সংযমী করে সিয়াম
বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের।
অন্য সব রিপু সংযমের কথা না হয় বাদই দিলাম, শুধু খাওয়ার সংযমের কথাই যদি বলি, তাহলেও এর চেয়ে অসংযমের মাস আর নেই। অন্য সাধারণ মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের মানুষের খরচ অনেক বেশি হয়। রোজা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় পাঁচ ইবাদতের একটি। অথচ এ মাসেই ইসলামের চেতনার সবচেয়ে বড় ব্যত্যয় ঘটে।
রমজান রহমত, বরকত আর মাগফিরাতের মাস। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে রমজান পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজান মানুষকে মূলত সংযম শিক্ষা দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাস এলে জান্নাতের দ্বারগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’
এত গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসের মূল ইবাদত হলো রোজা। দৃশ্যত রোজা হলো, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। ধর্মীয় বিবেচনা বাদ দিলেও বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় উপোস করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমরা যে সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তারের কথা শুনে ডায়েটিং করি। রোজা তো সেই ডায়েটিংয়েরই ধর্মীয় বিন্যাস।
রোজার মূল চেতনা হলো সংযম। তবে এ সংযম শুধু না খেয়ে থাকার নয়, এ সংযম হলো আত্মশুদ্ধির। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য সব ধরনের রিপু থেকে নিজেকে সংযত রাখাই, পরিপূর্ণ সংযম। শুধু জিহ্বার সংযম নয়, হতে হবে আত্মার সংযম। কী করলে রোজা ভাঙবে, কী করলে রোজা পোক্ত হবে; তার বিস্তারিত বিবরণ আছে ধর্মে। কিন্তু আমরা শুধু সকাল-সন্ধ্যা উপোস থাকাকেই রোজা হিসাবে ধরে নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগি।
রমজানে সংযমের যে ধারণা, তার সঙ্গে সংযমের প্রকৃত চেতনার মিল খুব সামান্যই। আমি অনেককে চিনি, যারা রোজা রেখে সারা দিন সময় কাটান হিন্দি সিনেমা দেখে। রোজা রেখে ঘুস খান, মিথ্যা কথা বলেন, মানুষের ক্ষতি করেন, দুর্নীতি করেন; এমন মানুষ তো ভুরি ভুরি। বরং রমজান এলে ঘুসের রেট বেড়ে যায়।
অন্য দেশের কথা জানি না, বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের। রমজানে আমরা এমন অনেক খাবার খাই, যা সারা বছর খাই না। আরবের খোরমা খেজুর ছাড়া আমাদের ইফতার হয় না। ছোলা, বেগুনি, জিলাপি, হালিম-এমন অনেক আইটেম আছে; যা সারা বছরে বিক্রি হয়, রমজানে হয় তার কয়েকগুণ বেশি।
বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় উপোস থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু উপোস ভেঙে আমরা ইফতারে যে খাবার খাই, তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। সারা দিন না খেয়ে যতটুকু উপকার হয়, ইফতারে ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবার খেয়ে ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি। ইফতার পার্টি আর সেহরির নামে অপচয়ের যে প্রতিযোগিতা চলে তার চেয়ে অসংযমের উদাহরণ বিশ্বে বিরল।
এবারের রমজান এসেছে অন্যরকম বারতা নিয়ে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চরম আকার ধারণ করেছে। ইসলাম আমাদের সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। তাই আমরা যদি বাড়তি অর্থটা কোনো দরিদ্র পরিবারকে দিয়ে দেই, সেই পরিবারটি বেঁচে যায়। এবার যদি বাজারটা একটু কম করে, পাশের জনকে সাহায্য করি; তার পেটে দুটি দানা পড়ে। এবারের রমজান হোক সত্যিকারের সংযমের, এবারের রমজান হোক মানবতার।
লেখক : কলামিস্ট-গবেষক
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সংযমী করে সিয়াম
বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের।
অন্য সব রিপু সংযমের কথা না হয় বাদই দিলাম, শুধু খাওয়ার সংযমের কথাই যদি বলি, তাহলেও এর চেয়ে অসংযমের মাস আর নেই। অন্য সাধারণ মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের মানুষের খরচ অনেক বেশি হয়। রোজা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় পাঁচ ইবাদতের একটি। অথচ এ মাসেই ইসলামের চেতনার সবচেয়ে বড় ব্যত্যয় ঘটে।
রমজান রহমত, বরকত আর মাগফিরাতের মাস। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে রমজান পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মাস। রমজান মানুষকে মূলত সংযম শিক্ষা দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাস এলে জান্নাতের দ্বারগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’
এত গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসের মূল ইবাদত হলো রোজা। দৃশ্যত রোজা হলো, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। ধর্মীয় বিবেচনা বাদ দিলেও বছরের নির্দিষ্ট একটা সময় উপোস করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমরা যে সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তারের কথা শুনে ডায়েটিং করি। রোজা তো সেই ডায়েটিংয়েরই ধর্মীয় বিন্যাস।
রোজার মূল চেতনা হলো সংযম। তবে এ সংযম শুধু না খেয়ে থাকার নয়, এ সংযম হলো আত্মশুদ্ধির। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য সব ধরনের রিপু থেকে নিজেকে সংযত রাখাই, পরিপূর্ণ সংযম। শুধু জিহ্বার সংযম নয়, হতে হবে আত্মার সংযম। কী করলে রোজা ভাঙবে, কী করলে রোজা পোক্ত হবে; তার বিস্তারিত বিবরণ আছে ধর্মে। কিন্তু আমরা শুধু সকাল-সন্ধ্যা উপোস থাকাকেই রোজা হিসাবে ধরে নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগি।
রমজানে সংযমের যে ধারণা, তার সঙ্গে সংযমের প্রকৃত চেতনার মিল খুব সামান্যই। আমি অনেককে চিনি, যারা রোজা রেখে সারা দিন সময় কাটান হিন্দি সিনেমা দেখে। রোজা রেখে ঘুস খান, মিথ্যা কথা বলেন, মানুষের ক্ষতি করেন, দুর্নীতি করেন; এমন মানুষ তো ভুরি ভুরি। বরং রমজান এলে ঘুসের রেট বেড়ে যায়।
অন্য দেশের কথা জানি না, বাংলাদেশে রমজানে সবচেয়ে অসংযমী আচরণ হয়। রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের। রমজানে আমরা এমন অনেক খাবার খাই, যা সারা বছর খাই না। আরবের খোরমা খেজুর ছাড়া আমাদের ইফতার হয় না। ছোলা, বেগুনি, জিলাপি, হালিম-এমন অনেক আইটেম আছে; যা সারা বছরে বিক্রি হয়, রমজানে হয় তার কয়েকগুণ বেশি।
বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় উপোস থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু উপোস ভেঙে আমরা ইফতারে যে খাবার খাই, তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। সারা দিন না খেয়ে যতটুকু উপকার হয়, ইফতারে ভাজা-পোড়া, তৈলাক্ত খাবার খেয়ে ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি। ইফতার পার্টি আর সেহরির নামে অপচয়ের যে প্রতিযোগিতা চলে তার চেয়ে অসংযমের উদাহরণ বিশ্বে বিরল।
এবারের রমজান এসেছে অন্যরকম বারতা নিয়ে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চরম আকার ধারণ করেছে। ইসলাম আমাদের সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। তাই আমরা যদি বাড়তি অর্থটা কোনো দরিদ্র পরিবারকে দিয়ে দেই, সেই পরিবারটি বেঁচে যায়। এবার যদি বাজারটা একটু কম করে, পাশের জনকে সাহায্য করি; তার পেটে দুটি দানা পড়ে। এবারের রমজান হোক সত্যিকারের সংযমের, এবারের রমজান হোক মানবতার।
লেখক : কলামিস্ট-গবেষক