ডিজেল মজুত ৩০ দিনের
৫ মাসে বিপিসির লোকসান ৮০১৪ কোটি টাকা: চেয়ারম্যান
সরকারের কাছ থেকে কোনো ভর্তুকি না নিয়ে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা থেকে গত ৫ মাসের জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিপিসির দাবি এই ৫ মাসে তাদের লোকসান হয়েছে ৮০১৪ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসিকে গত ৩ মাসে তেলের জন্য পেমেন্ট করতে হয়েছে প্রায় ২৭৮৩৬ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক পেমেন্টগুলো (আমদানি ব্যয়) নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিপিসি দুই মাসের আমদানি ব্যয় চলতি হিসাব খুলে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দুই মাসের আমদানি ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার পরও ৭৮৩৬ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি সমন্বয় করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত এফডিআর ভেঙে।
বুধবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রাজধানীর কাওরান বাজারে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের যে দর উল্লেখ করা হচ্ছে, তা আসলে ক্রড অয়েলের দাম। আমরা মাত্র ১৫ লাখ টন ক্রড আমদানি করি, সেখান থেকে ২০ শতাংশ ডিজেল জোগান আসে। বাকি আর ৮০ শতাংশ পরিশোধিত ডিজেল সরাসরি আমদানি করতে হয়, যার বর্তমান দর (৮ আগস্ট) ১১৮.৭৩ ডলার। এর সঙ্গে প্রিমিয়াম, ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য কমিশন যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে এখনো লোকসান হচ্ছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান জুলাই মাসে ডিজেল আমদানির উদাহরণ টেনে বলেন, জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল ক্রয় করতে হয়েছে (গড় প্লাটসের ভিত্তিতে) ১৩৯.৪৩ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলের গড় খরচ দাঁড়ায় ১২২.১৩ টাকা। (যা গত ৫ আগস্ট তারিখে মূল্য সমন্বয়ের কারণে ডিলার কমিশন, পরিবহণ ও ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে লিটারপ্রতি খরচ দাঁড়িয়েছে ১২৮.১৮ টাকা) বিপিসি প্রতিলিটার তেল ৮০ টাকায় বিক্রি করায় ওই মাসে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রতিলিটারে ৪২.১৩ টাকায়।
তিনি বলেন, বিপিসির ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। মুনাফার একটি অংশ বিপিসি এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছে। বিপিসির পেমেন্টগুলো নিরবচ্ছিন্ন রাখতে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখতে হয়। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি পর্যবেক্ষণ করছিল বিপিসি। এক পর্যায়ে তেলের মূল্য অ্যাকাউন্টের ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এফডিআর ভেঙে ভেঙে তেল কিনেছে সরকার। তেল সরবরাহে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা। প্রকল্পের টাকা এনে তেল কেনার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নগদায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা সরাতে-সরাতে ৩৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে এখন ১৯ হাজার কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এবিএম আজাদ বলেন, বর্তমানে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতিলিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির, এ ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৬ টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। এখন প্রতিলিটার অকটেনে ২৫ টাকার মতো বিপিসির লাভ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলছেন, বিপিসির টাকা দিয়ে কয়েক মাস চললে তেলের দাম বাড়াতে হতো না। এটা ঠিক নয়। আমরা এফডিআরের টাকা দিয়েই তেল আমদানি করেছি।’
বিপিসির এক্সটার্নাল অডিট অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে করিয়ে থাকে বলেও জানান তিনি। এ সময় তিনি জানান, বর্তমানে দেশে ৩০ দিনের ডিজেল মজুত রয়েছে। এছাড়া ১৮ থেকে ১৯ দিনের অকটেন, ১৮ দিনের পেট্রোল এবং ৩২ দিনের জেট ফুয়েল রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ক্রুডের কারণে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ে। সুতরাং পেট্রোল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে।
সরকার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ আমদানি কমাতে বলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিপিসির লোকসান নিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসির লোকসান হয়েছে ৫৩০০৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে জ্বালানি খাতে ভর্তুকির বিপরীতে সরকার বিপিসিকে দিয়েছে ৪৪৮৭৭ কোটি টাকা। ভর্তুকি দেওয়ার পরও ওই সময়ে বিপিসির লোকসান ছিল ৮১২৭ কোটি টাকা। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার পর সরকার দেশে জ্বলানি তেলের দাম না কমিয়ে সেই লোকসান সমন্বয় করে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিব্যারেল তেল আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৯৬.৯৫ ডলার। টাকার অঙ্কে এটিকে প্রতিলিটারে কনভার্ট করলে দাম পড়ে লিটারপ্রতি ৮৩.৬ টাকা। ওই সময় বিপিসি দেশীয় বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি করেছিল ৮০ টাকা। তাতে বিপিসিকে লোকসান দিতে হয়েছে প্রতি লিটারে ৩ টাকা ৬০ পয়সা। ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল ডিজেল কিনতে হয়েছে ১০৮.৫০ মার্কিন ডলারে। এই হিসাবে প্রতি লিটারে খরচ পড়ে ৮৯.৮৫ টাকা। ওই মাসে বিপিসির লোকসান হয় ৯ টাকা। জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল ক্রয় করতে হয়েছে ১৩৯.৪৩ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলের গড় খরচ দাঁড়ায় ১২২.১৩ টাকা। বিপিসি প্রতি লিটার তেল ৮০ টাকায় বিক্রি করায় ওই মাসে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রতি লিটারে ৪২.১৩ টাকায়। বিপিসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা করে বলেন, সিআইএফ কস্ট ৯০.০১ টাকা + শুল্ককরাদি ২০.৫৩ টাকা + অপারেশনাল ব্যয় : ৮.৪৫ টাকা + বিপিসির মার্জিন/বিবিধ ব্যয় ৫.৭৫ টাকা + গেজেট অনুযায়ী বিক্রয় ও বিপণন ব্যয় ৭.৪ টাকা, মোট ১২৮.১৮ টাকা । জালানি তেলের মূল্য সমন্বয়কালে ক্রুড অয়েলের (এএলসি বা অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড) সর্বশেষ পার্সেল মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ১১৭.৪৮ ডলার। ১ লিটারে মূল্য ১১৭.৪৮/১৬০=০.৭৩৪ টাকা যা ৬৯.৫৩ টাকা/লিটার। (এক ব্যারেলে প্রায় ১৬০ লিটার)।
মাসে ২০৫ কোটি টাকা লাভের আশা করছে বিপিসি : সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাসে ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা হবে।
তিনি বলেন, ডলারের দর যদি অপরিবর্তিত থাকে, আর প্রাক্কলন অনুযায়ী যদি জ্বালানি তেল বিক্রি হয় তবেই ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা হবে। পেট্রোলের মুনাফা প্রকাশ না করলেও গত ৮ দিনের গড় হিসাবে অকটেনে লিটার প্রতি ৩৫ টাকা করে মুনাফা হচ্ছে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে ডিজেলে ৬ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংকে বিপিসির জমা অর্থ নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। বর্তমানে চলতি মূলধন রয়েছে ৭ হাজার ৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এই খাত থেকে আমদানির খরচ মেটানো হয়। এই খাতে ২ মাসের সমমূল্যের আমদানির অর্থ রাখতে হয় নিরাপত্তার জন্য।
জুনে ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা এবং জুলাইয়ে আমদানির বিল পরিশোধ করতে হয়েছে ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০ হাজার কোটি টাকা থাকা উচিত, অনেক সময় এফডিআর ভেঙে পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। ফরেন কারেন্সি ও প্রকল্পের সিডি হিসাবে ২৮৬ কোটি ৭১ লাখ, শেয়ার অফলোড/রিজার্ভ ফান্ডে ১ হাজার ৩৪২ কোটি ৮৭ লাখ, উন্নয়ন তহবিলে ৩৭২ কোটি, অবচয় তহবিলে ৮৬ কোটি ২১ লাখ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে রয়েছে ১০ হাজার ৭১৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকার স্থিতি। সব মিলিয়ে ব্যাংকে জমা রয়েছে ১৯ হাজার ৮৮২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে এফডিআর নগদায়ন করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে এলে অবশ্যই দাম কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তিনি বলেন, বর্তমানে ৩০ দিনের ডিজেল মজুত রয়েছে, অন্যদিকে পেট্রোল-অকটেন রয়েছে ১৯ দিনের মতো। সরবরাহ লাইনে প্রয়োজনীয় জোগান নিশ্চিত রয়েছে সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরও বলেন, দেশে ডিজেলের মোট বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৪৮.৩৩ লাখ টন। তার মধ্যে প্রায় ৪১.০০ লাখ টন পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করা হয়। এছাড়া ক্রুড অয়েল আমদানি করা হয় প্রায় ১৪.৬৫ লাখ টন। ক্রুড অয়েল থেকে উৎপাদিত ডিজেলের পরিমাণ প্রায় ৭.০০ লাখ টন।
ক্রয়কৃত ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি ডিউটি ভ্যাট বা শুল্ককরাদি ১৫.৫৬ টাকা। বিপিসির ফ্রেইট ও সার্ভিস চার্জ ৩.৬২ টাকা। এছাড়া প্রসেসিং খরচসহ বিপিসির মার্জিন ও অন্যান্য ব্যয় লিটার প্রতি ৯.২৫ টাকা এবং গেজেট অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় ও বিতরণ খরচ লিটারপ্রতি ৭.৪৪ টাকা। অর্থাৎ ক্রুড অয়েল থেকে উৎপাদিত ডিজেলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি মোট ব্যয় প্রায় (৬৯.৫৩+১৫.৫৬+৩.৬২+৯.২৫+৭.৪৪) ১০৫.৪০ টাকা।
বিপিসি এএলসি ও মারবান এ দুটি ক্রুড অয়েল আমদানি করে থাকে। দেশে ব্যবহৃত ডিজেলের প্রায় ১৪.৫০ শতাংশ ক্রুড অয়েল থেকে পাওয়া যায়। ক্রুড অয়েল থেকে প্রাপ্ত ডিজেল ও সরাসরি রিফাইন্ড (পরিশোধিত) ডিজেলের মূল্য গড় করে সরকারের/বিপিসির ব্যয় ১২২.৫ টাকার অধিক। ভর্তুকি না দিলেও তেলের দাম ৭০ টাকার নিচে থাকবে।
৫ মাসে বিপিসির লোকসান ৮০১৪ কোটি টাকা: চেয়ারম্যান
ডিজেল মজুত ৩০ দিনের
যুগান্তর প্রতিবেদন
১১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারের কাছ থেকে কোনো ভর্তুকি না নিয়ে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা থেকে গত ৫ মাসের জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিপিসির দাবি এই ৫ মাসে তাদের লোকসান হয়েছে ৮০১৪ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসিকে গত ৩ মাসে তেলের জন্য পেমেন্ট করতে হয়েছে প্রায় ২৭৮৩৬ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক পেমেন্টগুলো (আমদানি ব্যয়) নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিপিসি দুই মাসের আমদানি ব্যয় চলতি হিসাব খুলে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দুই মাসের আমদানি ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার পরও ৭৮৩৬ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি সমন্বয় করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত এফডিআর ভেঙে।
বুধবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রাজধানীর কাওরান বাজারে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের যে দর উল্লেখ করা হচ্ছে, তা আসলে ক্রড অয়েলের দাম। আমরা মাত্র ১৫ লাখ টন ক্রড আমদানি করি, সেখান থেকে ২০ শতাংশ ডিজেল জোগান আসে। বাকি আর ৮০ শতাংশ পরিশোধিত ডিজেল সরাসরি আমদানি করতে হয়, যার বর্তমান দর (৮ আগস্ট) ১১৮.৭৩ ডলার। এর সঙ্গে প্রিমিয়াম, ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য কমিশন যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে এখনো লোকসান হচ্ছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান জুলাই মাসে ডিজেল আমদানির উদাহরণ টেনে বলেন, জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল ক্রয় করতে হয়েছে (গড় প্লাটসের ভিত্তিতে) ১৩৯.৪৩ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলের গড় খরচ দাঁড়ায় ১২২.১৩ টাকা। (যা গত ৫ আগস্ট তারিখে মূল্য সমন্বয়ের কারণে ডিলার কমিশন, পরিবহণ ও ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে লিটারপ্রতি খরচ দাঁড়িয়েছে ১২৮.১৮ টাকা) বিপিসি প্রতিলিটার তেল ৮০ টাকায় বিক্রি করায় ওই মাসে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রতিলিটারে ৪২.১৩ টাকায়।
তিনি বলেন, বিপিসির ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। মুনাফার একটি অংশ বিপিসি এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছে। বিপিসির পেমেন্টগুলো নিরবচ্ছিন্ন রাখতে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে রাখতে হয়। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি পর্যবেক্ষণ করছিল বিপিসি। এক পর্যায়ে তেলের মূল্য অ্যাকাউন্টের ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এফডিআর ভেঙে ভেঙে তেল কিনেছে সরকার। তেল সরবরাহে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা। প্রকল্পের টাকা এনে তেল কেনার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নগদায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা সরাতে-সরাতে ৩৪ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে এখন ১৯ হাজার কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এবিএম আজাদ বলেন, বর্তমানে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতিলিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির, এ ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৬ টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। এখন প্রতিলিটার অকটেনে ২৫ টাকার মতো বিপিসির লাভ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলছেন, বিপিসির টাকা দিয়ে কয়েক মাস চললে তেলের দাম বাড়াতে হতো না। এটা ঠিক নয়। আমরা এফডিআরের টাকা দিয়েই তেল আমদানি করেছি।’
বিপিসির এক্সটার্নাল অডিট অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে করিয়ে থাকে বলেও জানান তিনি। এ সময় তিনি জানান, বর্তমানে দেশে ৩০ দিনের ডিজেল মজুত রয়েছে। এছাড়া ১৮ থেকে ১৯ দিনের অকটেন, ১৮ দিনের পেট্রোল এবং ৩২ দিনের জেট ফুয়েল রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। ক্রুডের কারণে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ে। সুতরাং পেট্রোল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে।
সরকার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ আমদানি কমাতে বলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিপিসির লোকসান নিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসির লোকসান হয়েছে ৫৩০০৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে জ্বালানি খাতে ভর্তুকির বিপরীতে সরকার বিপিসিকে দিয়েছে ৪৪৮৭৭ কোটি টাকা। ভর্তুকি দেওয়ার পরও ওই সময়ে বিপিসির লোকসান ছিল ৮১২৭ কোটি টাকা। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার পর সরকার দেশে জ্বলানি তেলের দাম না কমিয়ে সেই লোকসান সমন্বয় করে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিব্যারেল তেল আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৯৬.৯৫ ডলার। টাকার অঙ্কে এটিকে প্রতিলিটারে কনভার্ট করলে দাম পড়ে লিটারপ্রতি ৮৩.৬ টাকা। ওই সময় বিপিসি দেশীয় বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি করেছিল ৮০ টাকা। তাতে বিপিসিকে লোকসান দিতে হয়েছে প্রতি লিটারে ৩ টাকা ৬০ পয়সা। ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল ডিজেল কিনতে হয়েছে ১০৮.৫০ মার্কিন ডলারে। এই হিসাবে প্রতি লিটারে খরচ পড়ে ৮৯.৮৫ টাকা। ওই মাসে বিপিসির লোকসান হয় ৯ টাকা। জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল ক্রয় করতে হয়েছে ১৩৯.৪৩ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলের গড় খরচ দাঁড়ায় ১২২.১৩ টাকা। বিপিসি প্রতি লিটার তেল ৮০ টাকায় বিক্রি করায় ওই মাসে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রতি লিটারে ৪২.১৩ টাকায়। বিপিসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা করে বলেন, সিআইএফ কস্ট ৯০.০১ টাকা + শুল্ককরাদি ২০.৫৩ টাকা + অপারেশনাল ব্যয় : ৮.৪৫ টাকা + বিপিসির মার্জিন/বিবিধ ব্যয় ৫.৭৫ টাকা + গেজেট অনুযায়ী বিক্রয় ও বিপণন ব্যয় ৭.৪ টাকা, মোট ১২৮.১৮ টাকা । জালানি তেলের মূল্য সমন্বয়কালে ক্রুড অয়েলের (এএলসি বা অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড) সর্বশেষ পার্সেল মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ১১৭.৪৮ ডলার। ১ লিটারে মূল্য ১১৭.৪৮/১৬০=০.৭৩৪ টাকা যা ৬৯.৫৩ টাকা/লিটার। (এক ব্যারেলে প্রায় ১৬০ লিটার)।
মাসে ২০৫ কোটি টাকা লাভের আশা করছে বিপিসি : সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাসে ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা হবে।
তিনি বলেন, ডলারের দর যদি অপরিবর্তিত থাকে, আর প্রাক্কলন অনুযায়ী যদি জ্বালানি তেল বিক্রি হয় তবেই ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা হবে। পেট্রোলের মুনাফা প্রকাশ না করলেও গত ৮ দিনের গড় হিসাবে অকটেনে লিটার প্রতি ৩৫ টাকা করে মুনাফা হচ্ছে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে ডিজেলে ৬ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংকে বিপিসির জমা অর্থ নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। বর্তমানে চলতি মূলধন রয়েছে ৭ হাজার ৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এই খাত থেকে আমদানির খরচ মেটানো হয়। এই খাতে ২ মাসের সমমূল্যের আমদানির অর্থ রাখতে হয় নিরাপত্তার জন্য।
জুনে ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা এবং জুলাইয়ে আমদানির বিল পরিশোধ করতে হয়েছে ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০ হাজার কোটি টাকা থাকা উচিত, অনেক সময় এফডিআর ভেঙে পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। ফরেন কারেন্সি ও প্রকল্পের সিডি হিসাবে ২৮৬ কোটি ৭১ লাখ, শেয়ার অফলোড/রিজার্ভ ফান্ডে ১ হাজার ৩৪২ কোটি ৮৭ লাখ, উন্নয়ন তহবিলে ৩৭২ কোটি, অবচয় তহবিলে ৮৬ কোটি ২১ লাখ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে রয়েছে ১০ হাজার ৭১৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকার স্থিতি। সব মিলিয়ে ব্যাংকে জমা রয়েছে ১৯ হাজার ৮৮২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে এফডিআর নগদায়ন করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে এলে অবশ্যই দাম কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তিনি বলেন, বর্তমানে ৩০ দিনের ডিজেল মজুত রয়েছে, অন্যদিকে পেট্রোল-অকটেন রয়েছে ১৯ দিনের মতো। সরবরাহ লাইনে প্রয়োজনীয় জোগান নিশ্চিত রয়েছে সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরও বলেন, দেশে ডিজেলের মোট বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৪৮.৩৩ লাখ টন। তার মধ্যে প্রায় ৪১.০০ লাখ টন পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করা হয়। এছাড়া ক্রুড অয়েল আমদানি করা হয় প্রায় ১৪.৬৫ লাখ টন। ক্রুড অয়েল থেকে উৎপাদিত ডিজেলের পরিমাণ প্রায় ৭.০০ লাখ টন।
ক্রয়কৃত ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি ডিউটি ভ্যাট বা শুল্ককরাদি ১৫.৫৬ টাকা। বিপিসির ফ্রেইট ও সার্ভিস চার্জ ৩.৬২ টাকা। এছাড়া প্রসেসিং খরচসহ বিপিসির মার্জিন ও অন্যান্য ব্যয় লিটার প্রতি ৯.২৫ টাকা এবং গেজেট অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় ও বিতরণ খরচ লিটারপ্রতি ৭.৪৪ টাকা। অর্থাৎ ক্রুড অয়েল থেকে উৎপাদিত ডিজেলের ক্ষেত্রে লিটার প্রতি মোট ব্যয় প্রায় (৬৯.৫৩+১৫.৫৬+৩.৬২+৯.২৫+৭.৪৪) ১০৫.৪০ টাকা।
বিপিসি এএলসি ও মারবান এ দুটি ক্রুড অয়েল আমদানি করে থাকে। দেশে ব্যবহৃত ডিজেলের প্রায় ১৪.৫০ শতাংশ ক্রুড অয়েল থেকে পাওয়া যায়। ক্রুড অয়েল থেকে প্রাপ্ত ডিজেল ও সরাসরি রিফাইন্ড (পরিশোধিত) ডিজেলের মূল্য গড় করে সরকারের/বিপিসির ব্যয় ১২২.৫ টাকার অধিক। ভর্তুকি না দিলেও তেলের দাম ৭০ টাকার নিচে থাকবে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023