মাকে অবহেলা নয়

 সুরাইয়া নাজনীন 
০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৫ বছরে মাকে রাস্তাঘাটে ফেলে যাওয়ার প্রায় আড়াইশ ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। বাস্তব চিত্র হয়তো আরও ভয়াবহ। বার্ধক্যে এসে পরিবারের কাছে হয়ে পড়ছেন মূল্যহীন। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া দুরূহ। লিখেছেন- সুরাইয়া নাজনীন

ভোরের আলো ফোটার আগেই তার ঘুম ভাঙে। সংসারে নিরলস খেটে যাওয়া যেন নিত্যরুটিন। তবু হাসি লেগে থাকে সেই মাঝরাতে ঘুমোতে যাওয়া অব্দি। তিনি আর কেউ নন, তিনি ‘মা’। শত ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে তুমি-ই মা। ইদানীং চোখ মেললেই কিছু ঘটনা গোচরে আসছে মাকে ঘিরে। বৃদ্ধাশ্রমের ঘটনাগুলো সবার সয়ে গেলেও অর্ধেক রাতে মাকে রাস্তায় ফেলে যাওয়া বুক কেঁপে ওঠার মতো! তবে বিশেষজ্ঞরা এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই ব্যাখ্যা করেছেন।

বর্তমান সময়ে মায়ের প্রতি ভালোবাসার জায়গাটা খুব বিবর্ণ যেন। ভালোবাসা শব্দটি অবহেলায় পরিণত হয়েছে। সন্তানকে রঙিন শৈশব উপহার দিতে মা দিনভর পরিশ্রম করছেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সন্তানের ভালোটাই নিশ্চিত করাই যেন ব্রত। নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সন্তানের মাঝেই নিজেকে খুঁজে ফিরছেন। সংসারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন চললেও সন্তানের প্লেটে কিংবা পোশাকে কখনো তা দৃষ্টিগোচর নয়। নিজে ছেঁড়া শাড়িতে চোখের পানি মুছলেও সন্তানের সামনে হাসির কমতি নেই।

এইতো কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের একটি ঘটনা সবাইকে অবাক করেছে। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশুল্লি ইউনিয়নের একটি বিলে ৮৮ বছরের বৃদ্ধাকে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলে রেখে যান তার ছেলে। যাওয়ার সময় এ-ও বলে গেছেন, একটু পরেই এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কই? আর আসেননি মমতাময়ী মায়ের কাছে। এ ফেলে যাওয়া যেন মৃত্যুর থেকেও কষ্টের মায়ের কাছে। সারারাত যত্নে কোলে আগলে রাখা সন্তানটিই মায়ের ঠিকানা নির্ধারণ করল জঙ্গলে!

গত বছরই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেকটি ঘটনা সবার নজরে এসেছিল। ৮২ বছরের অসুস্থ বৃদ্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন ছেলে। পরে একজনের সহায়তায় বৃদ্ধা মাকে উদ্ধার করে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

এরকম নিষ্ঠুর ঘটনা প্রায়ই কম-বেশি দেখা যাচ্ছে। গত ৫ বছরে মাকে রাস্তাঘাটে ফেলে যাওয়ার প্রায় আড়াইশটি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। বাস্তব চিত্র হয়তো আরও ভয়াবহ। বার্ধক্যে এসে পরিবারের কাছে হয়ে পড়ছেন মূল্যহীন। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া দুরূহ। আমাদের সমাজের চারপাশে বাবা-মার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে ভূরিভূরি। এরপরও মায়ের কাছে সন্তান যে কতটা প্রিয়, তা উদাহরণ দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে নিষ্ঠুর আচরণ পেলেও মায়েরা সন্তানের জন্য চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারে পিছপা হন না। কোনো কার্পণ্য করেন না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘প্রথমে মা’কে মানুষ বলে গণ্য করা শিখতে হবে। মা যে সারাজীবন দিয়েই যাবে এমন ধারণা বদলাতে হবে। স্বামী, সংসার, সন্তানের জন্য যে যত বেশি ত্যাগ করবে, সেই তত ভালো নারী, স্ত্রী কিংবা মা এ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোও বদলাতে হবে। মাকেও অধিকার আদায় শিখতে হবে। সংসারের জন্য তিনি কেন এক হাতে করে যাবেন? সবারই দায়দায়িত্ব আছে। সেগুলো মাকে বুঝতে হবে। নারী-পুরুষের সমতা রক্ষায় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার আদায় হলে একজন নারী কিংবা মা কখনই অবহেলার পাত্র হবেন না।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড রিসার্চ-এর মনোচিকিৎসক প্রফেসর ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে অবহেলার বিষয়টি একেবারেই বিপরীতমুখী। মা কেনই বা অবহেলার পাত্র হতে যাবেন। জেনেটিক্যালিই মায়ের সঙ্গে সন্তানরা মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ। হরমোনের বিষয়তো রয়েছেই। মা চান যে কোনো মূল্যে সন্তানকে ভালো রাখতে। সন্তান যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তখন নানা রকম শাসনের বেড়াজাল তৈরি হয়। টিনএজ সময়ে অনেক সন্তানই এসব সহ্য করতে পারে না, তখন সন্তান মাকে শত্রুপক্ষ মনে করে। কিন্তু মা যে সুদূর পথটি দেখতে পেয়ে এসব করেন তা সন্তান তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারেন না। চারপাশে সামাজিক অসংগতি থেকে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আবার আর একটা পর্যায়ে সন্তানের সঙ্গে মায়ের দূরত্ব চলে আসে আর তা হলো বিয়ের পর। ছেলের বৌয়ের সঙ্গে মায়ের বোঝাপড়া ঠিক না হলে মা-সন্তান যেন নদীর একূল ওকূল।’ তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের যখন ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, তখন তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ছেলেকে নিবেদিত থাকতে হবে। মা কোনো অপরাধ করলেও তা শান্তভাবে সমাধান করতে হবে। কোনোরকম শাস্তির সমাধান এখানে অন্যায়। অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ইদানীং দেখা যাচ্ছে। এগুলো সামনে তুলে ধরাও সামাজিক অবক্ষয় বলেই আমার মনে হয়।’

পজেটিভথিংকিং-সার্ভিসেস ফর স্পেশালনিডসচিলড্রেন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর নুরুন্নাহার নূপুর বলেন, ‘বড় দাগে আমার যেটা মনে হয় তা হলো, আমাদের সমাজের নারীরা এখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। তাচ্ছিল্য আর অবদমিত হতে হতে একপর্যায়ে তিনি সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়ান। অনেক মা-ই আছেন সংসার-সন্তানের জন্য নিজের মেধা, মনন কাজে লাগান না। একপর্যায় গিয়ে ইচ্ছা থাকলেও সেই সময়টা হারিয়ে ফেলেন। তাই পরিবারের সহযোগিতা অনেকাংশেই ভূমিকা রাখতে পারে। আবার নৈতিক শিক্ষাটা খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়। সন্তান বড় হয়ে সংসারের হাল ধরছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আনছে। কিন্তু তার মনে ভালোবাসা, বিবেক, নৈতিকতা নেই। এসব বিষয় থেকেই সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে।’

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন