এক পেয়ালা গরম চা
সক্কাল-সক্কাল ঘুম-ঘুম চোখে এক পেয়ালা গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা! তবে চায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক যে সেই সকাল বেলাতেই শেষ হয়ে যায়, তা নয়। কখনো অফিস ক্যান্টিনে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্পের সঙ্গী হিসাবে, তো কখনো দিনের শেষ ক্লান্তি দূর করতে চা চাই-ই চাই! মোট কথা বাঙালির আত্মার সঙ্গে চায়ের যোগ বড়ই নিবিড়। আর তাতে করে যে আমরা লাভবানই হচ্ছি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! কারণ, চা পানের সঙ্গে আমাদের শরীরের ভালো-মন্দের যোগ রয়েছে। সকাল-বিকাল এক পেয়ালা করে লিকার চা খেলে শরীর বিষমুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, চা পাতায় উপস্থিত নানা উপকারী উপাদানের গুণে খারাপ কলস্টেরলের মাত্রা কমে, হজম ক্ষমতা বাড়ে এবং ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
চা শিল্পের ইতিহাস
“উত্তর ভারতের যে কোনো ট্রেনে উঠলে এখনো প্যাসেঞ্জাররা প্রথম যে জিনিসটি শুনতে পায়, সেটি হলো ক্যারেজের ভেতর থেকে মেটাল কেটলি ও গ্লাস হাতে হেঁটে চলা চাওয়ালার হাঁক। তারা সমানে চেঁচাতে থাকে ‘চাই, চাই, চাই’ বলে।” ইংরেজ ডায়েরি লেখক স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরিতে চা-বিষয়ক প্রথম এন্ট্রিটি এসেছে ১৬০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। পেপিস সেখানে লিখেছেন, ‘চা হলো অসাধারণ একটি চীনা পানীয়, যা সব চিকিৎসাবিদ কর্তৃক অনুমোদিত।’ এ চা ইংল্যান্ডে বিক্রি শুরু হয় ১৬৩৫ সালে। তখন এর বিনিময় মূল্য নেহাত কম ছিল না। একেক পাউন্ড চায়ের দাম ৬ পাউন্ড থেকে ১০ পাউন্ড পর্যন্ত, যা আজকের দিনের ৬০০ থেকে ১,০০০ পাউন্ডের সমতুল্য!
১৬৬২ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস যখন পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথরিন অব ব্রাগাঞ্জার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, ক্যাথরিন ছিলেন চায়ের পাগল। পর্তুগিজ রাজদরবারে বসে নিয়মিত চা পান করতেন তিনি। ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে যেদিন তিনি প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দেন, সেটি ছিল ১৬৬২ সালের মে মাস, অর্থাৎ যে মাসে বিয়ে হয় তার। অষ্টাদশ শতকে ডাচ ফার্ম জে জে ভুট অ্যান্ড সন্স ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা সরবরাহের ব্যর্থতার সুযোগে চরম আকারের ফায়দা তুলতে থাকে। ব্রিটেনের অভিজাত সম্প্রদায় এবং কফি হাউজগুলোর কাছে তারা বছরে আট মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের চা পাচার করতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাচ চা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই পরিণত হয় ‘বাজে গুণগতমান ও ব্যবহারের অনুপযোগী’ পানীয়তে। তারপরও অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণে অষ্টাদশ শতকের মধ্যেই ইংরেজদের অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং চীন ব্রিটেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে যে পরিমাণ রুপা দাবি করছিল, তার জোগান দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একদিকে চায়ের পাচার প্রতিহত করা, অন্যদিকে ক্রমে চীনাদের চাহিদা বাড়তে থাকা, এ দুইয়ের সুবাদে ব্রিটিশদের জন্য শিগ্গির বিকল্প কিছু করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই তারা ভারতে আফিম চাষ করতে শুরু করে। বিশেষত বাংলা, পাটনা, বেনারস ও মালবে তারা সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ করে এবং সেই আফিম চীনে পাচারের বিনিময়ে নিজেদের প্রিয় পানীয় অর্জন করতে থাকে। তারপরও ব্রিটিশ চা-চাষিরা চীনা চা ও তাদের কৌশল ভারতে নিয়ে আসার জন্য ছিল যারপরনাই মরিয়া। ১৭৮৮ সালে দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস চীনের চারা নিয়ে এসে অন্যত্র বপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারপর ১৮২৪ সালে রবার্ট ব্রুস ও মণিরাম দেওয়ান আসামে চায়ের চারা আবিষ্কার করেন। সেই সুবাদে চায়ের চাষ আসাম ও দার্জিলিংয়ে বিস্তৃত হয়। ঊনবিংশ শতকে রয়্যাল সোসাইটির এক লেকচারে উল্লেখ করা হয়, ওই সময়ের দিকেই ভারতে চীনা বসতির ছুতার ও জুতা নির্মাতাদের দার্জিলিং ও আসামে পাঠানো হতে থাকে এ বিশ্বাস থেকে যে প্রতিটি চীনা ব্যক্তিই চা চাষ ও উৎপাদনে পারদর্শী।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এক পেয়ালা গরম চা
সক্কাল-সক্কাল ঘুম-ঘুম চোখে এক পেয়ালা গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা! তবে চায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক যে সেই সকাল বেলাতেই শেষ হয়ে যায়, তা নয়। কখনো অফিস ক্যান্টিনে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্পের সঙ্গী হিসাবে, তো কখনো দিনের শেষ ক্লান্তি দূর করতে চা চাই-ই চাই! মোট কথা বাঙালির আত্মার সঙ্গে চায়ের যোগ বড়ই নিবিড়। আর তাতে করে যে আমরা লাভবানই হচ্ছি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! কারণ, চা পানের সঙ্গে আমাদের শরীরের ভালো-মন্দের যোগ রয়েছে। সকাল-বিকাল এক পেয়ালা করে লিকার চা খেলে শরীর বিষমুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, চা পাতায় উপস্থিত নানা উপকারী উপাদানের গুণে খারাপ কলস্টেরলের মাত্রা কমে, হজম ক্ষমতা বাড়ে এবং ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
চা শিল্পের ইতিহাস
“উত্তর ভারতের যে কোনো ট্রেনে উঠলে এখনো প্যাসেঞ্জাররা প্রথম যে জিনিসটি শুনতে পায়, সেটি হলো ক্যারেজের ভেতর থেকে মেটাল কেটলি ও গ্লাস হাতে হেঁটে চলা চাওয়ালার হাঁক। তারা সমানে চেঁচাতে থাকে ‘চাই, চাই, চাই’ বলে।” ইংরেজ ডায়েরি লেখক স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরিতে চা-বিষয়ক প্রথম এন্ট্রিটি এসেছে ১৬০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। পেপিস সেখানে লিখেছেন, ‘চা হলো অসাধারণ একটি চীনা পানীয়, যা সব চিকিৎসাবিদ কর্তৃক অনুমোদিত।’ এ চা ইংল্যান্ডে বিক্রি শুরু হয় ১৬৩৫ সালে। তখন এর বিনিময় মূল্য নেহাত কম ছিল না। একেক পাউন্ড চায়ের দাম ৬ পাউন্ড থেকে ১০ পাউন্ড পর্যন্ত, যা আজকের দিনের ৬০০ থেকে ১,০০০ পাউন্ডের সমতুল্য!
১৬৬২ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস যখন পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথরিন অব ব্রাগাঞ্জার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, ক্যাথরিন ছিলেন চায়ের পাগল। পর্তুগিজ রাজদরবারে বসে নিয়মিত চা পান করতেন তিনি। ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে যেদিন তিনি প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দেন, সেটি ছিল ১৬৬২ সালের মে মাস, অর্থাৎ যে মাসে বিয়ে হয় তার। অষ্টাদশ শতকে ডাচ ফার্ম জে জে ভুট অ্যান্ড সন্স ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা সরবরাহের ব্যর্থতার সুযোগে চরম আকারের ফায়দা তুলতে থাকে। ব্রিটেনের অভিজাত সম্প্রদায় এবং কফি হাউজগুলোর কাছে তারা বছরে আট মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের চা পাচার করতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাচ চা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই পরিণত হয় ‘বাজে গুণগতমান ও ব্যবহারের অনুপযোগী’ পানীয়তে। তারপরও অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণে অষ্টাদশ শতকের মধ্যেই ইংরেজদের অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং চীন ব্রিটেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে যে পরিমাণ রুপা দাবি করছিল, তার জোগান দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একদিকে চায়ের পাচার প্রতিহত করা, অন্যদিকে ক্রমে চীনাদের চাহিদা বাড়তে থাকা, এ দুইয়ের সুবাদে ব্রিটিশদের জন্য শিগ্গির বিকল্প কিছু করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই তারা ভারতে আফিম চাষ করতে শুরু করে। বিশেষত বাংলা, পাটনা, বেনারস ও মালবে তারা সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ করে এবং সেই আফিম চীনে পাচারের বিনিময়ে নিজেদের প্রিয় পানীয় অর্জন করতে থাকে। তারপরও ব্রিটিশ চা-চাষিরা চীনা চা ও তাদের কৌশল ভারতে নিয়ে আসার জন্য ছিল যারপরনাই মরিয়া। ১৭৮৮ সালে দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস চীনের চারা নিয়ে এসে অন্যত্র বপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারপর ১৮২৪ সালে রবার্ট ব্রুস ও মণিরাম দেওয়ান আসামে চায়ের চারা আবিষ্কার করেন। সেই সুবাদে চায়ের চাষ আসাম ও দার্জিলিংয়ে বিস্তৃত হয়। ঊনবিংশ শতকে রয়্যাল সোসাইটির এক লেকচারে উল্লেখ করা হয়, ওই সময়ের দিকেই ভারতে চীনা বসতির ছুতার ও জুতা নির্মাতাদের দার্জিলিং ও আসামে পাঠানো হতে থাকে এ বিশ্বাস থেকে যে প্রতিটি চীনা ব্যক্তিই চা চাষ ও উৎপাদনে পারদর্শী।