সমুজ্জ্বল হোক সম্প্রীতির বন্ধন
মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ।
এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর অন্যায় অত্যাচার করা?
বিশ্বনবি (সা.)কে আল্লাহতায়ালা কেবল মক্কা শহর বা সেই দেশ বা কেবল সেই যুগের লোকদের জন্যই আবির্ভূত করেননি। তিনি (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহানবির শিক্ষা কতই উন্নত ছিল যে, বল-প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত তিনি বারণ করেছেন।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে তিনি (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলমান হলো সেই ব্যক্তি, যার হাত এবং জিহ্বা থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে’ (বোখারি-মুসলিম)। বস্তুত ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলির অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না-এ কথা অনেকেই বাস্তব ক্ষেত্রে বেমালুম ভুলে বসেছে। যদি আমার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদ না থাকে তাহলে আমার কার্যে প্রমাণ করে যে আমি শান্তির দূত মহানবি (সা.)-এর প্রকৃত অনুসারী নই।
মহানবি (সা.)-এর পবিত্র জীবন পরমতসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতার অগণিত উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। ইসলামের চরম শত্রু ইকরামার ঘটনা দেখুন! যুদ্ধাপরাধের কারণে যাকে হত্যার নির্দেশ জারি হয়ে গিয়েছিল, তার স্ত্রী মহানবি (সা.)-এর কাছে তার জন্য ক্ষমাপ্রত্যাশী হলে তিনি (সা.) একান্ত øেহপরবশ হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন। ইকরামার স্ত্রী তাকে নিয়ে মহানবি (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হলে ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?
তিনি (সা.) বলেন, সত্যিই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আমি যদি আমার ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকি তবুও? অর্থাৎ আমি যদি মুসলমান না হই তবুও? এই শিরকের অবস্থায় আপনি আমাকে ক্ষমা করছেন কি? তখন তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। মহানবি (সা.)-এর সুমহান ব্যবহার ও অনুগ্রহের এ নিদর্শন দেখে ইকরামা মুসলমান হয়ে যায়। (আস সিরাতুল হালবিয়্যাহ্, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯)।
ইসলাম এরূপ উত্তম চরিত্র এবং ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতা প্রদানের সুবাদে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তম ব্যবহার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার এ তির এক নিমিষেই ইকরামার মতো মানুষকেও ঘায়েল করে ফেলেছিল।
মহানবি (সা.) বন্দি এবং ক্রীতদাসদেরও এ সুযোগ প্রদান করেছিলেন, তোমরা যে ধর্ম চাও গ্রহণ করতে পার। যেমন সুমামাহ বিন উসাল বনু হানীফার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিল। এ লোক মহানবি (সা.)কে হত্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এরপর সাহাবিদের একটি দলকে সে ঘেরাও করে শহিদ করেছিল।
গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে মহানবি (সা.)-এর সামনে নিয়ে আসা হলে তিনি (সা.) তাকে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার সঙ্গে কী ব্যবহার করা হবে বলে তোমার মনে হয়। সে বলে, আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন রক্তপাতকারীকে হত্যা করবেন আর আপনি যদি কৃপা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তির প্রতি করুণা করবেন যে অনুগ্রহের মূল্য দিতে জানে। লাগাতার তিন দিন মহানবি (সা.) আসেন এবং সুমামাহর কাছে এই একই প্রশ্ন করতে থাকেন আর সুমামাহও একই উত্তর দিতে থাকে।
অবশেষে তৃতীয় দিন মহানবি (সা.) বলেন, ‘একে মুক্ত করে দাও’। এরপর সে মসজিদের কাছে খেজুরের বাগানে যায় ও গোসল করে এবং মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে আর বলে, হে মুহাম্মাদ (সা.) খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে অপছন্দনীয় ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা হলো, আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো আপনার চেহারা। খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার কাছে সবচেয়ে অপছন্দের ছিল আপনার ধর্ম কিন্তু বর্তমান অবস্থা হলো, আমার প্রিয়তম ধর্ম হলো আপনার আনীত ধর্ম। খোদার কসম! আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এই শহরটিই আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর। (বোখারি)
মহানবি (সা.)-এর মাধ্যমে বিশ্বের জাতিগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ পূর্বে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহতায়ালার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। মহানবি (সা.) নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
যেমন তিনি (সা.) বলেছেন ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রেষ্ঠনবির শিক্ষা অনুসরণ করে চলার ও তার শিক্ষা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সমুজ্জ্বল হোক সম্প্রীতির বন্ধন
মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ।
এতে আল্লাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর অন্যায় অত্যাচার করা?
বিশ্বনবি (সা.)কে আল্লাহতায়ালা কেবল মক্কা শহর বা সেই দেশ বা কেবল সেই যুগের লোকদের জন্যই আবির্ভূত করেননি। তিনি (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহানবির শিক্ষা কতই উন্নত ছিল যে, বল-প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত তিনি বারণ করেছেন।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে তিনি (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলমান হলো সেই ব্যক্তি, যার হাত এবং জিহ্বা থেকে অন্যেরা নিরাপদ থাকে’ (বোখারি-মুসলিম)। বস্তুত ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলির অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না-এ কথা অনেকেই বাস্তব ক্ষেত্রে বেমালুম ভুলে বসেছে। যদি আমার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদ না থাকে তাহলে আমার কার্যে প্রমাণ করে যে আমি শান্তির দূত মহানবি (সা.)-এর প্রকৃত অনুসারী নই।
মহানবি (সা.)-এর পবিত্র জীবন পরমতসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতার অগণিত উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। ইসলামের চরম শত্রু ইকরামার ঘটনা দেখুন! যুদ্ধাপরাধের কারণে যাকে হত্যার নির্দেশ জারি হয়ে গিয়েছিল, তার স্ত্রী মহানবি (সা.)-এর কাছে তার জন্য ক্ষমাপ্রত্যাশী হলে তিনি (সা.) একান্ত øেহপরবশ হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন। ইকরামার স্ত্রী তাকে নিয়ে মহানবি (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হলে ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?
তিনি (সা.) বলেন, সত্যিই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আমি যদি আমার ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকি তবুও? অর্থাৎ আমি যদি মুসলমান না হই তবুও? এই শিরকের অবস্থায় আপনি আমাকে ক্ষমা করছেন কি? তখন তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। মহানবি (সা.)-এর সুমহান ব্যবহার ও অনুগ্রহের এ নিদর্শন দেখে ইকরামা মুসলমান হয়ে যায়। (আস সিরাতুল হালবিয়্যাহ্, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯)।
ইসলাম এরূপ উত্তম চরিত্র এবং ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতা প্রদানের সুবাদে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তম ব্যবহার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার এ তির এক নিমিষেই ইকরামার মতো মানুষকেও ঘায়েল করে ফেলেছিল।
মহানবি (সা.) বন্দি এবং ক্রীতদাসদেরও এ সুযোগ প্রদান করেছিলেন, তোমরা যে ধর্ম চাও গ্রহণ করতে পার। যেমন সুমামাহ বিন উসাল বনু হানীফার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিল। এ লোক মহানবি (সা.)কে হত্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এরপর সাহাবিদের একটি দলকে সে ঘেরাও করে শহিদ করেছিল।
গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে মহানবি (সা.)-এর সামনে নিয়ে আসা হলে তিনি (সা.) তাকে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার সঙ্গে কী ব্যবহার করা হবে বলে তোমার মনে হয়। সে বলে, আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন রক্তপাতকারীকে হত্যা করবেন আর আপনি যদি কৃপা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তির প্রতি করুণা করবেন যে অনুগ্রহের মূল্য দিতে জানে। লাগাতার তিন দিন মহানবি (সা.) আসেন এবং সুমামাহর কাছে এই একই প্রশ্ন করতে থাকেন আর সুমামাহও একই উত্তর দিতে থাকে।
অবশেষে তৃতীয় দিন মহানবি (সা.) বলেন, ‘একে মুক্ত করে দাও’। এরপর সে মসজিদের কাছে খেজুরের বাগানে যায় ও গোসল করে এবং মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে আর বলে, হে মুহাম্মাদ (সা.) খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে অপছন্দনীয় ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা হলো, আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো আপনার চেহারা। খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার কাছে সবচেয়ে অপছন্দের ছিল আপনার ধর্ম কিন্তু বর্তমান অবস্থা হলো, আমার প্রিয়তম ধর্ম হলো আপনার আনীত ধর্ম। খোদার কসম! আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এই শহরটিই আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর। (বোখারি)
মহানবি (সা.)-এর মাধ্যমে বিশ্বের জাতিগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ পূর্বে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহতায়ালার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। মহানবি (সা.) নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
যেমন তিনি (সা.) বলেছেন ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রেষ্ঠনবির শিক্ষা অনুসরণ করে চলার ও তার শিক্ষা নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com