ঝাড়-ফুঁক ইসলাম কী বলে
উবায়দুল হক খান
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহতায়ালা রোগব্যাধি সৃষ্টি করেছেন। রোগব্যাধির আরোগ্যও তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনিই রোগাক্রান্ত করেন আবার তিনিই সুস্থ করেন।
আমরা যখন কোনো সমস্যায় পড়ি অথবা অসুস্থ হই, এর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা তাকদিরের পরিপন্থি নয়। কেননা, সেই বস্তুর গুণটা আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। ওষুধের গুণটা আল্লাহরই সৃষ্টি। সুতরাং যখন আমরা ওষুধ ব্যবহার করলাম, ঝাড়-ফুঁক বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম তখন আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের মধ্যেই থাকলাম।
আমরা দেখি একই ওষুধ একই রোগের জন্য একজনকে কাজ করছে আরেকজনের কাজ করছে না, এ দ্বারা বোঝা যায় আরোগ্যদানকারী হলেন মহান আল্লাহতায়ালা। আল্লাহ যার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটাই হবে। ঝাড়-ফুঁক যদি কুরআনের আয়াত বা হাদিসে বর্ণিত কোনো দোয়ার মাধ্যমে হয় তাহলে এটা বৈধ।
মূলত ঝাড়-ফুঁক হলো আল্লাহর কাছে আরোগ্য কামনার দোয়া। সুতরাং আল্লাহ তা কবুল করতে পারেন এবং রোগীকে সুস্থ করতে পারেন। ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা অথবা না করা-এ সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ঝাড়-ফুঁক অথবা ওষুধ যাই আমরা গ্রহণ করি, মূল বিশ্বাস রাখতে হবে আরোগ্যদানকারী আল্লাহ। অন্যথায় এর কোনোটিই গ্রহণ করা বৈধ নয়।
যেসব মন্ত্র বা ঝাড়-ফুঁকের অর্থ বোধগম্য নয় অথবা কুফরি বাক্য দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হয় সেটা গ্রহণ করা বৈধ নয়। অনুরূপ কোনো কাফের বা মুশরিকের কাছ থেকে তাবিজ-কবচ গ্রহণ করা, ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ নয়।
অনেক লোক এমনকি আলেমদের অনেকেও মনে করে থাকেন, কুরআন ও সুন্নাহ শুধু মানুষের অন্তরের রোগের চিকিৎসাকারী। দৈহিক রোগের চিকিৎসায় এগুলোর [কুরআন-সুন্নাহর] কোনো ভূমিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে এটা একটা ভুল ধারণা। কুরআন ও সুন্নাহ মানুষের অন্তর ও দেহ উভয়ের চিকিৎসার সফল ব্যবস্থাপত্র প্রদানকারী। হ্যাঁ! পার্থক্য এতটুকু, মানুষের অন্তর যেমন তার মূল, তেমনি তার অন্তরের চিকিৎসাও কুরআন-সুন্নাহর মূল লক্ষ্য।
মানুষের শারীরিক সমস্যার সমাধান প্রদান কুরআন সুন্নাহর মূল উদ্দেশ্য নয়; গৌণ। কেউ যদি তার শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কুরআন-সুন্নাহর ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কাজ করে, তাহলে সে অবশ্যই তার শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন-‘মক্কায় এক সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমি না কোনো চিকিৎসকের সন্ধান পাচ্ছিলাম, না আমার কাছে কোনো ওষুধ ছিল। তখন আমি সূরা ফাতেহা দ্বারাই চিকিৎসা শুরু করে দিলাম। এতে আমি সূরা ফাতেহার বিস্ময়কর প্রভাব দেখতে পেলাম। আমি যমযমের পানি নিয়ে তাতে কয়েকবার সূরা ফাতেহা পড়ে ফুঁক দিতাম, অতঃপর তা পান করতাম।
এতে আমি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠি। এরপর থেকে আমি অনেক ব্যথা ও আঘাতে সূরা ফাতেহার ওপরই নির্ভর করা শুরু করি। এতে আমি সর্বোচ্চ উপকার লাভ করি। আর কেউ ব্যথার কথা জানালে আমি তাকে সূরা ফাতেহা দ্বারা চিকিৎসার পরামর্র্শ দিতে থাকি। ফলে তাদের অনেকে ব্যথা থেকে দ্রুত মুক্তি পেত।’
কুরআনের পাশাপাশি হাদিসের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক দ্বারাও অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনুরূপ দোয়া দ্বারাও অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বিশেষ করে দোয়া যদি হয় কাকুতি-মিনতিসহ। হাদিস শরিফে এসেছে-যে সমস্যা দেখা দিয়েছে ও যে সমস্যা দেখা দেবে, ‘দোয়া’ উভয়টা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উপকারী। অতএব, হে আল্লাহর বান্দারা তোমাদের উচিত দোয়া করা [তিরমিজি]। আরও ইরশাদ হয়েছে-আল্লাহর ফয়সালা কেবল দোয়ার মাধ্যমেই পরিবর্তন হতে পারে এবং একমাত্র ভালো কাজই হায়াত বৃদ্ধি করে [তিরমিজি]।
তবে এখানে একটা বিষয় ভালো করে খেয়াল করা প্রয়োজন, যেসব আয়াত ও দোয়া দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হয়, সেগুলোই সরাসরি উপকারী। কিন্তু ঝাড়-ফুঁককারীর বা ঝাড়-ফুঁক গ্রহণকারীর আÍবিশ্বাস ও ঝাড়-ফুঁকে ত্রুটি থাকার কারণে অনেক সময় রোগমুক্তি বিলম্বিত হয় বা রোগমুক্তি মোটেই হয় না। যেমন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবনে ত্রুটি করলে হয়ে থাকে। অথবা এমনও হতে পারে, তার ভাগ্যে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ঝাড়-ফুঁক দ্বারা চিকিৎসা দুভাবে হতে পারে। এক. রোগীর নিজের পক্ষ থেকে। দুই. চিকিৎসকের পক্ষ থেকে। উভয়ের ক্ষেত্রে ঝাড়-ফুঁক পূর্ণ সফলকাম হওয়ার জন্য দুটি বিষয় অপরিহার্য। এক. আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ও তার প্রতি ভরসা রাখা। তার ইচ্ছায়ই সবকিছু হয় ও তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না এবং মুমিনদের প্রতি তিনি দয়াশীল-এ ধ্যান অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান থাকা। দুই. যে আয়াত ও দোয়া দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা হচ্ছে, তা সঠিকভাবে উচ্চারণ করা এবং অনারব হলে সেগুলোর অর্থ বুঝার চেষ্টায় থাকা।
শরিয়তের আলোকে তিনটি শর্তের ভিত্তিতেই কেবল ঝাড়-ফুঁক জায়েজ। যথা : এক. ঝাড়-ফুঁক আল্লাহর কথা বা রাসূল (সা.)-এর কথা দ্বারা হতে হবে। দুই. আরবি ভাষায় বা এমন কোনো ভাষায় হতে হবে, যার অর্থ স্পষ্ট বুঝা যায়। তিন. এ বিশ্বাস রাখা যে, ঝাড়-ফুঁকের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই; বরং তা কাজ করে কেবল আল্লাহর ইচ্ছায়ই। এটা শুধু কেবল একটি শরিয়ত স্বীকৃত অছিলা।