সম্প্রীতির বান্দরবানে অশান্তির কালো মেঘ
খুনোখুনি, চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা * মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা-অস্ত্র
মাসুদ করিম, বান্দরবান থেকে
২৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই পাহাড়ি জেলাটিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসবাসের কারণে এখানে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির আগ থেকে পর্যটন শিল্প বিকশিত হতে থাকে। শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় এখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু সম্প্রীতির এই বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবদমান গ্রুপগুলো বান্দরবানে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে করেই হানাহানির সূচনা। সশস্ত্র ওই গ্রুপগুলো চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। মিয়ানমার থেকে এখানে আসছে ইয়াবার মতো যুব সমাজ ধ্বংসের মাদক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে।
বান্দরবানে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। এর মধ্যে মারমা সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তাদের আধিপত্য বেশি। এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশই বাঙালি। সবগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণে বান্দরবানকে বলা হতো ‘সম্প্রীতির বান্দরবান’। এখন সেই বান্দরবানে খুনোখুনির পাশাপাশি চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা না দিয়ে সড়ক নির্মাণসহ কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। গ্রুপগুলো সাধারণ নাগরিক, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মালিকানাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে।
জানা যায়, বান্দরবানে প্রতি বছর একশ’ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে গ্রুপগুলো বাধা দেয়। চাঁদার জন্য ঠিকাদাররা কাজ করতে পারেন না। এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বাঁশ, কাঠ, পাথর। এসবের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে হানাহানি হচ্ছে।
বান্দরবানের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে নীলগিরি, আলীকদম, চন্দ্রমুখী পাহাড়, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দিরের মতো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এই স্থানগুলো বিশ্বের অনেক পর্যটন স্থানের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এত সুন্দর জায়গা দার্জিলিংয়েও নেই। তারপরও এখানে ভালো পর্যটন অবকাঠামো নেই। নীলগিরিতে প্রতিদিন এক হাজার পর্যটক আসেন। কিন্তু এখানকার রিসোর্টে মাত্র ২০ জন পর্যটক রাত্রিযাপন করতে পারেন।
এমন বাস্তবতায় ২০১৫ সালে নীলগিরির পাশে চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গাজুড়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালের ১২ জুন আর্মী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে আরএনআর গ্রুপ পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল স্থাপনে চুক্তি করে। হোটেলটিতে ২০০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। সম্প্রতি হোটেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। গ্রুপগুলো যেসব অভিযোগ তুলে হোটেল নির্মাণের বিরোধিতা করছে; নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সেগুলোকে কাল্পনিক মনে করছেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় তারা পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণে বাধা দিচ্ছে।
পার্বত্য অপর দুই জেলায় চাকমা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য থাকলেও বান্দরবান প্রধানত মারমা সম্প্রদায়ের আধিপত্য। চাকমা গোষ্ঠী ওই জনপদে আধিপত্য নেয়ার লক্ষ্যে নতুন বসতি স্থাপনসহ সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস বান্দরবানের কাছে চাকমাদের ৪০টি পাড়া গড়ে বসতি স্থাপন করছে। এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মারমাদের মগ লিবারেশন পার্টি চাকমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। বান্দরবানের সঙ্গে মিয়ানমারের ১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ভারতের আছে ৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত। আর সীমান্তের ২৮ কিলোমিটার এখনও অরক্ষিত। এখানে কোনো প্রহরা নেই। ফলে অরক্ষিত এই সীমান্ত দিয়ে অবাধে বান্দরবানে অস্ত্র ও মাদক ঢুকছে। পাহাড়, জঙ্গল, খালের কারণে দুর্গম এই এলাকায় টহল দেয়া যায় না। রোহিঙ্গা সংকটের কারণেও বান্দরবান অঞ্চলটি নিরাপত্তার দিক দিয়ে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় সরকার বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে। ইতোমধ্যে এক প্ল্যাটুন র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। মোতায়েন হচ্ছে এপিবিএন। নিরাপত্তা জোরদারে আরও কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো সীমান্তজুড়ে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সীমান্তে টহল জোরদার করা সম্ভব হবে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৪০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সম্প্রীতির বান্দরবানে অশান্তির কালো মেঘ
খুনোখুনি, চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা * মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা-অস্ত্র
পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই পাহাড়ি জেলাটিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসবাসের কারণে এখানে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির আগ থেকে পর্যটন শিল্প বিকশিত হতে থাকে। শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় এখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু সম্প্রীতির এই বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবদমান গ্রুপগুলো বান্দরবানে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে করেই হানাহানির সূচনা। সশস্ত্র ওই গ্রুপগুলো চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। মিয়ানমার থেকে এখানে আসছে ইয়াবার মতো যুব সমাজ ধ্বংসের মাদক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে।
বান্দরবানে ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। এর মধ্যে মারমা সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তাদের আধিপত্য বেশি। এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশই বাঙালি। সবগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কারণে বান্দরবানকে বলা হতো ‘সম্প্রীতির বান্দরবান’। এখন সেই বান্দরবানে খুনোখুনির পাশাপাশি চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা না দিয়ে সড়ক নির্মাণসহ কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। গ্রুপগুলো সাধারণ নাগরিক, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মালিকানাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে।
জানা যায়, বান্দরবানে প্রতি বছর একশ’ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে গ্রুপগুলো বাধা দেয়। চাঁদার জন্য ঠিকাদাররা কাজ করতে পারেন না। এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বাঁশ, কাঠ, পাথর। এসবের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে হানাহানি হচ্ছে।
বান্দরবানের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে রয়েছে নীলগিরি, আলীকদম, চন্দ্রমুখী পাহাড়, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দিরের মতো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এই স্থানগুলো বিশ্বের অনেক পর্যটন স্থানের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এত সুন্দর জায়গা দার্জিলিংয়েও নেই। তারপরও এখানে ভালো পর্যটন অবকাঠামো নেই। নীলগিরিতে প্রতিদিন এক হাজার পর্যটক আসেন। কিন্তু এখানকার রিসোর্টে মাত্র ২০ জন পর্যটক রাত্রিযাপন করতে পারেন।
এমন বাস্তবতায় ২০১৫ সালে নীলগিরির পাশে চন্দ্রপাহাড়ে ২০ একর জায়গাজুড়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালের ১২ জুন আর্মী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সঙ্গে আরএনআর গ্রুপ পাঁচ তারকা ম্যারিয়ট হোটেল স্থাপনে চুক্তি করে। হোটেলটিতে ২০০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। সম্প্রতি হোটেলটির নির্মাণ কাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। গ্রুপগুলো যেসব অভিযোগ তুলে হোটেল নির্মাণের বিরোধিতা করছে; নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সেগুলোকে কাল্পনিক মনে করছেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় তারা পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণে বাধা দিচ্ছে।
পার্বত্য অপর দুই জেলায় চাকমা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য থাকলেও বান্দরবান প্রধানত মারমা সম্প্রদায়ের আধিপত্য। চাকমা গোষ্ঠী ওই জনপদে আধিপত্য নেয়ার লক্ষ্যে নতুন বসতি স্থাপনসহ সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস বান্দরবানের কাছে চাকমাদের ৪০টি পাড়া গড়ে বসতি স্থাপন করছে। এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মারমাদের মগ লিবারেশন পার্টি চাকমাদের চ্যালেঞ্জ করছে। বান্দরবানের সঙ্গে মিয়ানমারের ১৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ভারতের আছে ৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত। আর সীমান্তের ২৮ কিলোমিটার এখনও অরক্ষিত। এখানে কোনো প্রহরা নেই। ফলে অরক্ষিত এই সীমান্ত দিয়ে অবাধে বান্দরবানে অস্ত্র ও মাদক ঢুকছে। পাহাড়, জঙ্গল, খালের কারণে দুর্গম এই এলাকায় টহল দেয়া যায় না। রোহিঙ্গা সংকটের কারণেও বান্দরবান অঞ্চলটি নিরাপত্তার দিক দিয়ে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় সরকার বান্দরবানে নিরাপত্তা জোরদার করছে। ইতোমধ্যে এক প্ল্যাটুন র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। মোতায়েন হচ্ছে এপিবিএন। নিরাপত্তা জোরদারে আরও কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো সীমান্তজুড়ে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে সীমান্তে টহল জোরদার করা সম্ভব হবে।