সাতক্ষীরায় অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার তিন নারী
অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়ে লাবসার শাহানারা খাতুন ক্যানসারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দুটি চোখ হারিয়ে সাতক্ষীরার মাগুরার তালতলার নুরবানু এখন অন্যের বাড়িতে থেকে ভিক্ষা করেন। প্রতিবন্ধী স্বামীর সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে সাতক্ষীরা শহরতলির ঝুটিতলার নুরুন্নাহারের। তাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের কথা লিখেছেন-
সুভাষ চৌধুরী
১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শাহানারা খাতুন
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা গ্রামের শেখ আবু সালেকের মেয়ে শাহানারা। তার চেহারাই সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল প্রতিবেশী চাচাতো ভাইদের কেউ কেউ। কিন্তু তার বাবা তাতে সম্মত না হয়ে মেয়েকে বিয়ে দেন শ্যামনগরের আবদুল খালেকের সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে শাহানারা খাতুন বলেন, ১৯৮৮ সালের এক রাতে আমি স্বামীর সঙ্গে আমার বাবার বাড়িতে আসার পথে শহরের সিটি কলেজ মোড়ে দুর্বৃত্তরা অ্যাসিড ছুড়ে মারলে আমরা দু’জনেই দগ্ধ হই। আমার স্বামীর পিঠ পুড়ে যায় মারাত্মকভাবে। আর আমার মুখমণ্ডলসহ বুক এবং অন্যান্য অঙ্গ ঝলসে যায় অ্যাসিডে। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হলেও সারা দেহে থেকে যায় বীভৎস চিহ্ন। এরই মধ্যে আক্রান্ত হই মরণব্যাধি স্তন ক্যানসারে। চিকিৎসকদের পরামর্শে কেটে ফেলতে হয় একটি স্তনের একাংশ। এখন পর্যন্ত আটটি কেমো দেওয়া হয়েছে। এখন দিতে হবে রেডিও থেরাপি। একটি ছেলে ছিল আমার। এনএসআইএর কনস্টেবল ওয়াচার পদে চাকরি করত। হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় ছেলেটি। অ্যাসিডের যন্ত্রণায় স্বামী রোদে কাজ করতে পারেন না। জমি জিরাত নেই। বাবার ভিটায় থাকি। কীভাবে চলে আমাদের দু’জনের! রেডিও থেরাপি দেব কীভাবে তা নিয়ে রয়েছি দুশ্চিন্তায়।
নুরবানু বেগম
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তালতলা মাগুরা গ্রামের নুরবানু আকবর আলির মেয়ে। স্বামী জুলমাত আলি। তার স্বামী কোনো কাজ করত না। বাড়ি এসে তার ওপর নির্যাতন চালাত। তাকে বিয়ের পর আরও তিনটি বিয়ে করে।
নুরবানু বেগমের মতে, আমি বাধা দেই। এ নিয়ে বিরোধ ওঠে চরমে। আমি নিরুপায় হয়ে ফিরে যাই বাবার ঘরে। ২০০৮ সালের এক সন্ধ্যায় প্রথম রোজার দিনে আমি মায়ের কথা অনুযায়ী রান্নাঘরে বসে ডিম ভাজছিলাম। এমন সময় আমাকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছুড়ে মারে স্বামী জুলমাত। আমি চিৎকার দিলে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। অ্যাসিডে পুড়ে আমার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। দেহের অন্যান্য অঙ্গও মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়। ধার-দেনা করে আমার বাবা আমার চিকিৎসা করালেও চোখের দৃষ্টি আর ফেরেনি। আমার বাবা-মা মারা গেছেন। দুই ছেলের একজন আমাকে ছেড়ে ঢাকায় ইটভাটায় কাজ করে। আমার বড় ছেলে কাজকর্ম করলেও আমাকে দেখে না। খেতেও দেয় না। একটিমাত্র মেয়ে, তার বিয়ে দিয়েছি। এখন আমি একা। বাবার ঘর ছেড়ে এখন থাকি তালা উপজেলার ধানদিয়া গ্রামে সাকিরনের বাড়িতে। বৃদ্ধ সাকিরন আর আমি দু’জনে দিনভর ভিক্ষা করি। আমি চোখে দেখি না। তাই সাকিরন বিবি আমার লাঠি ধরে আমাকে হাঁটান। দিন শেষে যা পাই দু’জনে ভাগ করে নিই। এতেই চলছে আমার। স্বামী জুলমাত জেলে ছিল। এখন শুনেছি বেরিয়ে এসে এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেছে। আমি কোনো বিচার পাইনি।
নুরুন্নাহার বেগম
সাতক্ষীরা শহরতলির ঝুটিতলায় প্রতিবন্ধী স্বামী শেখ আইনুল ইসলামের সঙ্গে থাকেন নুরুন্নাহার। বাবার বাড়ি সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের গাংনীতে। বাবা জোবেদ আলি ও মা মারা গেছেন। প্রথম স্বামীর বিভিন্ন অপকর্মে বাধা দেওয়ায় তার সঙ্গে চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। আমি চলে আসি একই গ্রামে বাবার বাড়িতে। গাংনীতে বাবার বাড়িতে থাকাকালে এক রাতে বাথরুমে বসা অবস্থায় তাকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড মারে দিনমজুর স্বামী আল আমিন। তার শরীরের মুখ-হাত-বুকসহ বিভিন্ন অঙ্গ ঝলসে যায়। নুরুন্নাহার বেগম বলেন, আমার বাবা আমাকে চিকিৎসা করান স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে। অ্যাসিড মারার পরও স্বামীর প্রতিহিংসামূলক আচরণে আমরা আরও ভীত হয়ে পড়ি। আমার বাবা অবশেষে ঝুটিতলায় প্রতিবন্ধীর সঙ্গে আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেন। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার সংসার প্রায় অচল। ছেলেটি যা পায় তাই দিয়ে চলছি। এখন একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আমার মামলায় প্রথম স্বামী আল আমিন জেলে ছিল বহুদিন। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে মামলাটির ভবিষ্যৎ ভালো নয়। অ্যাসিড আক্রান্তদের সম্পর্কে সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বদেশ-এর পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় বিভিন্ন সময়ে অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১১ শিশু, ৪৩ জন পুরুষ এবং ১১১ নারী। প্রেম ভালোবাসা, জমিজমা ও ব্যক্তি আক্রোশের জেরে এসব ঘটনা কয়েক বছর ধরে ঘটছে। আমরা অ্যাকশন এইডের পক্ষে তাদের চিকিৎসা, অর্থ এবং পুনর্বাসন সহায়তা ছাড়াও আইনগত সব সহায়তা দিচ্ছি। জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি আঞ্জুয়ারা বেগমের মতে, যারা অ্যাসিড সহিংসতার শিকার তাদের সহায়তার জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে যাই। তাদের সহায়তায় সব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাতক্ষীরায় অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার তিন নারী
অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়ে লাবসার শাহানারা খাতুন ক্যানসারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দুটি চোখ হারিয়ে সাতক্ষীরার মাগুরার তালতলার নুরবানু এখন অন্যের বাড়িতে থেকে ভিক্ষা করেন। প্রতিবন্ধী স্বামীর সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে সাতক্ষীরা শহরতলির ঝুটিতলার নুরুন্নাহারের। তাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের কথা লিখেছেন-
শাহানারা খাতুন
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা গ্রামের শেখ আবু সালেকের মেয়ে শাহানারা। তার চেহারাই সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল প্রতিবেশী চাচাতো ভাইদের কেউ কেউ। কিন্তু তার বাবা তাতে সম্মত না হয়ে মেয়েকে বিয়ে দেন শ্যামনগরের আবদুল খালেকের সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে শাহানারা খাতুন বলেন, ১৯৮৮ সালের এক রাতে আমি স্বামীর সঙ্গে আমার বাবার বাড়িতে আসার পথে শহরের সিটি কলেজ মোড়ে দুর্বৃত্তরা অ্যাসিড ছুড়ে মারলে আমরা দু’জনেই দগ্ধ হই। আমার স্বামীর পিঠ পুড়ে যায় মারাত্মকভাবে। আর আমার মুখমণ্ডলসহ বুক এবং অন্যান্য অঙ্গ ঝলসে যায় অ্যাসিডে। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হলেও সারা দেহে থেকে যায় বীভৎস চিহ্ন। এরই মধ্যে আক্রান্ত হই মরণব্যাধি স্তন ক্যানসারে। চিকিৎসকদের পরামর্শে কেটে ফেলতে হয় একটি স্তনের একাংশ। এখন পর্যন্ত আটটি কেমো দেওয়া হয়েছে। এখন দিতে হবে রেডিও থেরাপি। একটি ছেলে ছিল আমার। এনএসআইএর কনস্টেবল ওয়াচার পদে চাকরি করত। হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় ছেলেটি। অ্যাসিডের যন্ত্রণায় স্বামী রোদে কাজ করতে পারেন না। জমি জিরাত নেই। বাবার ভিটায় থাকি। কীভাবে চলে আমাদের দু’জনের! রেডিও থেরাপি দেব কীভাবে তা নিয়ে রয়েছি দুশ্চিন্তায়।
নুরবানু বেগম
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তালতলা মাগুরা গ্রামের নুরবানু আকবর আলির মেয়ে। স্বামী জুলমাত আলি। তার স্বামী কোনো কাজ করত না। বাড়ি এসে তার ওপর নির্যাতন চালাত। তাকে বিয়ের পর আরও তিনটি বিয়ে করে।
নুরবানু বেগমের মতে, আমি বাধা দেই। এ নিয়ে বিরোধ ওঠে চরমে। আমি নিরুপায় হয়ে ফিরে যাই বাবার ঘরে। ২০০৮ সালের এক সন্ধ্যায় প্রথম রোজার দিনে আমি মায়ের কথা অনুযায়ী রান্নাঘরে বসে ডিম ভাজছিলাম। এমন সময় আমাকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছুড়ে মারে স্বামী জুলমাত। আমি চিৎকার দিলে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। অ্যাসিডে পুড়ে আমার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। দেহের অন্যান্য অঙ্গও মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়। ধার-দেনা করে আমার বাবা আমার চিকিৎসা করালেও চোখের দৃষ্টি আর ফেরেনি। আমার বাবা-মা মারা গেছেন। দুই ছেলের একজন আমাকে ছেড়ে ঢাকায় ইটভাটায় কাজ করে। আমার বড় ছেলে কাজকর্ম করলেও আমাকে দেখে না। খেতেও দেয় না। একটিমাত্র মেয়ে, তার বিয়ে দিয়েছি। এখন আমি একা। বাবার ঘর ছেড়ে এখন থাকি তালা উপজেলার ধানদিয়া গ্রামে সাকিরনের বাড়িতে। বৃদ্ধ সাকিরন আর আমি দু’জনে দিনভর ভিক্ষা করি। আমি চোখে দেখি না। তাই সাকিরন বিবি আমার লাঠি ধরে আমাকে হাঁটান। দিন শেষে যা পাই দু’জনে ভাগ করে নিই। এতেই চলছে আমার। স্বামী জুলমাত জেলে ছিল। এখন শুনেছি বেরিয়ে এসে এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেছে। আমি কোনো বিচার পাইনি।
নুরুন্নাহার বেগম
সাতক্ষীরা শহরতলির ঝুটিতলায় প্রতিবন্ধী স্বামী শেখ আইনুল ইসলামের সঙ্গে থাকেন নুরুন্নাহার। বাবার বাড়ি সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের গাংনীতে। বাবা জোবেদ আলি ও মা মারা গেছেন। প্রথম স্বামীর বিভিন্ন অপকর্মে বাধা দেওয়ায় তার সঙ্গে চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। আমি চলে আসি একই গ্রামে বাবার বাড়িতে। গাংনীতে বাবার বাড়িতে থাকাকালে এক রাতে বাথরুমে বসা অবস্থায় তাকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড মারে দিনমজুর স্বামী আল আমিন। তার শরীরের মুখ-হাত-বুকসহ বিভিন্ন অঙ্গ ঝলসে যায়। নুরুন্নাহার বেগম বলেন, আমার বাবা আমাকে চিকিৎসা করান স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে। অ্যাসিড মারার পরও স্বামীর প্রতিহিংসামূলক আচরণে আমরা আরও ভীত হয়ে পড়ি। আমার বাবা অবশেষে ঝুটিতলায় প্রতিবন্ধীর সঙ্গে আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেন। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার সংসার প্রায় অচল। ছেলেটি যা পায় তাই দিয়ে চলছি। এখন একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আমার মামলায় প্রথম স্বামী আল আমিন জেলে ছিল বহুদিন। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে মামলাটির ভবিষ্যৎ ভালো নয়। অ্যাসিড আক্রান্তদের সম্পর্কে সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বদেশ-এর পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় বিভিন্ন সময়ে অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১১ শিশু, ৪৩ জন পুরুষ এবং ১১১ নারী। প্রেম ভালোবাসা, জমিজমা ও ব্যক্তি আক্রোশের জেরে এসব ঘটনা কয়েক বছর ধরে ঘটছে। আমরা অ্যাকশন এইডের পক্ষে তাদের চিকিৎসা, অর্থ এবং পুনর্বাসন সহায়তা ছাড়াও আইনগত সব সহায়তা দিচ্ছি। জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি আঞ্জুয়ারা বেগমের মতে, যারা অ্যাসিড সহিংসতার শিকার তাদের সহায়তার জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে যাই। তাদের সহায়তায় সব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।