প্রান্তিক জীবন

রোকেয়ার এক জীবনের গল্প

 শওকত আলী রতন 
০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

সত্তরোর্ধ্ব নারী রোকেয়া বেগম। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়ে দুই সন্তাকে নিয়ে পড়েন বিপাকে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জীবনযুদ্ধে নাম লেখান। এখনো থেমে নেই সেই যুদ্ধ। রোকেয়ার সংগ্রামী জীবনের গল্প লিখেছেন- শওকত আলী রতন

রোকেয়া বেগমের বাড়ি ছিল ঢাকার দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়া এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের আগে পাশের গ্রামের শেখ স্বপনের সঙ্গে বিয়ে হয় রোকেয়ার। স্বামীর ঘরবাড়ি না থাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। যুদ্ধের সময় রোকেয়ার কোলজুড়ে আসে এক কন্যাসন্তান। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করায় অসুস্থ হয়ে মারা যায় প্রথম সন্তান। দেড় বছরের ব্যবধানে কোলজুড়ে আসে দুই পুত্রসন্তান। নাম রাখেন সালাম ও আসলাম। বড় ছেলের বয়স যখন ৭ বছর, আর ছোট ছেলের সাড়ে ৫-তখন রোকেয়ার স্বামী শেখ স্বপন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে অকালেই মারা যান রোকেয়ার স্বামী।

দুই সন্তান নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠে পারছিলেন না রোকেয়া! কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। উপজেলার নাশিরা এলাকায় জাভেদ দারোগার বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন। দুই সন্তান নিয়ে ওই বাড়িতেই থাকতেন। দেড় বছর কাজ করার পর সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসায় কাজ পান। বাসাবাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি দুই ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন মাদ্রাসায়। কয়েক বছর সেখানে থাকার পর চলে আসেন রাজধানীর ধানমন্ডিতে। সেখানে বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়ার কাজ করতেন। এভাবে দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে রোকেয়াকে।

বেশি দিন থাকা হয়নি ধানমন্ডিতে। সেখান থেকে ঠাঁই হয় কেরানীগঞ্জ উপজেলার চড়াইল এলাকার ভাড়া বাড়িতে। কোনোরকম দিন চলে যাচ্ছিল। এরইমধ্যে দুই ছেলে বিয়ে করার কিছুদিনের মধ্যে যার যার মতো আলাদা সংসার গড়েন।

হঠাৎ একদিন রোকেয়ার পরিচিত এক মহিলা এসে দেখা করেন তার সঙ্গে। ২১ দিন বয়সি এক ছেলেসন্তানকে তার কোলে তুলে দিয়ে বলেন, ‘ছেলেটার বাবা-মা বেঁচে নেই, আজ থেকে তুমি ওর সব।’ রোকেয়া অনাথ ছেলেটিকে সাদরে গ্রহণ করে নাম রাখেন আসাদ। সন্তানের মতোই লালন পালন শুরু করেন। অভাবের সংসার রোকেয়ার। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে আসাদকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। ধীরে ধীরে বড় করে তুলেন আসাদকে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর একটি কারখানায় কাজ পাইয়ে দেন আসাদকে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর পরিচিত একজনের মাধ্যমে আসাদ কাজ পায় ডিএনকে পরিবহনের বাস শ্রমিক হিসাবে। অধিকাংশ সময় রাতে বাসেই ঘুমাতে হতো। ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে একদিন খবর এলো ছিনতাইকারীরা বাসসহ আসাদকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

পরদিন কেরানীগঞ্জে বালুর মাঠে আসাদের লাশ শনাক্ত করে পুলিশ। বাসটি উদ্ধার করে বগুড়া থেকে। থানায় মামলাও হয়। এখনো মামলা চলমান। কিন্তু রোকেয়া ছেলের বিচারের জন্য পথ চেয়ে আছেন। ছেলেকে হারানোর পর কেরানীগঞ্জ থেকে চলে আসেন দোহারে।

দোহার জন্মস্থান হলেও এখানে তেমন কেউ নেই রোকেয়ার। উপজেলার জয়পাড়ার রতন স্বাধীনতা চত্বরের রাস্তার পাশে আইল্যান্ডের ওপর বসেই অধিকাংশ সময় কাটে। হাতে থাকে কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে ছেলের ফ্রেমবন্দি ছবি। আসাদ সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে দ্রুত ব্যাগ থেকে ছেলের ছবি বের করেন। ঘটনা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু নেই আর। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পালিত সন্তানের বিচারের অপেক্ষায় থাকবেন বলে জানান রোকেয়া। অনেকে মামলা নিয়ে আপসের কথা বললেও তিনি এড়িয়ে যান। কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে সময় কাটে রোকেয়ার। পরিচিতি মানুষজন মুখের দিকে তাকিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেন। তা দিয়েই কোনো রকম দিন চলে যায় রোকেয়ার।

এক জীবনে সুখ হয়নি রোকেয়ার। তবু বেঁচে আছেন বাঁচার তাগিদে। শরীরের নানা রোগশোক দানা বেঁধেছে। শাসকষ্ট ও হৃদরোগের নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে কারও কাছে হাত পাতেন না, অনেকেই মায়া করে যা দেন তাই দিয়ে চলে যায় দিন। এভাবেই দিন কাটছে। রোকেয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে আমার ছেলেকে ওরা হত্যা করল কেন! আমি কিছু চাই না। আমার আসাদের হত্যাকারীদের বিচার চাই!’

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন