তিন কন্যার স্বপ্নজয়
jugantor
তিন কন্যার স্বপ্নজয়
রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালনেই নারীর জীবন থেমে নেই। পড়াশোনা, সংসার সব সামলে তারাও দাঁড়াচ্ছেন নিজের পায়ে। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আরও অনেককে। সফল তিন নারী উদ্যোক্তার কথা জানাচ্ছেন-

  মুহাম্মদ শফিকুর রহমান  

৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

কথার কুন্দনন্দিনী

তখন করোনাকাল। চারদিকে মাস্কের প্রচুর চাহিদা। তিনি ভাবলেন সুন্দর সব মাস্ক তৈরি করলে কেমন হয়। গতানুগতিক নয়। একটু ফ্যাশনেবল। ভিন্ন ডিজাইনের। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিছু মাস্ক তৈরি করে তাতে নানা রকম কার্টুন আঁকালেন। বাজারে ছাড়তেই রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। এক মাসেই কয়েক হাজার পিস মাস্ক বিক্রি হলো। এভাবেই একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন উম্মে সুমাইয়া হাসান কথা। পড়াশোনা করছেন নওগাঁ সরকারি মহিলা কলেজ বাংলা বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে।

শুরু ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট। শুরুতে মাত্র ২০০০ টাকা মূলধন ছিল। এখন তা প্রায় এক লাখ টাকায় পৌঁছেছে। সব খরচ বাদে মাসে তার আয় প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো। টাকাটা অনেকের কাছে হয়তো সামান্য। কিন্তু কথার কাছে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এটা তার স্বপ্ন জয়ের প্রেরণা। বাধা পেরিয়ে নারীর এগিয়ে চলার গল্প। কথা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। শুরুতে মাস্ক থাকলেও এখন তার পণ্য সংখ্যা বেড়েছে। তিনি ইন্ডিয়া, চায়না ইত্যাদি দেশ থেকে শাড়ি, জুয়েলারি, জুতা, ব্যাগ, কসমেটিক সব ধরনের পণ্য আমদানি করেন। পাশাপশি নিজের হাতে তৈরি পাঞ্জাবি, জামা, শাড়ি ইত্যাদি বিক্রি করেন।

নিজের ব্যবসা সম্পর্কে কথা বলেন, ‘আমি সব সময় মানসম্মত এবং কিছুটা ব্যতিক্রমী ফ্যাশনেবল পণ্য ক্রেতাদের দিতে চেষ্টা করি। যেমন ধরুন নানা ডিজাইনের মাস্ক আমি প্রথমে বাজারজাত করি। আমার দেখাদেখি এখন অনেকেই তা করছে।’ কথার কাছে ৫০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য রয়েছে। পণ্য তৈরির কাঁচামাল স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেন বলে জানান। নারী উদ্যোক্তা হয়ে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জানতে চাইলে কথা বলেন, ‘নারী যে উদ্যোক্তা হতে পারে, ভালো ব্যবসা করতে পারে, কিছু মানুষ একদমই তা মানতে চায় না। নানাভাবে তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে নারী উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। কারণ সব কাজেই মানসিক প্রস্তুতিই প্রধান।’

ক্রেতা যখন পণ্য পেয়ে খুশি হয়, যেমনটা চেয়েছিল তেমন পণ্য পাওয়ার কথা জানায়, তখন কথার খুব ভালো লাগে। পরিবারে সবাই কথাকে সাহায্য করে। উদ্যোক্তা হয়ে কী হবে? এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী? তার চেয়ে বরং চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হতে চেষ্টা করো। এমন নানা কথা শুনেছেন তিনি। তবে এসব কথাকে পাত্তা দেননি। তিনি তার মতো এগিয়ে গিয়েছেন। সে কারণে অল্পদিনেই ক্রেতাদের মন জয় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কুরিয়ারে পণ্য পাঠালে তো নষ্ট হতেই পারে। পণ্য নষ্ট হলে আবার নতুন পণ্য পাঠিয়ে দেন কিংবা পণ্যের মূল্য ফেরত দেন কথা। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সি নারীরা কথার পণ্যের প্রধান ক্রেতা।

নতুন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তার পরামর্শ, ‘অনেক সমস্যা আসবে তবে সব সমস্যা উপেক্ষা করে সামনে এগোতে হবে। সমস্যাকে ভয় পেলে চলবে না। নিজেকে নতুন কিছু করতে হবে।’

নিলার ছবি প্রশংসিত দেশে-বিদেশে

ছবি আঁকা তার শখ। শখের ছবি এঁকে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। তার আঁকা ছবি আমেরিকা, লন্ডন, ভারত, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে বিক্রি হয়েছে। সফল এ চিত্রশিল্পীর নাম ফারহানা আলম নিলা। সংসারে তার স্বামী, দুই মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ফাইনান্সে এমবিএ শেষ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তার ঝোঁক। সে কারণে শখ হিসাবে ছবি আঁকা বেছে নিয়েছেন। মা, বাবা ছবি আঁকার বিষয়ে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন সব সময়। নীলা বলেন, ‘স্কুল থেকেই আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি। মা ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ জুগিয়েছেন। দেখা যেত আমি ছবি আঁকলে মা সেই ছবিগুলো বাঁধিয়ে ঘরে সাজিয়ে রাখতেন।’

নিলা কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ছিল শিক্ষকতার ব্যস্ততা। সন্তান লালনপালনের ব্যস্ততা। সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে ছবি আঁকতে হতো। তবু ছবি আঁকা ছাড়তে পারেননি। ছবি আঁকার মধ্যে তিনি মনের শান্তি খুঁজে পান। নিলা জানান, ক্যানভাসে আমি ছবি আঁকতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ ছবি এঁকেছেন। ছবি বিক্রি করে মাসে তার আয় ২০ হাজার টাকার মতো। এ টাকার কিছু অংশ তিনি গরিব দুঃখীদের মধ্যে দান করেন। ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা নীলার এক একটি ছবির দাম।

পাহাড়ে শান্তির নীড়। নীলার খুব জনপ্রিয় একটি ছবি। ছবিটি নিউইয়র্কের ‘আরটাভিটা’ গ্যালারিতে ভার্চুয়ালি প্রদর্শিত হয়েছিল। সবুজ ঘাসে মোড়া ঢেউ খেলানো পাহাড়ি জমি, অবারিত প্রান্তর, নীল আকাশ আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে শান্তির নীড়। হালকা শীতে, গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। শহুরে যান্ত্রিকতা নেই। চারদিক কী নীরব, নিঝুম, নিস্তব্ধ! এই হচ্ছে পাহাড়ে শান্তির নীড় চিত্রকর্মের গল্প।

একজন মা। তার কত কাজ। কীভাবে এসব সামলে তিনি সফল উদ্যোক্তা হলেন জানতে চাইলে নীলা বলেন, ‘বাচ্চাদের পরীক্ষা, বাসায় মেহমান। কত কাজ! সব গুছিয়ে তবু সামলে নিয়েছি। রাত জেগে ছবির কাজ করে সকালে স্কুলেও গিয়েছি।’

নিলা প্রায় ১২টি এক্সিবিশনে ছবি নিয়ে অংশ নেন। অবসকিউর আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে তার ছবি ছিল। যেটা নিউইয়র্কের আরটাভিটা অনলাইন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এ ছাড়া কেপিআর আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন ফেস্টিভালে তার ছবি ছিল।

নিলার ছবি আমেরিকা, লন্ডন, ভারত, শ্রীলংকায় বিক্রি হয়েছে। ভারত, শ্রীলংকাতে গ্লোবাল ফরওয়ার্ডিং অ্যান্ড ফ্রেইট লিমিটেড কোম্পানি তার কাছ থেকে নিয়মিত পেইন্টিং নেয় বলে জানান নিলা। লন্ডনের কিছু রেস্টুরেন্টে তার ছবি শোভা বাড়াচ্ছে।

বর্তমানে নিলা বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। পাশাপাশি অনলাইনে শিশুদের পড়ান। নিজস্ব একটি আর্ট শোরুম দেওয়ার তার খুব শখ। এ ছাড়া চিত্রকর্ম নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী করারও স্বপ্ন দেখেন তিনি।

গয়নায় ক্যারিয়ার গড়েছেন কাঁকন

ছোটবেলা থেকে তার গয়নার প্রতি ঝোঁক। নতুন গয়না ভেঙে জোড়া লাগাতেন। ভাঙা গয়না জোড়া দিয়ে কিছুটা ভিন্ন রূপ দিতে চাইতেন। কৌতূহলের বসে ২০১২ সালে ফেসবুকে পেজ খুলেন। এখন তার মাসিক আয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এমবিএ শেষ করেছেন। চাকরির পেছনে না ছুটে গয়নাতেই গড়ে নিয়েছেন ক্যারিয়ার। সফল এ উদ্যোক্তার নাম নুসরাত জাহান কাঁকন।

কাঁকনের জন্ম চট্টগ্রামে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে থেকেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তিনি খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। বিবিএ, এমবিএম শেষ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ল কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি গয়না নিয়ে কাজ করছেন। স্বামী আর এক সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। তিনি ‘উই’-এর একজন সদস্য। উই থেকে আসা বেশ কয়েকটি কোর্সে অংশ নিয়েছেন। উদ্যোক্তার কাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। নিজ থেকেই চেষ্টা করে শিখেছেন। ২০১২ সালে স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় ফেসবুকে পেজ খুলেন। কাঁকন বলেন, ‘কৌতূহলের বশে পেজ খুলেছিলাম। দেখার জন্য কেমন সাড়া পাওয়া যায়। শুরুতেই ক্রেতা মিলে যায়।’

অনলাইনে গয়না তো অনেকেই বিক্রি করেন। তার গয়নার আলাদা কিছু আছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে কাঁকন বলেন, ‘গয়নার কোয়ালিটি, গয়নার প্রেজেন্টেশন মানুষ পছন্দ করে। যুগের সঙ্গে যখন যে গয়নার চল, আমি সেটাই তৈরি করি। দেশীয় উৎসবগুলো ঘিরে গয়না তৈরি করি। মেটালের হাতের তৈরি নানা গয়না, কড়ির গয়না, চুড়ি, মুক্তার গয়না, কাঠের গয়না, মেটাল, বিডস-এর গয়না, হিজাব পিন, বিভিন্ন ধরনের দামি পাথর এবং মুক্তার ডিজাইনের গয়না তার কাছে পাওয়া যায়। নিজের পণ্য নিয়ে এ পর্যন্ত কাঁকন ছয়টি মেলায় অংশ নেন। এর মধ্যে উদ্যোক্তা দিবসে যুব উন্নয়ন সংস্থার প্রদর্শনীতে হ্যান্ডিক্রাফট বিভাগে ২য় স্থান অর্জন করেন। অনলাইনেই তার সব বেচাবিক্রি। মাত্র দুই হাজার টাকা ছিল তার শুরুতে মূলধন। এখন মাসে প্রায় ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। তবে উৎসবের সময় বিক্রি বেশি হয়। কাঁকন জানান, ‘আমার স্পেশাল গয়না হলো চায়না থেকে আমদানি করা রিয়েল পার্লের গয়নাগুলো। যেগুলোর চাহিদা আমার পেজে অনেক বেশি।’

নারী উদ্যোক্তা হিসাবে সমস্যার কথা জানতে চাইলে কাঁকন বলেন, ‘নারী হিসাবে যতটা না সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তার চেয়ে বেশি হয়েছি বিবাহিত নারী হিসাবে। বিবাহিত নারী উদ্যোক্তা হয়ে আমি শুরুতে শুনেছিলাম, স্বামী হাত খরচ দিতে পারে না বলেই আমি এ ব্যবসায় এসেছি। বিষয়টা মোটেও তা নয়। নিজেকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলা, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পাশপাশি নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবসায় আসা।’

তিন কন্যার স্বপ্নজয়

রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালনেই নারীর জীবন থেমে নেই। পড়াশোনা, সংসার সব সামলে তারাও দাঁড়াচ্ছেন নিজের পায়ে। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আরও অনেককে। সফল তিন নারী উদ্যোক্তার কথা জানাচ্ছেন-
 মুহাম্মদ শফিকুর রহমান 
৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

কথার কুন্দনন্দিনী

তখন করোনাকাল। চারদিকে মাস্কের প্রচুর চাহিদা। তিনি ভাবলেন সুন্দর সব মাস্ক তৈরি করলে কেমন হয়। গতানুগতিক নয়। একটু ফ্যাশনেবল। ভিন্ন ডিজাইনের। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিছু মাস্ক তৈরি করে তাতে নানা রকম কার্টুন আঁকালেন। বাজারে ছাড়তেই রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। এক মাসেই কয়েক হাজার পিস মাস্ক বিক্রি হলো। এভাবেই একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন উম্মে সুমাইয়া হাসান কথা। পড়াশোনা করছেন নওগাঁ সরকারি মহিলা কলেজ বাংলা বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে।

শুরু ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট। শুরুতে মাত্র ২০০০ টাকা মূলধন ছিল। এখন তা প্রায় এক লাখ টাকায় পৌঁছেছে। সব খরচ বাদে মাসে তার আয় প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো। টাকাটা অনেকের কাছে হয়তো সামান্য। কিন্তু কথার কাছে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এটা তার স্বপ্ন জয়ের প্রেরণা। বাধা পেরিয়ে নারীর এগিয়ে চলার গল্প। কথা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। শুরুতে মাস্ক থাকলেও এখন তার পণ্য সংখ্যা বেড়েছে। তিনি ইন্ডিয়া, চায়না ইত্যাদি দেশ থেকে শাড়ি, জুয়েলারি, জুতা, ব্যাগ, কসমেটিক সব ধরনের পণ্য আমদানি করেন। পাশাপশি নিজের হাতে তৈরি পাঞ্জাবি, জামা, শাড়ি ইত্যাদি বিক্রি করেন।

নিজের ব্যবসা সম্পর্কে কথা বলেন, ‘আমি সব সময় মানসম্মত এবং কিছুটা ব্যতিক্রমী ফ্যাশনেবল পণ্য ক্রেতাদের দিতে চেষ্টা করি। যেমন ধরুন নানা ডিজাইনের মাস্ক আমি প্রথমে বাজারজাত করি। আমার দেখাদেখি এখন অনেকেই তা করছে।’ কথার কাছে ৫০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য রয়েছে। পণ্য তৈরির কাঁচামাল স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করেন বলে জানান। নারী উদ্যোক্তা হয়ে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জানতে চাইলে কথা বলেন, ‘নারী যে উদ্যোক্তা হতে পারে, ভালো ব্যবসা করতে পারে, কিছু মানুষ একদমই তা মানতে চায় না। নানাভাবে তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে নারী উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। কারণ সব কাজেই মানসিক প্রস্তুতিই প্রধান।’

ক্রেতা যখন পণ্য পেয়ে খুশি হয়, যেমনটা চেয়েছিল তেমন পণ্য পাওয়ার কথা জানায়, তখন কথার খুব ভালো লাগে। পরিবারে সবাই কথাকে সাহায্য করে। উদ্যোক্তা হয়ে কী হবে? এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী? তার চেয়ে বরং চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হতে চেষ্টা করো। এমন নানা কথা শুনেছেন তিনি। তবে এসব কথাকে পাত্তা দেননি। তিনি তার মতো এগিয়ে গিয়েছেন। সে কারণে অল্পদিনেই ক্রেতাদের মন জয় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কুরিয়ারে পণ্য পাঠালে তো নষ্ট হতেই পারে। পণ্য নষ্ট হলে আবার নতুন পণ্য পাঠিয়ে দেন কিংবা পণ্যের মূল্য ফেরত দেন কথা। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সি নারীরা কথার পণ্যের প্রধান ক্রেতা।

নতুন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তার পরামর্শ, ‘অনেক সমস্যা আসবে তবে সব সমস্যা উপেক্ষা করে সামনে এগোতে হবে। সমস্যাকে ভয় পেলে চলবে না। নিজেকে নতুন কিছু করতে হবে।’

নিলার ছবি প্রশংসিত দেশে-বিদেশে

ছবি আঁকা তার শখ। শখের ছবি এঁকে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। তার আঁকা ছবি আমেরিকা, লন্ডন, ভারত, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে বিক্রি হয়েছে। সফল এ চিত্রশিল্পীর নাম ফারহানা আলম নিলা। সংসারে তার স্বামী, দুই মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ফাইনান্সে এমবিএ শেষ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তার ঝোঁক। সে কারণে শখ হিসাবে ছবি আঁকা বেছে নিয়েছেন। মা, বাবা ছবি আঁকার বিষয়ে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন সব সময়। নীলা বলেন, ‘স্কুল থেকেই আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি। মা ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ জুগিয়েছেন। দেখা যেত আমি ছবি আঁকলে মা সেই ছবিগুলো বাঁধিয়ে ঘরে সাজিয়ে রাখতেন।’

নিলা কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ছিল শিক্ষকতার ব্যস্ততা। সন্তান লালনপালনের ব্যস্ততা। সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে ছবি আঁকতে হতো। তবু ছবি আঁকা ছাড়তে পারেননি। ছবি আঁকার মধ্যে তিনি মনের শান্তি খুঁজে পান। নিলা জানান, ক্যানভাসে আমি ছবি আঁকতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ ছবি এঁকেছেন। ছবি বিক্রি করে মাসে তার আয় ২০ হাজার টাকার মতো। এ টাকার কিছু অংশ তিনি গরিব দুঃখীদের মধ্যে দান করেন। ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা নীলার এক একটি ছবির দাম।

পাহাড়ে শান্তির নীড়। নীলার খুব জনপ্রিয় একটি ছবি। ছবিটি নিউইয়র্কের ‘আরটাভিটা’ গ্যালারিতে ভার্চুয়ালি প্রদর্শিত হয়েছিল। সবুজ ঘাসে মোড়া ঢেউ খেলানো পাহাড়ি জমি, অবারিত প্রান্তর, নীল আকাশ আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে শান্তির নীড়। হালকা শীতে, গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। শহুরে যান্ত্রিকতা নেই। চারদিক কী নীরব, নিঝুম, নিস্তব্ধ! এই হচ্ছে পাহাড়ে শান্তির নীড় চিত্রকর্মের গল্প।

একজন মা। তার কত কাজ। কীভাবে এসব সামলে তিনি সফল উদ্যোক্তা হলেন জানতে চাইলে নীলা বলেন, ‘বাচ্চাদের পরীক্ষা, বাসায় মেহমান। কত কাজ! সব গুছিয়ে তবু সামলে নিয়েছি। রাত জেগে ছবির কাজ করে সকালে স্কুলেও গিয়েছি।’

নিলা প্রায় ১২টি এক্সিবিশনে ছবি নিয়ে অংশ নেন। অবসকিউর আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে তার ছবি ছিল। যেটা নিউইয়র্কের আরটাভিটা অনলাইন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এ ছাড়া কেপিআর আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন ফেস্টিভালে তার ছবি ছিল।

নিলার ছবি আমেরিকা, লন্ডন, ভারত, শ্রীলংকায় বিক্রি হয়েছে। ভারত, শ্রীলংকাতে গ্লোবাল ফরওয়ার্ডিং অ্যান্ড ফ্রেইট লিমিটেড কোম্পানি তার কাছ থেকে নিয়মিত পেইন্টিং নেয় বলে জানান নিলা। লন্ডনের কিছু রেস্টুরেন্টে তার ছবি শোভা বাড়াচ্ছে।

বর্তমানে নিলা বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। পাশাপাশি অনলাইনে শিশুদের পড়ান। নিজস্ব একটি আর্ট শোরুম দেওয়ার তার খুব শখ। এ ছাড়া চিত্রকর্ম নিয়ে একক চিত্র প্রদর্শনী করারও স্বপ্ন দেখেন তিনি।

গয়নায় ক্যারিয়ার গড়েছেন কাঁকন

ছোটবেলা থেকে তার গয়নার প্রতি ঝোঁক। নতুন গয়না ভেঙে জোড়া লাগাতেন। ভাঙা গয়না জোড়া দিয়ে কিছুটা ভিন্ন রূপ দিতে চাইতেন। কৌতূহলের বসে ২০১২ সালে ফেসবুকে পেজ খুলেন। এখন তার মাসিক আয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এমবিএ শেষ করেছেন। চাকরির পেছনে না ছুটে গয়নাতেই গড়ে নিয়েছেন ক্যারিয়ার। সফল এ উদ্যোক্তার নাম নুসরাত জাহান কাঁকন।

কাঁকনের জন্ম চট্টগ্রামে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে থেকেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তিনি খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। বিবিএ, এমবিএম শেষ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ল কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি গয়না নিয়ে কাজ করছেন। স্বামী আর এক সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। তিনি ‘উই’-এর একজন সদস্য। উই থেকে আসা বেশ কয়েকটি কোর্সে অংশ নিয়েছেন। উদ্যোক্তার কাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। নিজ থেকেই চেষ্টা করে শিখেছেন। ২০১২ সালে স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় ফেসবুকে পেজ খুলেন। কাঁকন বলেন, ‘কৌতূহলের বশে পেজ খুলেছিলাম। দেখার জন্য কেমন সাড়া পাওয়া যায়। শুরুতেই ক্রেতা মিলে যায়।’

অনলাইনে গয়না তো অনেকেই বিক্রি করেন। তার গয়নার আলাদা কিছু আছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে কাঁকন বলেন, ‘গয়নার কোয়ালিটি, গয়নার প্রেজেন্টেশন মানুষ পছন্দ করে। যুগের সঙ্গে যখন যে গয়নার চল, আমি সেটাই তৈরি করি। দেশীয় উৎসবগুলো ঘিরে গয়না তৈরি করি। মেটালের হাতের তৈরি নানা গয়না, কড়ির গয়না, চুড়ি, মুক্তার গয়না, কাঠের গয়না, মেটাল, বিডস-এর গয়না, হিজাব পিন, বিভিন্ন ধরনের দামি পাথর এবং মুক্তার ডিজাইনের গয়না তার কাছে পাওয়া যায়। নিজের পণ্য নিয়ে এ পর্যন্ত কাঁকন ছয়টি মেলায় অংশ নেন। এর মধ্যে উদ্যোক্তা দিবসে যুব উন্নয়ন সংস্থার প্রদর্শনীতে হ্যান্ডিক্রাফট বিভাগে ২য় স্থান অর্জন করেন। অনলাইনেই তার সব বেচাবিক্রি। মাত্র দুই হাজার টাকা ছিল তার শুরুতে মূলধন। এখন মাসে প্রায় ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। তবে উৎসবের সময় বিক্রি বেশি হয়। কাঁকন জানান, ‘আমার স্পেশাল গয়না হলো চায়না থেকে আমদানি করা রিয়েল পার্লের গয়নাগুলো। যেগুলোর চাহিদা আমার পেজে অনেক বেশি।’

নারী উদ্যোক্তা হিসাবে সমস্যার কথা জানতে চাইলে কাঁকন বলেন, ‘নারী হিসাবে যতটা না সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি তার চেয়ে বেশি হয়েছি বিবাহিত নারী হিসাবে। বিবাহিত নারী উদ্যোক্তা হয়ে আমি শুরুতে শুনেছিলাম, স্বামী হাত খরচ দিতে পারে না বলেই আমি এ ব্যবসায় এসেছি। বিষয়টা মোটেও তা নয়। নিজেকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলা, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পাশপাশি নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবসায় আসা।’

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন