ধর্মে কোনো পোশাক নির্ধারিত নেই

 মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান 
০২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামি শরিয়ত মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মাপ বা ডিজাইনের পোশাক আবশ্যিক করে দেয়নি, তবে এমন কিছু শর্ত ও মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের পক্ষেই পালন করা সম্ভব। এ মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে স্থান, কাল, পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুযায়ী যে কোনো পোশাকই ইসলামে জায়েজ। তাই পোশাকের প্রশ্নে বল্গাহীনতা ও অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি কোনোটাই কাম্য নয়।

পোশাক মানবসভ্যতার এক অপরিহার্য উপকরণ। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সব সভ্য মানুষ পোশাক ব্যবহার করে আসছে। পোশাক মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকিদা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধেরও পরিচয় বহন করে। অন্যসব বিষয়ের মতো পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাড়াবাড়ি বা উগ্রতা নেই। জীবনের অন্য দিকের মতো এ ক্ষেত্রেও ইসলামের দৃষ্টি মানব কল্যাণের চিরন্তন লক্ষ্যাভিসারী।

মানবসভ্যতার জনক হজরত আদম (আ.) থেকেই পোশাকের ব্যবহার ছিল। আদি মানবরা পোশাক হিসাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশুচর্ম ব্যবহার করত। তাদের সম্পর্কে নগ্নতা ও অসভ্যতার যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, তা সম্পূর্ণ অমূলক। এর অন্তরালে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আগেকার সব নবি-রাসূল ও তাদের উম্মতদের অসভ্য ও বর্বর প্রমাণের হীন উদ্দেশ্য নিহিত থাকতে পারে। পোশাক হিসাবে কাপড়ের বুনন ও ব্যবহার শুরু হয়েছে হজরত ইদরিস (আ.)-এর যুগ থেকে। বর্ণিত রয়েছে, ‘হুওয়া (ইদরিস) আওয়ালু মান খাতাস ছিয়াবা ওয়া লাবিসাহ’ অর্থাৎ প্রথম হজরত ইদরিসই (আ.) কাপড় সেলাই করেন এবং পরিধান করেন।

ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম বিজয়ের পর বাংলার পোশাক ও সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসে। এক সময় এ অঞ্চলে পুরুষদের প্রিয় পোশাক হিসাবে সেলাই করা লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, ধুতি ও নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ি ও ব্লাউজের ব্যবহার প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ দেশের পুরুষরা পশ্চিমা রীতির শার্ট, প্যান্ট, স্যুট ও টাই পরা শুরু করে। অন্যদিকে মেয়েরা শাড়ির পরিবর্তে আরবীয় ধরনের ফ্রক, সালোয়ার-কামিজ ও অন্যান্য ডিজাইনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পরিবর্তনের এ ধারা বর্তমানে আরও বেশি গতিশীল।

পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে ধর্ম ও জাতীয়তার গভীর প্রভাব রয়েছে। ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণে হিন্দুরা ধুতি, পৈতা, খ্রিষ্টানরা ক্রুসচিহ্নিত পোশাক এবং বৌদ্ধরা গেরুয়া কাপড়ের পোশাক পরেন। মুসলমানরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, জুব্বা, টুপি ও পাগড়ি পরেন, বিশেষত উপমহাদেশে একে সাধারণ এক ইসলামি পোশাক মনে করা হয়। তবে চূড়ান্ত কথা হলো ধর্মের নির্ধারিত কোনো পোশাক নেই। এক্ষেত্রে প্রামাণ্য আয়তটি হলো-‘হে আদম সন্তান! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এমন পোশাক (পরিধানের বিধান) নাজিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখবে এবং যা হবে ভূষণ। আর তাকওয়ার পোশাক, তা-ই কল্যাণকর। এ হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। আশা করা যায় তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সূরা আরাফ : ২৬)। এ আয়াত থেকে পোশাকের তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়। অর্থাৎ পোশাক মানুষের সতরকে আবৃত করে রাখবে। পুরুষের সতর হচ্ছে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত আর নারীর সতর নারীদের পরিবেশে বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং বাইরের পরিবেশে দু-হাতের তালু, দু-পায়ের পাতা ও মুখমণ্ডল ছাড়া পুরো দেহ। এটা ঢেকে রাখা ফরজ। সুতরাং যে পোশাক মানুষের সতর (লজ্জাস্থান) আবৃত করে না, তা পোশাক হতে পারে না।

পোশাক অবশ্যই ভূষণ বা শোভাবর্ধক ও সৌন্দর্য বিকাশের মাধ্যমে হবে। আল্লাহতায়ালা পোশাকের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ‘রিশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর ব্যবহারিক অর্থ হলো ঔজ্জ্বল্য, চাকচিক্য ও শোভাবর্ধক। অভিধানে ‘রিশ’ শব্দের অর্থ হলো, পাখির পালকের মতোই, এ কারণে মানুষের পোশাক বাহ্যত কিরূপ হবে তা বোঝানোর জন্য ওই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইমাম রাজি বলেন, ‘রিশ’ দ্বারা সৌন্দর্যবর্ধক পোশাককে বোঝানো হয়েছে। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তির সৌন্দর্যবোধ, ভদ্রতা, শালীনতা, রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং যে পোশাক ব্যক্তিকে শালীন ও সুন্দর করে না, তা কুরআন সমর্থিত পোশাক নয়। অবশ্য সৌন্দর্য ও শোভার ক্ষেত্রে মানুষের রুচি পরিবর্তনশীল। স্থান, কাল, আবহাওয়া ও মানসিক অবস্থার দৃষ্টিতে এতে অনেক পার্থক্য ও পরিবর্তন হতে পারে। এ কারণে পোশাকের ধরন ও কাটিং পরিবর্তনশীল।

আল কুরআনে পোশাকের ক্ষেত্রে তাকওয়ার উল্লেখ রয়েছে। অতএব, পোশাক শুধু সতর ঢাকা এবং সৌন্দর্যবর্ধকই নয়, এটি একটি মনোদৈহিক বিষয়ও। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তির রুচিবোধ ও মন-মানসিকতার প্রকাশ ঘটে।

ইসলাম পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে যেমনি উদারতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি কিছু মূলনীতিও নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা সভ্যতা, শালীনতা রক্ষায় একান্ত প্রয়োজন। ইসলামের সে মূলনীতিগুলো পালন করে নারী-পুরুষের জন্য যে কোনো পোশাকই পরিধান করা অনুমোদনযোগ্য। পোশাক প্রশ্নে এই হলো ইসলামের ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্য নীতি। তথাপি এত বৈচিত্র্যের মধ্যেও পোশাকে ঐক্য থাকবে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর দিকনির্দেশনা পালনে এবং পোশাকের ব্যাপারে শরিয়ত প্রদত্ত শর্ত মেনে চলার মধ্যেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি মেনে পোশাকের ব্যবহার করতে হবে।

লেখক : ধর্মীয় গবেষক ও কলামিস্ট

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন