করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব : ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
jugantor
করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব : ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

  যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ  

২৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের প্রায় ১৮০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কোভিড-১৯ নামে এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে তিন লাখ মানুষ আর সুস্থ হয়েছেন প্রায় এক লাখ মানুষ।

সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হল, দিন দিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার বাড়ছে। শুরুতে করোনায় মৃত্যুর হার দুই-তিন শতাংশ থাকলেও বর্তমানে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। এমনকি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করা এ রোগের কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। কিউবা, রাশিয়া, জাপান কিংবা চীন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের কথা বললেও সেটির প্রয়োগ এখনও শুরু হয়নি।

সবকিছু মিলিয়ে মহামারী আকার ধারণ করা করোনায় বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। আর করোনার বড় ঝুঁকিতে ঘনবসতির বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে, ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন আর প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না বাড়ালে এপ্রিলের শুরুতেই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে করোনা। এদিকে করোনার বিস্তার রোধে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। তবে ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজারসহ জরুরি সেবা চালু থাকবে। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী।

বিপর্যস্ত বিশ্ব

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। এরপর চলতি বছর সেটা থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইতালি, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। তবে চীনে ৩ হাজার ২৭০ জনের প্রাণহানির পর সেখানে নতুন করে কোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বলা যায়, চীন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হচ্ছে।

তবে করোনার সবচেয়ে বেশি ধকল যাচ্ছে, ইতালির ওপর। দেশটিতে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ জন প্রাণ হারাচ্ছেন। ইতালিতে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৭৬ জন। এরপরই তালিকায় রয়েছে স্পেন ও ইরান। দেশ দুটিতে যথাক্রমে ১৭৭২ এবং ১৬৮৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সবচেয়ে আশঙ্কার খবর হচ্ছে, প্রত্যেক দেশেই মৃতের সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। রাত পোহালেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। রোগটি ভাইরাসবাহিত এবং অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় মৃতদের সৎকারেও কেউ অংশ নিতে পারছে না।

ভয়াবহ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাব অনুযায়ী, গতকাল সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩। এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন মোট তিনজন। এ ছাড়া বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। আইসোলেশনে আছেন ৫১ জন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ জন রাজধানী ঢাকার। চলতি সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুর টোলারবাগে করোনা পজিটিভ হয়ে দুজন প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে।

পরে সেখানকার বেশকয়েকটি বাড়ি লকডাউন করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া করোনার লক্ষণ নিয়ে সিলেট, খুলনা ও চট্টগ্রামে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারী। এতে সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণহানিও হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষের। বাংলাদেশ অবশ্যই করোনার ঝুঁকিতে আছে। তবে আমরা যদি সরকারি নির্দেশনা মেনে চলি।

আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলাচল সীমিত রাখি, যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে তারা যদি নিয়ম-কানুন মেনে চলি তাহলে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য আইইডিসিআরকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। আগে আমরা শুধু বিদেশ থেকে আসাদের ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করেছি। কিন্তু এখন কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না।

যাদের মধ্যেই লক্ষণ-উপসর্গ রয়েছে, কেইস ডেফিনেশন দেখে স্ট্রংলি মনে হয় সাসপেক্টেড, তাদের নমুনা সংগ্রহ করছি। করোনা আক্রান্ত নাকি আক্রান্ত নয় সেটা পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, যতক্ষণ আমরা নিশ্চিত হব না যে এটা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বলব না। আমরা পর্যাপ্ত এভিডেন্স পাওয়ার পর বলব। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, খুব প্রয়োজন ছাড়া আপাতত ঘরেই থাকুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। বাইরে বের হতে হলে, প্রয়োজনীয় সব সতর্কতা অবলম্বন করুন। আসলে সবাই মিলে করোনাকে প্রতিরোধ করতে হবে।

বিদেশ থেকে আগতরা ঘরেই থাকুন

বাংলাদেশে করোনার বিস্তার ঘটেছে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা প্রবাসীদের মাধ্যমেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণের শুরুতেই যদি দেশের এয়ারপোর্টগুলোয় কড়া নজরদারি এবং করোনার পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে করা যেত তাহলে বাংলাদেশে প্রাণঘাতী এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটত না। এদিকে বিদেশ ফেরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি অভিযোগ, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও তারা সেই নির্দেশনা মানছেন না। তারা অবাধে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় অংশ নিচ্ছেন। এসব কার্যকলাপের জন্য দেশব্যাপী একাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হলেও হোম কোয়ারেন্টিন মানছেন না একাধিক প্রবাসী।

প্রবাসীদের কোনো জরুরি কাজ ছাড়া ঘরেই অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোলরুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার। তিনি বলেন, দেশের বৃহত্তরও স্বার্থে বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন মানতে হবে। আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকুন এবং অন্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকুন।

তা সম্ভব না হলে, অন্যদের থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরে থাকুন (ঘুমানোর জন্য পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন)। যদি সম্ভব হয় তাহলে আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে, অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এমন স্থানের সংখ্যা কমান ও ওই স্থানগুলোয় জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলোবাতাসের ব্যবস্থা করুন। বুকের দুধ খাওয়ান এমন মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন।

শিশুর কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক পরে থাকাকালীন এটি হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকুন।

বিদেশ ফেরতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহারের সময় প্রদাহের (সর্দি, থুতু, কাশি, বমি ইত্যাদি) সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন (বিশেষ করে যদি হাত দেখতে নোংরা লাগে সাবান-পানি ব্যবহার করুন)।

প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু পেপার/ মেডিকেল মাস্ক/ কাপড়ের মাস্ক/ বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং ওপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন। টিস্যু পেপার ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলুন। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না।

লক্ষণ দেখা দিলে

জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত করোনার প্রধান লক্ষণ। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয়, উপসর্গ দেখা দেয়, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। করোনার সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে সরাসরি না এসে বাসায় থেকেই আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে উপদেশ ও পরামর্শ পাওয়া যাবে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে যে কোনো পরামর্শের জন্য উল্লেখিত হটলাইনে যোগাযোগের অনুরোধ জানানো হয়েছে : ৩৩৩, ০১৯৪৪৩৩৩২২২, ০১৪০১১৮৪৫৫১; ০১৪০১১৮৪৫৫৪; ০১৪০১১৮৪৫৫৫; ০১৪০১১৮৪৫৫৬; ০১৪০১১৮৪৫৫৯; ০১৪০১১৮৪৫৬০; ০১৪০১১৮৪৫৬৮; ০১৯২৭৭১১৭৮৫; ০১৯৩৭০০০০১১; ০১৯২৭৭১১৭৮৪ এবং ০১৯৩৭১১০০১১।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন নম্বর হচ্ছে-১৬২৬৩। এ ছাড়া ফেসবুক ও ই-মেইলে যোগাযোগ করা যাবে।

ফেসবুক : Iedcr, COVID-19 Control Room, e-mail : iedcrcovid19@gmail.com

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব : ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

 যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ 
২৪ মার্চ ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের প্রায় ১৮০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কোভিড-১৯ নামে এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে তিন লাখ মানুষ আর সুস্থ হয়েছেন প্রায় এক লাখ মানুষ।

সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হল, দিন দিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার বাড়ছে। শুরুতে করোনায় মৃত্যুর হার দুই-তিন শতাংশ থাকলেও বর্তমানে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। এমনকি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করা এ রোগের কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। কিউবা, রাশিয়া, জাপান কিংবা চীন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের কথা বললেও সেটির প্রয়োগ এখনও শুরু হয়নি।

সবকিছু মিলিয়ে মহামারী আকার ধারণ করা করোনায় বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। আর করোনার বড় ঝুঁকিতে ঘনবসতির বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে, ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন আর প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না বাড়ালে এপ্রিলের শুরুতেই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে করোনা। এদিকে করোনার বিস্তার রোধে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। তবে ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজারসহ জরুরি সেবা চালু থাকবে। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী।

বিপর্যস্ত বিশ্ব

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। এরপর চলতি বছর সেটা থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইতালি, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে। তবে চীনে ৩ হাজার ২৭০ জনের প্রাণহানির পর সেখানে নতুন করে কোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বলা যায়, চীন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হচ্ছে।

তবে করোনার সবচেয়ে বেশি ধকল যাচ্ছে, ইতালির ওপর। দেশটিতে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ জন প্রাণ হারাচ্ছেন। ইতালিতে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৭৬ জন। এরপরই তালিকায় রয়েছে স্পেন ও ইরান। দেশ দুটিতে যথাক্রমে ১৭৭২ এবং ১৬৮৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সবচেয়ে আশঙ্কার খবর হচ্ছে, প্রত্যেক দেশেই মৃতের সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। রাত পোহালেই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। রোগটি ভাইরাসবাহিত এবং অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় মৃতদের সৎকারেও কেউ অংশ নিতে পারছে না।

ভয়াবহ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাব অনুযায়ী, গতকাল সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩। এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন মোট তিনজন। এ ছাড়া বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। আইসোলেশনে আছেন ৫১ জন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ জন রাজধানী ঢাকার। চলতি সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুর টোলারবাগে করোনা পজিটিভ হয়ে দুজন প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে।

পরে সেখানকার বেশকয়েকটি বাড়ি লকডাউন করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া করোনার লক্ষণ নিয়ে সিলেট, খুলনা ও চট্টগ্রামে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারী। এতে সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণহানিও হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষের। বাংলাদেশ অবশ্যই করোনার ঝুঁকিতে আছে। তবে আমরা যদি সরকারি নির্দেশনা মেনে চলি।

আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলাচল সীমিত রাখি, যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে তারা যদি নিয়ম-কানুন মেনে চলি তাহলে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য আইইডিসিআরকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। আগে আমরা শুধু বিদেশ থেকে আসাদের ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করেছি। কিন্তু এখন কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না।

যাদের মধ্যেই লক্ষণ-উপসর্গ রয়েছে, কেইস ডেফিনেশন দেখে স্ট্রংলি মনে হয় সাসপেক্টেড, তাদের নমুনা সংগ্রহ করছি। করোনা আক্রান্ত নাকি আক্রান্ত নয় সেটা পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, যতক্ষণ আমরা নিশ্চিত হব না যে এটা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বলব না। আমরা পর্যাপ্ত এভিডেন্স পাওয়ার পর বলব। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, খুব প্রয়োজন ছাড়া আপাতত ঘরেই থাকুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। বাইরে বের হতে হলে, প্রয়োজনীয় সব সতর্কতা অবলম্বন করুন। আসলে সবাই মিলে করোনাকে প্রতিরোধ করতে হবে।

বিদেশ থেকে আগতরা ঘরেই থাকুন

বাংলাদেশে করোনার বিস্তার ঘটেছে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা প্রবাসীদের মাধ্যমেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণের শুরুতেই যদি দেশের এয়ারপোর্টগুলোয় কড়া নজরদারি এবং করোনার পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে করা যেত তাহলে বাংলাদেশে প্রাণঘাতী এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটত না। এদিকে বিদেশ ফেরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি অভিযোগ, তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও তারা সেই নির্দেশনা মানছেন না। তারা অবাধে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় অংশ নিচ্ছেন। এসব কার্যকলাপের জন্য দেশব্যাপী একাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হলেও হোম কোয়ারেন্টিন মানছেন না একাধিক প্রবাসী।

প্রবাসীদের কোনো জরুরি কাজ ছাড়া ঘরেই অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোলরুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার। তিনি বলেন, দেশের বৃহত্তরও স্বার্থে বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন মানতে হবে। আলো বাতাসের সুব্যবস্থা সম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকুন এবং অন্য সদস্যদের থেকে আলাদাভাবে থাকুন।

তা সম্ভব না হলে, অন্যদের থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরে থাকুন (ঘুমানোর জন্য পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন)। যদি সম্ভব হয় তাহলে আলাদা গোসলখানা এবং টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে, অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এমন স্থানের সংখ্যা কমান ও ওই স্থানগুলোয় জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলোবাতাসের ব্যবস্থা করুন। বুকের দুধ খাওয়ান এমন মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন।

শিশুর কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক পরে থাকাকালীন এটি হাত দিয়ে ধরা থেকে বিরত থাকুন।

বিদেশ ফেরতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহারের সময় প্রদাহের (সর্দি, থুতু, কাশি, বমি ইত্যাদি) সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন (বিশেষ করে যদি হাত দেখতে নোংরা লাগে সাবান-পানি ব্যবহার করুন)।

প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি কাশির সময় টিস্যু পেপার/ মেডিকেল মাস্ক/ কাপড়ের মাস্ক/ বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং ওপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন। টিস্যু পেপার ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলুন। ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না।

লক্ষণ দেখা দিলে

জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত করোনার প্রধান লক্ষণ। এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত শুষ্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয়, উপসর্গ দেখা দেয়, পরে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। করোনার সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে সরাসরি না এসে বাসায় থেকেই আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে উপদেশ ও পরামর্শ পাওয়া যাবে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে যে কোনো পরামর্শের জন্য উল্লেখিত হটলাইনে যোগাযোগের অনুরোধ জানানো হয়েছে : ৩৩৩, ০১৯৪৪৩৩৩২২২, ০১৪০১১৮৪৫৫১; ০১৪০১১৮৪৫৫৪; ০১৪০১১৮৪৫৫৫; ০১৪০১১৮৪৫৫৬; ০১৪০১১৮৪৫৫৯; ০১৪০১১৮৪৫৬০; ০১৪০১১৮৪৫৬৮; ০১৯২৭৭১১৭৮৫; ০১৯৩৭০০০০১১; ০১৯২৭৭১১৭৮৪ এবং ০১৯৩৭১১০০১১।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন নম্বর হচ্ছে-১৬২৬৩। এ ছাড়া ফেসবুক ও ই-মেইলে যোগাযোগ করা যাবে।

ফেসবুক : Iedcr, COVID-19 Control Room, e-mail : iedcrcovid19@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

ঘটনাপ্রবাহ : ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস

২৮ মে, ২০২৩