ধূমপান ছাড়তে দরকার সচেতনতা

 গাজী মুনছুর আজিজ 
৩০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এ লেখা সিগারেটের প্যাকেটের গায়েও আছে। তবুও মানুষ ধূমপান করছেন। এমনকি আমরা সবাই কমবেশি জানি ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। এটা জেনেশুনেও মানুষ করছেন। এর কারণ অভ্যাস। কিংবা বলা যায় অন্যের দেখাদেখি। এ ছাড়া ‘কৌতূহল’ও ধূমপানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মানুষ অভ্যাসের দাস। সে যেটা একবার অভ্যাস করে ফেলেন, সেটা ছাড়তে তার কষ্ট হয়। ধূমপানও সে রকম। একবার অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই আর ছাড়তে পারছেন না। এমনকি এর ক্ষতিকর বিষয় জেনেও ছাড়তে পারেন না। এ ছাড়া অনেকেই ধূমপান করেন অন্যের দেখাদেখি। বিশেষ করে যারা নতুন ধূমপান করছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রে অন্যের দেখাদেখি ধূমপান শুরু করেন। একবার শুরু হয়ে গেলে আর ছাড়তে পারেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ‘কৌতূহল’ও ধূমপানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বেলায় এটা বেশি প্রমাণিত। এমনকি অনেক গবেষণাও দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থী শুধু কৌতূহল মেটানোর জন্যই ধূমপান শুরু করেন। তবে ধূমপান যেভাবেই শুরু হোক, এর ক্ষতিকর দিক ছাড়া ভালো কোনো দিক নেই। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘাটায়। আর আর্থিক ক্ষতি তো আছেই।

গবেষকরা বলেন, দুটি সিগারেটে যে পরিমাণ নিকোটিন থাকে, তা সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হলে তার তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটবে। ধূমপায়ীর আশপাশের মানুষও পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এর অধিকাংশই সরাসরি তামাক ব্যবহার করেন। তবে এর মধ্যে ১২ লাখ মানুষ সরাসরি ধূমপান না করেও শুধু ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকার কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন, কিংবা যারা আগে ধূমপান করতেন এবং এখন ছেড়ে দিয়েছেন, তারাও অধূমপায়ীদের চেয়ে বেশি শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ নিয়ে চালানো ইউসিএলের এক নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। এর কারণ নিশ্চিতভাবে না জানলেও গবেষকরা ধারণা করছেন কোনো সময়ে নিয়মিত ধূমপান করার ফলে শরীরে পাকাপাকিভাবে পরিবর্তন আসতে পারে।

ধূমপানে ক্ষতিকর দিক রয়েছে অনেক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিক হলো, এটি ক্যানসারের কারণ।

মুখে দুর্গন্ধ : নিয়মিত ধূমপান করলে মুখে ও নিশ্বাসে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ফলে এটা অন্যের জন্য অস্বস্তিকর। বিশেষ করে শিশুদের সামনে এটা মোটেই ভালো দেখায় না।

আর্থিক ক্ষতি : সিগারেট কিনলে অনেক টাকার অপচয় হয়। এটা আমরা জানি, কিন্তু মানি না। অথচ এ টাকা জমালে মাস বা বছর শেষে ভালো অঙ্ক দাঁড়ায়।

বয়সের ছাপ : গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন, তাদের চেহারায় তাড়াতাড়ি বয়সের ছাপ পড়ে যায়। কারণ ধূমপান ফুসফুসে প্রভাব ফেলার আগে আপনার ত্বকে প্রভাব ফেলে।

ইনফার্টিলিটি : ধূমপান স্পার্ম কাউন্ট কমে। হরমোনের সমস্যা, স্পার্ম মোবিলিটি ও ইরেকটাইল ডিসফাংশনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের বেলায় ধূমপানের কারণে বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে নিজের শরীরে।

দাঁতের সৌন্দর্য : যারা নিয়মিত ধূমপান করেন, তাদের দাঁত হলদে হয়ে যায়। আর এমন দাঁত দেখতে নিশ্চই কারও ভালো লাগে না। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের কাছে।

অন্যের বিরক্তি : আপনি হয়তো ধূমপান উপভোগ করেন। কিন্তু আপনার কাছের বা আশপাশের মানুষ কিন্তু বিরক্ত হতে পারেন। আর এর ফলে দেখা যায়, আপনার কাছ থেকে আপনার কাছের বা প্রিয়জনরা দূরে সরে যাচ্ছেন।

শরীর দুর্বল : ধূমপান আপনার শরীরের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে অনেক স্বাভাবিক কাজও আপনার করতে কষ্ট হয়। এটা কিন্তু ধূমপানেরই একটা বড় কারণ। আর এভাবে ক্রমশ দুর্বল হতে হতে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পুরুষদের বাবা হতে অক্ষম করে দিতে পারে : ধূমপান কেবল ক্যানসারের কারণ নয়, এটি পুরুষদের বাবা হতে অক্ষমও করে দিতে পারে। জার্মান বিজ্ঞানীরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছেন। কারণ অন্যদের তুলনায় ধূমপায়ী পুরুষের বীর্যের ‘মোবিলিটি’ ও টিকে থাকার ক্ষমতা অনেক কম। জার্মানির সারলান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ধূমপায়ীদের বীর্যকোষের জিনোমের মেমব্রেনে পরিবর্তন প্রমাণ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ যে পুরুষ সন্তানের পিতা হতে চান, তাদের ধূমপান এড়িয়ে চলা উচিত। বায়োকেমিস্ট অধ্যাপক মাটিয়াস মন্টেনার বলেন, সিগারেটের ধোঁয়ায় এমন পদার্থ থাকে, যা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জিনোম পরিবর্তন করে। ফলে তা আর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না। এ ছাড়া বীর্যের আকার, ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছানোর গতি বদলে যায়। ফলে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। এ কারণেই অনেক ধূমপায়ী সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না।

আরও অনেক ক্ষতি : ধূমপানের কারণে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গেই কুফল দেখা দেয়। যেমন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালনে বাধা প্রদান, যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস, আলসার, হৃদরোগ, দন্তশূল, মাথা ঘোরা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, চোখের দৃষ্টি নষ্ট, ঠোঁট ও মুখে সমস্যা ইত্যাদি।

যেভাবে ধূমপান ছাড়বেন : এ মুহূর্তে ধূমপান ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করুন। আর টেবিল বা পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেট ডাস্টবিনে ফেলে দিন।

এ ছাড়া একদিন ধূমপান না করে দেখুন। এরপর পার্থক্য অনুভব করার চেষ্টা করুন। এরপর কয়েকদিন ধূমপান ছাড়া থাকুন। দেখবেন অভ্যাস হয়ে যাবে। আপনার আশপাশে যারা ধূমপান ত্যাগ করেছে, তাদের অনুসরণ করুন। তাদের স্বাস্থ্যের যেসব পরিবর্তন এসেছে সেটি জানার চেষ্টা করুন।

হিসাব করে দেখতে পারেন, সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের জন্য প্রতি মাসে আপনার কত টাকা খরচ হয়? এটি ধূমপান ছাড়তে বেশ কাজে দেবে। সম্ভব হলে আপনার ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গ কৌশলে এড়িয়ে চলুন।

ধূমপান ছাড়ার পর মুখে চকলেট, চুইংগাম, আদা বা মসলা চিবোতে পারেন। এতে ধূমপানের আগ্রহ কমে যাবে।

যখন আপনার ধূমপান করতে ইচ্ছা করবে, তখন রাস্তায় হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন কিংবা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলুন, আড্ডা দিন। অর্থাৎ নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। আর ব্যস্ততায় ধূমপানের কথা ভুলে যাবেন এবং ধূমপানের প্রতি টান কমে যাবে। যেখানে ধূমপান কর্নার আছে, সেখান থেকে দূরে থাকুন।

গবেষকরা বলছেন, অনেকে মনে করেন, অ্যালকোহলমিশ্রিত পানীয়, কোমলপানীয়, চা, কফি ইত্যাদি খাওয়ার সময় সিগারেট গেলে পানীয়র স্বাদ আরও বেড়ে যায়। সে জন্য বেশি বেশি ফলের শরবত বা ফল খেতে পারেন। স্বাস্থ্য সচেতনতা বা ধূমপানবিরোধী বই পড়তে পারেন। প্রয়োজনে অধূমপায়ী বন্ধুর সংখ্যা বাড়ান। একান্ত প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। মূলত ধূমপান ছাড়ার জন্য আপনার ইচ্ছেটাই দরকারি।

ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ : বাংলাদেশে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। এ আইনে প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ৩০০ টাকা। এ ছাড়া দোকানদার, ব্যবস্থাপকদেরও জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে। তাই এ আইন প্রয়োগ হলে প্রকাশ্যে ধূমপান অনেকটা কমে যাবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন