হাসপাতালে ভর্তি-সেবা বন্ধ! চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা
করোনা আতঙ্কে সর্দি-জ্বর, হাঁচি-কাশি, গলাব্যথা থাকলে অন্য রোগের চিকিৎসায় অনীহা * ভর্তি না করালে বা চিকিৎসা না দিলে ব্যবস্থা -ডক্টরস ফাউন্ডেশন
রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। এ ভাইরাসের উপসর্গের সঙ্গে সামান্য মিল পেলেই রোগী ভর্তি অথবা চিকিৎসা সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ কোনো কারণে সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা থাকলে অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা করাতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতেই প্রাণ হারাচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক সময়ে যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীতে ঠাসা থাকত সেগুলো এখন প্রায় রোগীশূন্য। করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাও হাসপাতাল ছাড়ছেন। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধ রেখেছেন ‘প্রাইভেট চেম্বারে’ রোগী দেখাও।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রথম সারির বেশ কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায় প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতেন। করোনা সংক্রমণের পর থেকে কিছুদিন ধরে তাদের চেম্বার বন্ধ রয়েছে। ফলে অনেক পিতা-মাতা অসুস্থ শিশুসন্তান নিয়ে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় একই অবস্থা বিরাজ করছে।
করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক ও নার্সদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) স্বল্পতা এবং সাধারণ রোগীরা যে করোনা আক্রান্ত নন, তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত হাসপাতালগুলোতে এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে-এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, যাদের ন্যূনতম করোনার উপসর্গ রয়েছে, তাদের পরীক্ষা করানো জরুরি। তাহলেই চিকিৎসকরা নিশ্চিন্তে সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে পারবেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত, বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসা না পেয়ে। এমনকি চিকিৎসক পরিবারের রোগীরাও পাচ্ছেন না হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে অনেক বেসরকারি হাসপাতালের ভালো চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও এখন সেই মাত্রায় সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি ডাক্তাররা অনেকেই ভালো সেবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের চেম্বারগুলো এখন বন্ধ রয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর আসছে। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা একটু স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আমি আশা করব আপনারা এগিয়ে আসবেন, দেশবাসীর পাশে থাকবেন।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। তিনি বুধবার চিকিৎসক নেতাদের সঙ্গে আলোচানা করে সব চিকিৎসককে রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের নির্দেশ দেন।
বিষয়টিকে আমলে নিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)। বুধবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটির মহাসচিব ডা. জাকির সুমন বলেন, সরকারি-বেসরকারি কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগীর চিকিৎসা বা ভর্তি না করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি, এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের অপেশাদার আচরণ পরিহার করার আহ্বান জানান।
এর আগে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক এমআইএ ডা. হাবিবুর রহমান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রয়েছে জানিয়ে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি অনেক চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ। এতে রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। আপনারা প্রাইভেট
চেম্বারে রোগী দেখেন। প্রয়োজনের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়ে যান।
ডক্টরস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মুখপাত্র ডা. নিরুপম দাশ যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীসহ দেশের সব হাসপাতালে আইসোলেশন বেড প্রস্তুত করা হল। সব হাসপাতালে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের জন্য পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দেয়া হল।
যদি রোগীদের সেবা দেয়া না হয় তাহলে এগুলো করা হল কেন। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে পিপিই নিশ্চিত করে ট্রায়জ (রোগের ধরন বুঝে রোগীদের পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা) প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। পাশাপাশি জনাসাধারণের সব ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
চিকিৎসা বঞ্চনার কয়েকটি ঘটনা : বুধবার ডা. তানিয়া শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তার মাকে নিয়ে রাজধানীর ৫টি সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হন। কিন্তু নিজে চিকিৎসক হয়েও কোথাও তার মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে পারেননি। বাসায় তার বাবা স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন।
বন্ধ রয়েছে তার নিয়মিত চিকিৎসা। একই দিন ডা. শান্তা জ্বর ও পাতলা পায়খানা আক্রান্ত ভগ্নিপতিকে নিয়ে যান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআর,বি)। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ভর্তি না নেয়ায় পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করাতে সক্ষম হন।
এ ছাড়া রাজধানীর আরেক চিকিৎসক তানিয়ার খালু একজন কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী। বুধবার সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের জন্য ভর্তি করাতে পারেননি। পরে এ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে গেলে আইসিইউ নেই বলে তারাও ভর্তি নেয়নি।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া সাংবাদিকদের এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মৃত ব্যক্তিটি পুরুষ। বয়স পঞ্চাশের মতো।
মঙ্গলবার দুপুরেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন। রাতের দিকে তিনি মারা যান। উত্তম বড়ুয়া বলেন, ওই রোগী প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। কুর্মিটোলা ওই রোগীকে সোহরাওয়ার্দীতে পাঠিয়ে দেয়। রাত ৯টার দিকে তিনি মারা যান। ওই রোগীর শরীর থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় স্কুলছাত্রী সানজিদা ইসলাম সুমাইয়া (১৬) সপ্তাহখানেক আগে সর্দি, কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২৬ মার্চ শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় তার পরিবার। সেখানকার এক চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওই দিন সন্ধ্যায় সানজিদার অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়।
সেখানকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাৎক্ষণিক এক্স-রে করিয়ে প্রতিবেদন দেখার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পরে রাত ১টার দিকে ওই স্কুলছাত্রীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে মেয়েটিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
সেখান থেকে চট্টগ্রাম সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যেতে বলা হয়। রাতে ওই হাসপাতালের সেবা বন্ধ থাকে। তাই শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে মেয়েটিকে চট্টগ্রাম সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেফারেন্স ছাড়া করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে অস্বীকৃতি জানান।
এছাড়া এক হাসপাতাল থেকে অপর হাসপাতাল ছুটে গিয়েও ছোট্ট শিশু রিফাতকে ভর্তি করাতে পারেনি। যেখানেই যায় শুধু অন্যত্র পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এক প্রকার বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট রিফাত।
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে খুলনা নগরীর চারটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ধরনা দেন স্কুলছাত্র রিফাতের পরিবারের সদস্যরা। স্কুলছাত্র রিফাত খালিশপুর হাউজিং বিহারি ক্যাম্প নং-১-এর বাসিন্দা জুট মিল শ্রমিক মো. কাশেমের ছেলে। সে ওব্যাট প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আল আমিন নামের এক যুবক (২২) মারা গেছেন। জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে শনিবার বিকালে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। আল আমিনের বাড়ি নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার অলঙ্কারদিঘি গ্রামে। অসুস্থ হয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামে ফেরেন। কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাকে বাড়িতে থাকতে দেননি।
এ কারণে তিনি নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতাল, আদমদিঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, রানীনগর উপজেলা হাসপাতালসহ পাঁচটা হাসপাতাল ঘুরে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে শনিবার বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হন। আল আমিনের বাবা মোখলেসুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।