ধর্ষণ মামলার বিচার: হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষিত
দুই রিটের আদেশে ২৪ দফা নির্দেশনা * আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টের অসন্তোষ * উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
আলমগীর হোসেন
১০ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ধর্ষণ, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালত দুটি রিটের আদেশে ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। গত কয়েক বছরে এ ধরনের আরও কিছু রিটেও রুল, আদেশ ও নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু এসবের অধিকাংশই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
বছরের পর বছর এগুলো উপেক্ষিত। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এছাড়া মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে এসব মামলা বছরের পর বছর বিচারিক আদালতে ঝুলে অছে।
আদালতের নির্দেশনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ঘটনার পর কিছুদিন তোলপাড় চলে, মিছিল-মিটিং হয় তারপর সব চাপা পড়ে যায়।
সম্প্রতি নোয়াখালী ও সিলেটে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার দাবি উঠেছে।
সরকারও সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
মামলার রায়, আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ৭ অক্টোবর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশকিছু নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনা কেউ প্রতিপালন করেন না। বরং আদেশ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মাইন্ড (মন খারাপ) করেন।’
জানা গেছে, ১৬ বছরের নিচে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে সে ক্ষেত্রে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে জানুয়ারিতে রুল জারি করেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান আছে সেখান থেকে যাবজ্জীবন উঠিয়ে দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
এর আগে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে ধর্ষণের মামলা হলে সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় তা নেয়ার পাশাপাশি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোসহ ১৮ দফা নির্দেশনা আসে।
অন্য এক রায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন উচ্চ আদালত।
এদিকে এক রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। এর মধ্যে কয়েকটি মাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে। বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত অবস্থায় আছে।
এদিকে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বুধবার সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের স্মরণে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেন- আমরা জুডিশিয়ারিতে আছি, আমরা চাই দোষীদের উপযুক্ত বিচার হোক।
শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন নয় : ১৬ বছরের নিচে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে সে ক্ষেত্রে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে জানুয়ারিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রুল জারির পাশাপাশি নির্দেশনাও দেন।
আদালত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ ঠেকাতে একটি কমিশন গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ৩০ দিনের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ কমিশন গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এ কমিটিতে আইনজীবী, বিচারক, মানবাধিকারকর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, চিকিৎসক এবং ভিকটিমকে (যদি কোনো ভিকটিম রাজি থাকেন) রাখতে বলা হয়।
একই সঙ্গে কমিশনকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে আদালতে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার যুগান্তরকে বলেন, ৬ মাসের মধ্যে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে আদালতে প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন কোর্টে আসেনি।
যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের বিচারে হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনা : যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর সুরক্ষা, নিরাপত্তা, তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত ওই ১৮টি নির্দেশনাকে ‘নীতিমালা’ হিসেবে গণ্য করে তা অনুসরণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে পরবেন ভুক্তভোগী। মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম কালবিলম্ব চলবে না। ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে হবে, তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
এছাড়া ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অভিযোগ দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করার নির্দেশনাও রয়েছে এ ১৮ দফায়। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের পরও রায়ের পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ, নির্দেশনাগুলো এখন পর্যন্ত প্রচারে আসেনি, বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ।
ধর্ষণ মামলার বিচার বিষয়ে হাইকোর্টের ৬ নির্দেশনা : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন হাইকোর্ট।
গত বছরের ২১ জুলাই এক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ আদেশ দেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা পৃথক তিনটি মামলায় আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেয়া হয়। অভিমতে আদালত বলেছেন, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
আদালত এটিও প্রত্যাশা করেন যে সরকার অতি অল্প সময়ে ওই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদালতের এই আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর অবিলম্বে পাঠাতে বলা হয়েছে। এ রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টের এই বেঞ্চ গত ৭ অক্টোবর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাঁধনের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশনা : ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে বাঁধন নামের এক তরুণী টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের শিকার হন। গণমাধ্যমে ওই তরুণীর ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি জনস্বার্থমূলক একটি রিট করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ২৩ মে ঢাকা সিটি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো নারী যাতে যৌন হয়রানির শিকার না হন, অসামাজিক কাজ যাতে না ঘটে; সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জ্যেষ্ঠ প্রোক্টরিয়াল কমিটির সদস্যদের নিয়ে অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টের আরও কিছু নির্দেশনা : বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করেন।
শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এই রিটের রায় দেন। এই রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেন।
হাইকোর্টের এই রায়ের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
তাই যৌন নির্যাতন বন্ধে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠনে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কমিটিতে কমপক্ষে ৫ জন সদস্য থাকবে।
এই কমিটির বেশিরভাগ সদস্য হতে হবে নারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে ২ জন সদস্য নিতে হবে। আরও বলা হয়, সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটির প্রধান করতে হবে।
হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়াকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে একের পর এক ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না।
তিনি বলেন, যাই হোক দেরিতে হলেও সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এ ঘোষণা (মৃত্যুদণ্ড করা হবে) ধর্ষক তথা অপরাধীদের ওপর একটা মানসিক চাপ তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন বাধ্যতামূলক। তাই দ্রুত এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হওয়া দরকার।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ধর্ষণ মামলার বিচার: হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষিত
দুই রিটের আদেশে ২৪ দফা নির্দেশনা * আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টের অসন্তোষ * উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
ধর্ষণ, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালত দুটি রিটের আদেশে ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। গত কয়েক বছরে এ ধরনের আরও কিছু রিটেও রুল, আদেশ ও নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু এসবের অধিকাংশই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
বছরের পর বছর এগুলো উপেক্ষিত। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এছাড়া মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে এসব মামলা বছরের পর বছর বিচারিক আদালতে ঝুলে অছে।
আদালতের নির্দেশনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ঘটনার পর কিছুদিন তোলপাড় চলে, মিছিল-মিটিং হয় তারপর সব চাপা পড়ে যায়।
সম্প্রতি নোয়াখালী ও সিলেটে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার দাবি উঠেছে।
সরকারও সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
মামলার রায়, আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ৭ অক্টোবর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশকিছু নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনা কেউ প্রতিপালন করেন না। বরং আদেশ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মাইন্ড (মন খারাপ) করেন।’
জানা গেছে, ১৬ বছরের নিচে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে সে ক্ষেত্রে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে জানুয়ারিতে রুল জারি করেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান আছে সেখান থেকে যাবজ্জীবন উঠিয়ে দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
এর আগে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে ধর্ষণের মামলা হলে সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় তা নেয়ার পাশাপাশি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোসহ ১৮ দফা নির্দেশনা আসে।
অন্য এক রায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন উচ্চ আদালত।
এদিকে এক রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। এর মধ্যে কয়েকটি মাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে। বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত অবস্থায় আছে।
এদিকে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বুধবার সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের স্মরণে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেন- আমরা জুডিশিয়ারিতে আছি, আমরা চাই দোষীদের উপযুক্ত বিচার হোক।
শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন নয় : ১৬ বছরের নিচে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে সে ক্ষেত্রে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে জানুয়ারিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রুল জারির পাশাপাশি নির্দেশনাও দেন।
আদালত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ ঠেকাতে একটি কমিশন গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ৩০ দিনের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ কমিশন গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে এ কমিটিতে আইনজীবী, বিচারক, মানবাধিকারকর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, চিকিৎসক এবং ভিকটিমকে (যদি কোনো ভিকটিম রাজি থাকেন) রাখতে বলা হয়।
একই সঙ্গে কমিশনকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে আদালতে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার যুগান্তরকে বলেন, ৬ মাসের মধ্যে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে আদালতে প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন কোর্টে আসেনি।
যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের বিচারে হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনা : যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর সুরক্ষা, নিরাপত্তা, তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত ওই ১৮টি নির্দেশনাকে ‘নীতিমালা’ হিসেবে গণ্য করে তা অনুসরণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট যে কোনো থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে পরবেন ভুক্তভোগী। মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম কালবিলম্ব চলবে না। ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে হবে, তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
এছাড়া ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অভিযোগ দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করার নির্দেশনাও রয়েছে এ ১৮ দফায়। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের পরও রায়ের পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ, নির্দেশনাগুলো এখন পর্যন্ত প্রচারে আসেনি, বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ।
ধর্ষণ মামলার বিচার বিষয়ে হাইকোর্টের ৬ নির্দেশনা : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন হাইকোর্ট।
গত বছরের ২১ জুলাই এক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ আদেশ দেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা পৃথক তিনটি মামলায় আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেয়া হয়। অভিমতে আদালত বলেছেন, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
আদালত এটিও প্রত্যাশা করেন যে সরকার অতি অল্প সময়ে ওই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদালতের এই আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর অবিলম্বে পাঠাতে বলা হয়েছে। এ রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টের এই বেঞ্চ গত ৭ অক্টোবর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাঁধনের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশনা : ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে বাঁধন নামের এক তরুণী টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের শিকার হন। গণমাধ্যমে ওই তরুণীর ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি জনস্বার্থমূলক একটি রিট করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ২৩ মে ঢাকা সিটি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো নারী যাতে যৌন হয়রানির শিকার না হন, অসামাজিক কাজ যাতে না ঘটে; সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জ্যেষ্ঠ প্রোক্টরিয়াল কমিটির সদস্যদের নিয়ে অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টের আরও কিছু নির্দেশনা : বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করেন।
শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এই রিটের রায় দেন। এই রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেন।
হাইকোর্টের এই রায়ের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
তাই যৌন নির্যাতন বন্ধে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কমিটি গঠনে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কমিটিতে কমপক্ষে ৫ জন সদস্য থাকবে।
এই কমিটির বেশিরভাগ সদস্য হতে হবে নারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে ২ জন সদস্য নিতে হবে। আরও বলা হয়, সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটির প্রধান করতে হবে।
হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়াকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে একের পর এক ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না।
তিনি বলেন, যাই হোক দেরিতে হলেও সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এ ঘোষণা (মৃত্যুদণ্ড করা হবে) ধর্ষক তথা অপরাধীদের ওপর একটা মানসিক চাপ তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন বাধ্যতামূলক। তাই দ্রুত এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন হওয়া দরকার।