদর্শীর মতো সমালোচনা ও পর্যালোচনা করে কবির প্রশংসা করতেন। স্বভাব কবি কিংবা কাব্যচর্চা করা কখনো তার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে তিনি কবিতা লিখেছেন এবং আবৃত্তি করেছেন।
আবু বকর (রা.) যেসব কবিতা লিখেছেন এবং পাক জবানে আবৃত্তি করেছেন সেসব কবিতার গল্প শুনাই। আয়েশা (রা.)-এর সূত্রে ইমাম বুখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, মদিনায় হিজরতের পর একদিন আবু বকর ও বেলাল (রা.) প্রচণ্ড জ্বরাক্রান্ত হলে আয়েশা (রা.) তাদের দেখতে এলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন? হে বেলাল, আপনি কেমন আছেন?’ তখন আবু বকর (রা.) নিুের পঙ্ক্তিটি আবৃত্তি করলেন- ‘স্বজন মাঝে আশীর্বাদে/সিক্ত যবে প্রভাতকালে। মৃত্যু হয়তো নিকটতর/জুতার ফিতার চেয়েও কাছে।’
ইমাম বুখারি (রহ.) আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, মদিনায় হিজরতের সময় আবু বকর (রা.) যখন নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ‘গারে সাওরে’ ছিলেন, তখন তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেছেন- ‘অভয় দিয়ে বলেন রাসূল/হইনি আমিও ধৈর্যহারা। ছিলাম তখন গুহার ভিতর/নিশিসম আঁধার ঘেরা। ভয় করো না কোনো কিছুর/সঙ্গী মোদের আল্লাহ যেথা। দ্বীনের বিজয় হবেই জেনো, আল্লাহতায়ালার নিজের ওয়াদা।’
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সূত্রে ইমাম বায়হাকী (রহ.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের সময় নবীজি (সা.) যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন, সে সময় আবু বকর (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আবু বকর, হাসসান ইবনে সাবেত যেন কী বলেছিল?
তখন আবু বকর হাসসান ইবনে সাবেত (রা.)-এর একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন- ‘যদি তাদের দেখনিক/আপনাকে হারিয়ে ফেলি। কাদা পথে আসে যারা, দুপাশ দিয়ে উড়িয়ে ধুলি। জিন চরানো অশ্বেরা সব/লাগাম ফিতেয় লড়াই করে। ওড়না দিয়ে রমণীরা/তাদের গালে আঘাত করে।’
আসহাবে ফিলের আক্রমণের দু’বছর চার মাস পর মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রের বনু তামীমে আবু বকর (রা.)-এর জন্ম হয়। ১৩ হিজরির ৮ জুমাদাল উখরার মঙ্গলবার রাতে ৬৩ বছর বয়সে হজরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
কাব্যপ্রেমিক আবু বকর রা.
পৃথিবীর শুরু থেকেই আরবদের কাব্যসাহিত্য ছিল সমাদৃত। কবিতা তাদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-বাস্তবতা, আশা-আনন্দ, শত্রুতা-মিত্রতার বাহন।
কবিতার ভাষায় তারা ফুটিয়ে তুলেছেন মানব মনন, প্রেম, অনুভূতি, আবেগ, ভালোবাসা, সম্প্রদায়, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবগাথা। তাদের কবিতায় ছিল ছন্দের মহিমা ও শব্দবৈভবের কারিশমা, নির্মাণশৈলী ও বর্ণনায়নের রূপময়তা।
আরবের মধ্যে মক্কা ছিল কবি ও কবিতার উর্বর ভূমি। আর মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন নবীজি মুহাম্মদ (সা.)। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ও সাহিত্যমনস্ক।
কবিতার ক্ষেত্রে রাসূলের সাহাবিখ্যাত ‘ত্রয়ী’ হাসসান ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব ইবনে মালিক (রা.)-এর পারঙ্গমতা সাহিত্য মহলে সুবিদিত। প্রধান চার খলিফার তিনজনই সাহিত্যালয়ে ঝলমলে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কবিতা আছে।
কবিতার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি, সমালোচনা ও মতামত ইসলামি সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থ চিন্তাধারার রূপায়ণ করে। সাহিত্যকে সুসংহত ও উপাদেয় করতে তার ভূমিকা ছিল অনেক বেশি।
কবিতার মধ্যে নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা বা তাওহিদ বিশ্বাসকে আঘাত জাতীয় কিছু না থাকলে সেই কবিতা তিনি শুনতেন, সূক্ষ্মদর্শীর মতো সমালোচনা ও পর্যালোচনা করে কবির প্রশংসা করতেন। স্বভাব কবি কিংবা কাব্যচর্চা করা কখনো তার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে তিনি কবিতা লিখেছেন এবং আবৃত্তি করেছেন।
আবু বকর (রা.) যেসব কবিতা লিখেছেন এবং পাক জবানে আবৃত্তি করেছেন সেসব কবিতার গল্প শুনাই। আয়েশা (রা.)-এর সূত্রে ইমাম বুখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, মদিনায় হিজরতের পর একদিন আবু বকর ও বেলাল (রা.) প্রচণ্ড জ্বরাক্রান্ত হলে আয়েশা (রা.) তাদের দেখতে এলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন? হে বেলাল, আপনি কেমন আছেন?’ তখন আবু বকর (রা.) নিুের পঙ্ক্তিটি আবৃত্তি করলেন- ‘স্বজন মাঝে আশীর্বাদে/সিক্ত যবে প্রভাতকালে। মৃত্যু হয়তো নিকটতর/জুতার ফিতার চেয়েও কাছে।’
ইমাম বুখারি (রহ.) আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, মদিনায় হিজরতের সময় আবু বকর (রা.) যখন নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ‘গারে সাওরে’ ছিলেন, তখন তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেছেন- ‘অভয় দিয়ে বলেন রাসূল/হইনি আমিও ধৈর্যহারা। ছিলাম তখন গুহার ভিতর/নিশিসম আঁধার ঘেরা। ভয় করো না কোনো কিছুর/সঙ্গী মোদের আল্লাহ যেথা। দ্বীনের বিজয় হবেই জেনো, আল্লাহতায়ালার নিজের ওয়াদা।’
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সূত্রে ইমাম বায়হাকী (রহ.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের সময় নবীজি (সা.) যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন, সে সময় আবু বকর (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আবু বকর, হাসসান ইবনে সাবেত যেন কী বলেছিল?
তখন আবু বকর হাসসান ইবনে সাবেত (রা.)-এর একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন- ‘যদি তাদের দেখনিক/আপনাকে হারিয়ে ফেলি। কাদা পথে আসে যারা, দুপাশ দিয়ে উড়িয়ে ধুলি। জিন চরানো অশ্বেরা সব/লাগাম ফিতেয় লড়াই করে। ওড়না দিয়ে রমণীরা/তাদের গালে আঘাত করে।’
আসহাবে ফিলের আক্রমণের দু’বছর চার মাস পর মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রের বনু তামীমে আবু বকর (রা.)-এর জন্ম হয়। ১৩ হিজরির ৮ জুমাদাল উখরার মঙ্গলবার রাতে ৬৩ বছর বয়সে হজরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক