ইজতেমা মাঠ রণক্ষেত্র, নিহত ১
তাবলিগের দুই পক্ষের বিরোধ
আহত দুই শতাধিক * তীব্র যানজট, সীমাহীন দুর্ভোগ
যুগান্তর রিপোর্ট
০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
‘পাঁচ দিনের জোড়’কে (বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি সম্মেলন) কেন্দ্র করে শনিবার তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি। সংঘর্ষ চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়কসহ আশপাশের প্রায় সব সড়কই বন্ধ হয়ে যায়। চরম দুর্ভোগে পড়েন বিদেশগামী যাত্রীসহ বহু মানুষ।
সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির নাম ইসমাইল মণ্ডল (৬২)। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিল্কীপাড়ায়। তিনি ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী ছিলেন।
মাওলানা সাদের অনুসারীদের সঙ্গে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং বাংলাদেশের কওমি ও হেফাজতপন্থী আলেমদের অনুসারীদের মধ্যে এদিন এ সংঘাত হয়। দুই পক্ষের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিরোধ চলে আসছে।
সংঘর্ষের পর বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের জোড়, প্রস্তুতি সম্মেলন বা ইজতেমা হবে না। এ ধরনের সব কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে। নির্বাচনের পর তাবলিগের মুরব্বিরা বসে ইজতেমার দিনক্ষণ ঠিক করবেন। ততদিন ইজতেমা মাঠ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, মাওলানা সাদপন্থীরা শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে ‘পাঁচ দিনের জোড়’ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সাদবিরোধীরা এ জোড় প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। এর কয়েকদিন আগেই তারা ময়দানে অবস্থান নেয়।
বিপরীতে সাদপন্থীরা ময়দানে ঢুকতে না পেরে ময়দানের আশপাশে ও রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান নেন। শনিবার সকালে তারা ইজতেমা ময়দানে গেলে ময়দানের প্রতিটি গেটে তালা দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, জোড়ে যোগ দিতে আসা লোকজন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়দানের ফটকের তালা ভেঙে এবং সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় দুই পক্ষের লোকজন বাঁশ ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষ থেকেই বৃষ্টির মতো ঢিল ছোড়া হয়।
সেই ঢিল আর লাঠির আঘাতে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। এক পর্যায়ে মাওলানা সাদের অনুসারীরা অন্য পক্ষকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে মাঠের দখল নেয়। সংঘর্ষ চলাকালে ইজতেমা মাঠে থাকা প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়।
ওসি আরও বলেন, সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে পথচারীরা দিগবিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। এ ঘটনায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয়পাশ, উত্তরা-হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, টঙ্গী-কামারপাড়া রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন স্কুল, কলেজ, চাকরিজীবী বিদেশগামী এবং দূরপাল্লার যাত্রীরা। পরে দুপুর ২টার পর পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম কাওসার চৌধুরী জানান, সংঘর্ষের মধ্যে ইসমাইল মণ্ডল নামে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
সাদপন্থী হিসেবে পরিচিত তাবলিগ জামাতের শূরা সদস্য মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, নিহত মো. ইসমাইল মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের খলিল মণ্ডলের ছেলে। তিনি তাদেরই অনুসারী ছিলেন।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ হোসেন জানিয়েছেন, দুপুর পর্যন্ত দুই শতাধিক লোক এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছি। এছাড়া আশপাশের কিছু হাসপাতাল-ক্লিনিকেও বেশ কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছেন।
আহতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। এরা হলেন : রিয়াজুল ইসলাম (৩৫), রিফাত হোসেন (১৯), মতিউর রহমান (৪৩), ওমর ফারুক (৩৪), রাজু আহমেদ (৪৪), ইমান আলী (৩৭), জালাল খাঁ (৪৩), মো. সাইফুল ইসলাম (৪০), মাওলানা তাওহিদুল ইসলাম (৫৫), হাফেজ আবু বক্কর (৩৫), মো. গোলাম কিবরিয়া (৪২), মো. জুয়েল (১৮), হাজী মো. রেজাউল করিম (৪৫), আশ্রাফুল ইসলাম ((১৮), মতিউর রহমান (৪৫), মাহমুদ হোসেন (৩৪), শামীম আহমেদ (৩২), মনিরুল ইসলাম (২৩), মানিক হোসেন (৩৩), মো. দাউদ হোসেন (৪০), তাহের আলী (৩৭), আবু নাঈম (২৩), নজরুল ইসলাম (৪৪), আবুল কালাম আজাদ (৪৫), মো. কামরুজ্জামান (৪৩), জহিরুল ইসলাম (৩৪), কামাল খাঁ (৪৫), মাহবুবু হোসেন (২৫), রোস্তম আলী (৪৪), রাশেদ মিয়া (২৭), আবদুর রব (৩৩), আব্দুল হামিদ (৩৬), মাহফুজুর রহমান (৫৩), মুরাদ হোসেন (৪৬), শহিদুল ইসলাম (৪৫), রিফাত হোসেন (২০), রাশেদুল ইসলাম (২৫), হযরত আলী (৩৭)। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে বেশির ভাগই মাথা, নাক ও পিঠে আঘাত পাওয়া।
আশরাফুল ইসলাম নামের এক কুয়েতগামী যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, ফার্মগেট থেকে রওনা হয়েছি। বনানী থেকেই তীব্র যানজট। তাই ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হেঁটেই বিমানবন্দরে যাচ্ছি। সংঘর্ষের ঘটনায় বিমানবন্দরের একপাশের রাস্তা বন্ধ থাকায় আশরাফুলের মতোই হেঁটে গন্তব্যে রওনা হন বহু মানুষ।
সংঘর্ষের খবর পেয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম দ্রুত ছুটে আসেন। ইজতেমার দু’পক্ষের মুরব্বিদের সঙ্গে মুন্নু শাহী জামে মসজিদে বৈঠক করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কোনো পক্ষই ময়দানে অবস্থান করতে পারবে না। আজকের (শনিবার) মধ্যেই ময়দান খালি করে দেবেন।
পরে মাওলানা আশরাফ আলী ও মুফতি নূরুল ইসলাম ময়দানে গিয়ে মাইকে সবাইকে ময়দান ছাড়ার নির্দেশ দেন। মুসল্লিরা ময়দান ছাড়লে পরিস্থিতি শান্ত হয়। শাহী মসজিদের বৈঠকে আরও ছিলেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান, জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ওই পক্ষের লোকজন কয়েকদিন ধরে মাঠ দখল করে রেখেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে আমাদের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। জোড়ে যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিরা ময়দানে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা বাধা দিয়েছে। এ কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কওমিপন্থী মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, বাচ্চারা না, ওখানে বড়রাই আছে। তারা বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির জন্য কাজ করছে। সাদের পক্ষের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সেখানে গিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছে।
উত্তরা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, উভয় গ্রুপ দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হলে পুলিশ কারও ওপর লাঠিচার্জ করেনি। বরং পুলিশ সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।
যুগান্তরের হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, টঙ্গীর মাঠে সাদ অনুসারীদের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন হেফাজত ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এক বিবৃতিতে তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দিকে নজর দিতে সরকার এবং প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, টঙ্গীর মাঠ দখল নিতেই এ হামলা হয়েছে।
যুগান্তরের মুন্সীগঞ্জের স্টাফ রিপোর্টার জানান, মুন্সীগঞ্জের রামপাল ইউনিয়নের মিল্কিপাড়া গ্রামের ইসমাইল মণ্ডল (৬২) বৃহস্পতিবার ছেলে জাহিদের হাত ধরে ঢাকায় যান। ইসমাইলের মেয়ে নিপা জানান, ৫ বছর আগে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। মাঝে মাঝে চলে যান চিল্লায়। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এলেও তারা মনে করেন বাবা শহীদ হয়েছেন। রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত লাশ মুন্সীগঞ্জে এসে পৌঁছেনি।
তাবলিগের নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লির মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। চলতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় বিশ্ব ইজতেমার সময় বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসা সাদ কান্ধলভি ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সরকারের মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে ওই বিরোধের জের চলে বছরজুড়ে। গত এপ্রিলে দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সাদের অনুসারীরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে পাঁচ দিনের জোড় এবং ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে দেওবন্দপন্থীরা ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা এবং ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের কথা জানায়।
এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে ১৬ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে এক বৈঠক থেকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব স্থগিত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ নির্ধারণে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের দেওবন্দে যাবে। দুই পক্ষ সমঝোতায় এলে নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে।
এরই মধ্যে সাদপন্থীরা ৩০ নভেম্বর থেকে জোড় করার প্রস্তুতি নিলে অন্যপক্ষ তুরাগ তীরে ইজতেমা মাঠের সব কটি ফটকে পাহারা বসায়। এ পরিস্থিতিতে সাদপন্থীরা ২৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।
অন্যদিকে ২৪ নভেম্বর ইসিতে চিঠি দিয়ে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভয়াবহ অবনতির শঙ্কা’ প্রকাশ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করে সাদবিরোধীরা। এর ভিত্তিতে ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান শুক্রবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান না করার নির্দেশনা দেন।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
তাবলিগের দুই পক্ষের বিরোধ
ইজতেমা মাঠ রণক্ষেত্র, নিহত ১
আহত দুই শতাধিক * তীব্র যানজট, সীমাহীন দুর্ভোগ
‘পাঁচ দিনের জোড়’কে (বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি সম্মেলন) কেন্দ্র করে শনিবার তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি। সংঘর্ষ চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়কসহ আশপাশের প্রায় সব সড়কই বন্ধ হয়ে যায়। চরম দুর্ভোগে পড়েন বিদেশগামী যাত্রীসহ বহু মানুষ।
সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির নাম ইসমাইল মণ্ডল (৬২)। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিল্কীপাড়ায়। তিনি ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী ছিলেন।
মাওলানা সাদের অনুসারীদের সঙ্গে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং বাংলাদেশের কওমি ও হেফাজতপন্থী আলেমদের অনুসারীদের মধ্যে এদিন এ সংঘাত হয়। দুই পক্ষের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিরোধ চলে আসছে।
সংঘর্ষের পর বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের জোড়, প্রস্তুতি সম্মেলন বা ইজতেমা হবে না। এ ধরনের সব কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে। নির্বাচনের পর তাবলিগের মুরব্বিরা বসে ইজতেমার দিনক্ষণ ঠিক করবেন। ততদিন ইজতেমা মাঠ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, মাওলানা সাদপন্থীরা শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে ‘পাঁচ দিনের জোড়’ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সাদবিরোধীরা এ জোড় প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। এর কয়েকদিন আগেই তারা ময়দানে অবস্থান নেয়।
বিপরীতে সাদপন্থীরা ময়দানে ঢুকতে না পেরে ময়দানের আশপাশে ও রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান নেন। শনিবার সকালে তারা ইজতেমা ময়দানে গেলে ময়দানের প্রতিটি গেটে তালা দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, জোড়ে যোগ দিতে আসা লোকজন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়দানের ফটকের তালা ভেঙে এবং সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় দুই পক্ষের লোকজন বাঁশ ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষ থেকেই বৃষ্টির মতো ঢিল ছোড়া হয়।
সেই ঢিল আর লাঠির আঘাতে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। এক পর্যায়ে মাওলানা সাদের অনুসারীরা অন্য পক্ষকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে মাঠের দখল নেয়। সংঘর্ষ চলাকালে ইজতেমা মাঠে থাকা প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়।
ওসি আরও বলেন, সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে পথচারীরা দিগবিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। এ ঘটনায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয়পাশ, উত্তরা-হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, টঙ্গী-কামারপাড়া রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন স্কুল, কলেজ, চাকরিজীবী বিদেশগামী এবং দূরপাল্লার যাত্রীরা। পরে দুপুর ২টার পর পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম কাওসার চৌধুরী জানান, সংঘর্ষের মধ্যে ইসমাইল মণ্ডল নামে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
সাদপন্থী হিসেবে পরিচিত তাবলিগ জামাতের শূরা সদস্য মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, নিহত মো. ইসমাইল মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের খলিল মণ্ডলের ছেলে। তিনি তাদেরই অনুসারী ছিলেন।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ হোসেন জানিয়েছেন, দুপুর পর্যন্ত দুই শতাধিক লোক এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছি। এছাড়া আশপাশের কিছু হাসপাতাল-ক্লিনিকেও বেশ কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছেন।
আহতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। এরা হলেন : রিয়াজুল ইসলাম (৩৫), রিফাত হোসেন (১৯), মতিউর রহমান (৪৩), ওমর ফারুক (৩৪), রাজু আহমেদ (৪৪), ইমান আলী (৩৭), জালাল খাঁ (৪৩), মো. সাইফুল ইসলাম (৪০), মাওলানা তাওহিদুল ইসলাম (৫৫), হাফেজ আবু বক্কর (৩৫), মো. গোলাম কিবরিয়া (৪২), মো. জুয়েল (১৮), হাজী মো. রেজাউল করিম (৪৫), আশ্রাফুল ইসলাম ((১৮), মতিউর রহমান (৪৫), মাহমুদ হোসেন (৩৪), শামীম আহমেদ (৩২), মনিরুল ইসলাম (২৩), মানিক হোসেন (৩৩), মো. দাউদ হোসেন (৪০), তাহের আলী (৩৭), আবু নাঈম (২৩), নজরুল ইসলাম (৪৪), আবুল কালাম আজাদ (৪৫), মো. কামরুজ্জামান (৪৩), জহিরুল ইসলাম (৩৪), কামাল খাঁ (৪৫), মাহবুবু হোসেন (২৫), রোস্তম আলী (৪৪), রাশেদ মিয়া (২৭), আবদুর রব (৩৩), আব্দুল হামিদ (৩৬), মাহফুজুর রহমান (৫৩), মুরাদ হোসেন (৪৬), শহিদুল ইসলাম (৪৫), রিফাত হোসেন (২০), রাশেদুল ইসলাম (২৫), হযরত আলী (৩৭)। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে বেশির ভাগই মাথা, নাক ও পিঠে আঘাত পাওয়া।
আশরাফুল ইসলাম নামের এক কুয়েতগামী যাত্রী যুগান্তরকে বলেন, ফার্মগেট থেকে রওনা হয়েছি। বনানী থেকেই তীব্র যানজট। তাই ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হেঁটেই বিমানবন্দরে যাচ্ছি। সংঘর্ষের ঘটনায় বিমানবন্দরের একপাশের রাস্তা বন্ধ থাকায় আশরাফুলের মতোই হেঁটে গন্তব্যে রওনা হন বহু মানুষ।
সংঘর্ষের খবর পেয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম দ্রুত ছুটে আসেন। ইজতেমার দু’পক্ষের মুরব্বিদের সঙ্গে মুন্নু শাহী জামে মসজিদে বৈঠক করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কোনো পক্ষই ময়দানে অবস্থান করতে পারবে না। আজকের (শনিবার) মধ্যেই ময়দান খালি করে দেবেন।
পরে মাওলানা আশরাফ আলী ও মুফতি নূরুল ইসলাম ময়দানে গিয়ে মাইকে সবাইকে ময়দান ছাড়ার নির্দেশ দেন। মুসল্লিরা ময়দান ছাড়লে পরিস্থিতি শান্ত হয়। শাহী মসজিদের বৈঠকে আরও ছিলেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান, জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ওই পক্ষের লোকজন কয়েকদিন ধরে মাঠ দখল করে রেখেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে আমাদের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। জোড়ে যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিরা ময়দানে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা বাধা দিয়েছে। এ কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কওমিপন্থী মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, বাচ্চারা না, ওখানে বড়রাই আছে। তারা বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির জন্য কাজ করছে। সাদের পক্ষের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সেখানে গিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছে।
উত্তরা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, উভয় গ্রুপ দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হলে পুলিশ কারও ওপর লাঠিচার্জ করেনি। বরং পুলিশ সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।
যুগান্তরের হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, টঙ্গীর মাঠে সাদ অনুসারীদের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন হেফাজত ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এক বিবৃতিতে তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দিকে নজর দিতে সরকার এবং প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, টঙ্গীর মাঠ দখল নিতেই এ হামলা হয়েছে।
যুগান্তরের মুন্সীগঞ্জের স্টাফ রিপোর্টার জানান, মুন্সীগঞ্জের রামপাল ইউনিয়নের মিল্কিপাড়া গ্রামের ইসমাইল মণ্ডল (৬২) বৃহস্পতিবার ছেলে জাহিদের হাত ধরে ঢাকায় যান। ইসমাইলের মেয়ে নিপা জানান, ৫ বছর আগে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। মাঝে মাঝে চলে যান চিল্লায়। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এলেও তারা মনে করেন বাবা শহীদ হয়েছেন। রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত লাশ মুন্সীগঞ্জে এসে পৌঁছেনি।
তাবলিগের নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লির মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। চলতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় বিশ্ব ইজতেমার সময় বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসা সাদ কান্ধলভি ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সরকারের মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে ওই বিরোধের জের চলে বছরজুড়ে। গত এপ্রিলে দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সাদের অনুসারীরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে পাঁচ দিনের জোড় এবং ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে দেওবন্দপন্থীরা ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা এবং ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের কথা জানায়।
এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে ১৬ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে এক বৈঠক থেকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব স্থগিত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ নির্ধারণে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের দেওবন্দে যাবে। দুই পক্ষ সমঝোতায় এলে নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে।
এরই মধ্যে সাদপন্থীরা ৩০ নভেম্বর থেকে জোড় করার প্রস্তুতি নিলে অন্যপক্ষ তুরাগ তীরে ইজতেমা মাঠের সব কটি ফটকে পাহারা বসায়। এ পরিস্থিতিতে সাদপন্থীরা ২৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।
অন্যদিকে ২৪ নভেম্বর ইসিতে চিঠি দিয়ে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভয়াবহ অবনতির শঙ্কা’ প্রকাশ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করে সাদবিরোধীরা। এর ভিত্তিতে ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান শুক্রবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান না করার নির্দেশনা দেন।