অভিযানে যুক্ত কর্মকর্তাদের নাম চেয়েছেন হাইকোর্ট
jugantor
নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু
অভিযানে যুক্ত কর্মকর্তাদের নাম চেয়েছেন হাইকোর্ট
মামলা না হওয়ায় আদালতের অসন্তোষ, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ * তদন্ত করবে মানবাধিকার কমিশন * র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত হবে -মুখপাত্র, র‌্যাব * আটকের নেপথ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার অভিযোগ!

  যুগান্তর প্রতিবেদন ও নওগাঁ প্রতিনিধি  

২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নওগাঁ শহরে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি নওগাঁ ছাপিয়ে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ঠেকেছে। এভাবে একজন সরকারি নারী কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এলে আদালত উষ্মা প্রকাশ করেন। এমন একটি ঘটনায় কেউ একটা মামলাও কেন করল না, সেই প্রশ্নও তোলেন আদালত। ওই নারীকে গ্রেফতার অভিযানে যুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাদের নামের তালিকাও চেয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া ওই নারীর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা জানতে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আজ (মঙ্গলবার) সকালের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এ রিপোর্ট দাখিল করতে হবে।

সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন। র‌্যাবের দাবি, ওই নারী প্রতারকচক্রের সদস্য। তিনি অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার তাকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তবে সুলতানা জেসমিনের স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। আদালত এ ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, জনগণ ন্যায়বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে।

এদিকে সুলতানা জেসমিনের আটকের নেপথ্যে রাজশাহী বিভাগীয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। তার মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই র‌্যাব ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায়।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সোমবার রাতে যুগান্তরকে জানান, সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা (কমিশন) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তদন্তে কী পাওয়া গেল, আমাদের তাও জানাতে বলেছি। কমিশনের চেয়ারম্যান এ ঘটনাকে মানাবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে অভিহিত করে বলেন, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলেই থাবা দিয়ে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যেতে হবে কেন। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকলে এর বিচারের জন্য আদালত আছে। তিনি মাদক বা অস্ত্র কারবারিও ছিলেন না। চিকিৎসক কীভাবে জানলেন পড়ে গিয়ে ওই ভিকটিম মাথায় আঘাত পেয়েছেন?

অপরদিকে র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, র‌্যাব হেফাজতে নয়। স্ট্রোকজনিত কারণে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। মেডিকেল রিপোর্টে তার মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ আছে। এরপরও যেহেতু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তাই নিয়মানুযায়ী র‌্যাব সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান সেল বিষয়টির তদন্ত করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছায়া অনুসন্ধান করছে র‌্যাব। অনুসন্ধানে সুলতানা জেসমিনের ব্যাংকে সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া যায়। ফলে তাকে নজরদারির মধ্যে আনা হয়।

জানা যায়, সুলতানা জেসমিন মৃত্যুর ঘটনাটি সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। আদালতে এ বিষয়টি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, বুধবার তাকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করে হেফাজতে নেয় র‌্যাব। আটক করার ৩১ ঘণ্টা পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর হেফাজতে নেওয়ার পর অসুস্থ হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শুক্রবার (২৪ মার্চ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার মাথায় আঘাতের কথা বলা হয়েছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ওই নারীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ সত্য হলে এটি খুবই গুরুতর ঘটনা। বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত। এ সময় আদালত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদকে উদ্দেশ করে বলেন, এই মুহূর্তে খোঁজ নেন কোনো মামলা হয়েছে কি না। ১৫ মিনিটের মধ্যে খোঁজ নিয়ে তথ্য জানান।

পরে তিনি রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনারের কাছে খোঁজ নেন। এরপার সহকারী আইন কর্মকর্তা দাউদ আদালতে বলেন, ২৪ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, আদালত জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, নিহতের পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেননি। এ কারণে রাষ্ট্রও মামলা করেনি।

এ সময় আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘কে বলেছে রাষ্ট্র মামলা করতে পারে না? কোথায় পেয়েছেন? পরিবারের সদস্যরা মামলা করেনি তো কী হয়েছে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই? রাষ্ট্র কেন মামলা করল না। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র মামলা করতে পারে। অভিযোগ উঠেছে হেফাজতে এই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’

মাথায় আঘাতের বিষয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে, আদালত তা জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, এ বিষয়গুলো জানতে হলে সময় দিতে হবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি আনতে হবে।

তখন হাইকোর্ট বলেন, এখনই ফ্যাক্স করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে বলেন। পত্রপত্রিকায় এসেছে ওই নারীর মাথায় আঘাতের কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু পত্রিকার প্রতিবেদন ধরে তো আর বিচার করা যাবে না। আমাদের দেখতে হবে আগে থেকেই মাথায় ইনজুরি ছিল কি না, নাকি নতুন ইনজুরি হয়েছে এবং সেই ইনজুরির কারণে তার মৃত্যু হয়েছে কি না। কেন তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। কারা হেফাজতে নিয়েছিল, কে বা কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, নাম-পদবিসহ বিস্তারিত উল্লেখ করে আমাদের জানান।

রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, দেশের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন কি না তা দেখতে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে মিলেই তা করতে হবে। শুধু বিচার না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা ন্যায়বিচার করতে চাই।

এরপর আদালত আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিককে নিহতের পরিবারের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে আদেশের বিষয়ে আবেদন নিয়ে আসতে বলেন। এমনকি নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন নামের ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তলব করেন আদালত। আজ সকালে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা মানা হয়েছে কি না, তাও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ যুগান্তরকে বলেন, একজন আইনজীবী নারীর মৃত্যুর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন। আমাকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বললে আমি আদালতকে অবহিত করি। পরে আদালত ওই নারীর ময়নাতদন্ত, সুরতহাল রিপোর্ট দেখতে মঙ্গলবার (আজ) দিন ধার্য করেন। এছাড়া ওই নারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে কোন কোন কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের সবার নাম-পরিচয় জানাতে বলেছেন আদালত।

আটকের নেপথ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার অভিযোগ : এনমুল হক নামে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তার মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব ২২ মার্চ বুধবার সকাল ১০টায় জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নওগাঁর মুক্তির মোড় থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন এনামুল হক রাজশাহী রাজপাড়া থানায় সুলতানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিনের মৃত্যু হয়। রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) রহুল আমিন জানান, এনামুল হক যে মামলাটি করেন এর নম্বর ১৬। এ বিষয়ে জানতে এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত বলেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার। র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।’

নওগাঁ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রফিকুল ইসলাম জানান, জেসমিনকে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়ার আগে আমাদের অবগত করা হয়নি। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু

অভিযানে যুক্ত কর্মকর্তাদের নাম চেয়েছেন হাইকোর্ট

মামলা না হওয়ায় আদালতের অসন্তোষ, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ * তদন্ত করবে মানবাধিকার কমিশন * র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত হবে -মুখপাত্র, র‌্যাব * আটকের নেপথ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার অভিযোগ!
 যুগান্তর প্রতিবেদন ও নওগাঁ প্রতিনিধি 
২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নওগাঁ শহরে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি নওগাঁ ছাপিয়ে উচ্চ আদালত পর্যন্ত ঠেকেছে। এভাবে একজন সরকারি নারী কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এলে আদালত উষ্মা প্রকাশ করেন। এমন একটি ঘটনায় কেউ একটা মামলাও কেন করল না, সেই প্রশ্নও তোলেন আদালত। ওই নারীকে গ্রেফতার অভিযানে যুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাদের নামের তালিকাও চেয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া ওই নারীর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা জানতে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আজ (মঙ্গলবার) সকালের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এ রিপোর্ট দাখিল করতে হবে।

সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন। র‌্যাবের দাবি, ওই নারী প্রতারকচক্রের সদস্য। তিনি অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার তাকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তবে সুলতানা জেসমিনের স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। আদালত এ ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, জনগণ ন্যায়বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে।

এদিকে সুলতানা জেসমিনের আটকের নেপথ্যে রাজশাহী বিভাগীয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। তার মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই র‌্যাব ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায়।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সোমবার রাতে যুগান্তরকে জানান, সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা (কমিশন) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তদন্তে কী পাওয়া গেল, আমাদের তাও জানাতে বলেছি। কমিশনের চেয়ারম্যান এ ঘটনাকে মানাবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে অভিহিত করে বলেন, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলেই থাবা দিয়ে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যেতে হবে কেন। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকলে এর বিচারের জন্য আদালত আছে। তিনি মাদক বা অস্ত্র কারবারিও ছিলেন না। চিকিৎসক কীভাবে জানলেন পড়ে গিয়ে ওই ভিকটিম মাথায় আঘাত পেয়েছেন?

অপরদিকে র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, র‌্যাব হেফাজতে নয়। স্ট্রোকজনিত কারণে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। মেডিকেল রিপোর্টে তার মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ আছে। এরপরও যেহেতু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তাই নিয়মানুযায়ী র‌্যাব সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান সেল বিষয়টির তদন্ত করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছায়া অনুসন্ধান করছে র‌্যাব। অনুসন্ধানে সুলতানা জেসমিনের ব্যাংকে সন্দেহজনক লেনদেন পাওয়া যায়। ফলে তাকে নজরদারির মধ্যে আনা হয়।

জানা যায়, সুলতানা জেসমিন মৃত্যুর ঘটনাটি সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। আদালতে এ বিষয়টি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, বুধবার তাকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করে হেফাজতে নেয় র‌্যাব। আটক করার ৩১ ঘণ্টা পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর হেফাজতে নেওয়ার পর অসুস্থ হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শুক্রবার (২৪ মার্চ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার মাথায় আঘাতের কথা বলা হয়েছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ওই নারীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ সত্য হলে এটি খুবই গুরুতর ঘটনা। বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত। এ সময় আদালত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদকে উদ্দেশ করে বলেন, এই মুহূর্তে খোঁজ নেন কোনো মামলা হয়েছে কি না। ১৫ মিনিটের মধ্যে খোঁজ নিয়ে তথ্য জানান।

পরে তিনি রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনারের কাছে খোঁজ নেন। এরপার সহকারী আইন কর্মকর্তা দাউদ আদালতে বলেন, ২৪ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, আদালত জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, নিহতের পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেননি। এ কারণে রাষ্ট্রও মামলা করেনি।

এ সময় আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘কে বলেছে রাষ্ট্র মামলা করতে পারে না? কোথায় পেয়েছেন? পরিবারের সদস্যরা মামলা করেনি তো কী হয়েছে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই? রাষ্ট্র কেন মামলা করল না। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র মামলা করতে পারে। অভিযোগ উঠেছে হেফাজতে এই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’

মাথায় আঘাতের বিষয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে, আদালত তা জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, এ বিষয়গুলো জানতে হলে সময় দিতে হবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি আনতে হবে।

তখন হাইকোর্ট বলেন, এখনই ফ্যাক্স করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে বলেন। পত্রপত্রিকায় এসেছে ওই নারীর মাথায় আঘাতের কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু পত্রিকার প্রতিবেদন ধরে তো আর বিচার করা যাবে না। আমাদের দেখতে হবে আগে থেকেই মাথায় ইনজুরি ছিল কি না, নাকি নতুন ইনজুরি হয়েছে এবং সেই ইনজুরির কারণে তার মৃত্যু হয়েছে কি না। কেন তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। কারা হেফাজতে নিয়েছিল, কে বা কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, নাম-পদবিসহ বিস্তারিত উল্লেখ করে আমাদের জানান।

রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, দেশের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন কি না তা দেখতে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে মিলেই তা করতে হবে। শুধু বিচার না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা ন্যায়বিচার করতে চাই।

এরপর আদালত আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিককে নিহতের পরিবারের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে আদেশের বিষয়ে আবেদন নিয়ে আসতে বলেন। এমনকি নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন নামের ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তলব করেন আদালত। আজ সকালে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা মানা হয়েছে কি না, তাও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ যুগান্তরকে বলেন, একজন আইনজীবী নারীর মৃত্যুর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন। আমাকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বললে আমি আদালতকে অবহিত করি। পরে আদালত ওই নারীর ময়নাতদন্ত, সুরতহাল রিপোর্ট দেখতে মঙ্গলবার (আজ) দিন ধার্য করেন। এছাড়া ওই নারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে কোন কোন কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের সবার নাম-পরিচয় জানাতে বলেছেন আদালত।

আটকের নেপথ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার অভিযোগ : এনমুল হক নামে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তার মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব ২২ মার্চ বুধবার সকাল ১০টায় জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নওগাঁর মুক্তির মোড় থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন এনামুল হক রাজশাহী রাজপাড়া থানায় সুলতানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিনের মৃত্যু হয়। রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) রহুল আমিন জানান, এনামুল হক যে মামলাটি করেন এর নম্বর ১৬। এ বিষয়ে জানতে এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত বলেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার। র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।’

নওগাঁ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রফিকুল ইসলাম জানান, জেসমিনকে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়ার আগে আমাদের অবগত করা হয়নি। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন