চার জয়িতার জীবন জয়

 আবদুর রব, বড়লেখা (মৌলভীবাজার) থেকে 
০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নানা প্রতিবন্ধকতা আর দারিদ্র্যের মধ্যেও জীবনসংগ্রামে উদ্যমী অনেক নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে সমাজ ও দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এমনি চার জয়িতা হলেন মৌলভীবাজারের বড়লেখার শাহানাজ আক্তার, হাসি রানী দত্ত, ছালেহা বেগম ও সালমা বেগম। বড়লেখা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সৌমিত্র কর্মকার জানান, বড়লেখায় গত বছর জয়িতা অন্বেষণে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, চাকরি, সংসার ও নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো এমন চারজন সফল নারীকে খুঁজে এনে সর্বশেষ বেগম রোকেয়া দিবসে সম্মাননা দিয়েছে বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।

শাহানাজ আক্তার : জীবনসংগ্রামে লড়াকু নারী শাহানাজ আক্তার। একজন সমাজসেবক হিসাবে তিনি এলাকার যে কোনো সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুকবিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তিনি সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ জনগণ তাকে ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউপির সংরক্ষিত মহিলা আসন ১, ২, ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সমাজসেবা তার কাছে আরও সহজ হয়ে যায়। এলাকার রাস্তাঘাট, পুল-কার্লভাট ইত্যাদি নির্মাণ ও উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন শাহানাজ।

হাসি রানী দত্ত : গোলাপগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। পিতার সামান্য রোজগারে চলত সংসার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে হাসি রানী সবার বড়। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারের সব ভার পড়ে তার ওপর। আর্থিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। গ্রামের একমাত্র মেয়ে হিসাবে ১৯৬৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাশ করেন। সংসারের চাকা সচল ও ভাইবোনদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াসহ সবকিছুর হাল ধরেন তিনি। এ সময় তিনি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে যান। এর মধ্যে তার বাবাও মারা যান। তখন তিনি নিজেই সবকিছু সামাল দেন। চার ভাইবোনকে লেখাপড়া করিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯৬৬ সালে তিনি বিবাহসূত্রে বড়লেখায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে চাকরি করেন। তিনি দুই ছেলেমেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে স্বনামধন্য ডাক্তার। ছোট মেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন। মা হিসাবে তিনি যেমন সফল, তেমনি শিক্ষক হিসাবেও। তার এ জীবনসংগ্রাম এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য হাসি রানীও হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা।

ছালেহা বেগম : স্বামী ছিলেন বড়লেখা উপজেলা জামে মসজিদের ইমাম। ২০০৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন ছালেহা। কীভাবে ছয় সন্তানকে মানুষ করবেন? অভাব-অনটনে বাধ্য হয়ে বড় মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেন। ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি যখন যে কাজ পেতেন, তাই করতেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে সংসারের ব্যয় মিটিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে বিবিএ (ম্যানেজমেন্ট) অধ্যয়নরত অবস্থায় হাওড় প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহকারী হিসাবে চাকরিতে যুক্ত হন। মেজো মেয়ে মৎস্য অধিদপ্তরে উপসহকারী মৎস্য কর্মকর্তা (১০ম গ্রেড) হিসাবে কর্মরত। সেজো মেয়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত আইজিএ প্রজক্টের ফ্যাশন ডিজাইনার ট্রেডের প্রশিক্ষক। ছোট ছেলে সিলেট এমসি কলেজ থেকে সম্প্রতি জুওলজি বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ছোট মেয়ে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। কঠিন দারিদ্র্যের মাঝেও ছালেহা বেগম সন্তানদের মানুষ করতে যে লড়াই করেছেন তা সত্যই প্রশংসনীয়। আর এর পুরস্কার হিসাবে তিনিও হয়েছেন উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা।

সালমা বেগম : কেউ যদি দূরদর্শী হয়, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই। এমনই এক সাহসী নারীর প্রতীক সালমা বেগম। দারিদ্র্য তার চলার পথকে করেছে কণ্টকময়। সালমা বেগম নিজের চেষ্টাতে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ভিটেমাটি বিক্রি করে সন্তানের সুখের আশায় মা-বাবা সালমা বেগমকে বিয়ে দেন। তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়। তার স্বামী প্রায়ই যৌতুকের জন্য সালমা বেগমকে নির্যাতন করত। মাদকাসক্ত স্বামী একসময় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এতেও থেমে যায়নি তার পথচলা। তিনি সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের মানুষের জামা-কাপড় তৈরি করতে শুরু করেন। সেলাইয়ের আয়ে চালান সংসার। এর মধ্যে অনেক আশা নিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। দ্বিতীয় বিয়েও বেশি দিন টেকেনি। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও ভেঙে পড়েনি। সেলাই কাজকে পেশা হিসাবে বেছে নেন আবার। আর এভাবে নিজে যেমন সফল হয়েছেন, তেমনি গ্রামের অনেক দরিদ্র মেয়ে তার কাছ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন তারা স্বাবলম্বী। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সালমা বেগমও হয়েছেন উপজেলার একজন জয়িতা।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন