বরিশাল সিটি নির্বাচন

ভোটের মাঠে কালোটাকা অসংখ্য অচেনা মুখ

 আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল 
১১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

বরিশালে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠেছে নৌকার কর্মীদের বিরুদ্ধে। গভীর রাতে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই টাকা।

শুক্রবার রাতে টাকা ছড়ানো হয় বলে অভিযোগ লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস ও হাতপাখার মুফতি ফয়জুল করিমের। এসব অভিযোগকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন নৌকার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট অ্যাড. আফজালুল করিম। পরাজয় নিশ্চিত জেনে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে বলে দাবি তার।

নৌকার পাশাপাশি হাতপাখার বিরুদ্ধেও উঠেছে ভোট কিনতে টাকা দেওয়ার অভিযোগ। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁইয়ে হাতপাখায় ভোট দিতে শপথ করানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও পুরো বিষয়টিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন প্রার্থী ফয়জুল করিম। ভুয়া ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে বলে দাবি তার।

এদিকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণার শেষ দিনে এসেও অগণিত অচেনা মুখ দেখা গেছে নগরে। আবাসিক হোটেলগুলোতেও মিলছে না কক্ষ।

পুলিশের পক্ষ থেকে শনিবার রাত ১২টার মধ্যে বহিরাগতদের নগর ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানার কোনো লক্ষণ নেই এসব বহিরাগতদের। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক আবাসিক হোটেলের মালিক বলেন, ‘যারা আছেন তারা প্রায় সবাই ভোটের পরদিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ পর্যন্ত থাকবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।’

শনিবার প্রচারণার শেষ দিনে নগরের বান্দ রোড এলাকায় গণসংযোগকালে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট কেনার উদ্দেশ্যে নগরের নিুআয়ের মানুষকে টাকা দেওয়ার অভিযোগ করেন লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘গভীর রাতে নগরের কেডিসি, পলাশপুর ও স্টেডিয়ামসহ নিম্নআয়ের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খামে করে টাকা দিয়েছে নৌকার লোকজন। ভোটারপ্রতি ২ হাজার করে টাকা দিয়েছে তারা। কেবল টাকা দেওয়াই নয়, যারা লাঙ্গলের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে তাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখানো হচ্ছে। ১২ জুনের পর দেখিয়ে দেওয়া হবে এমন সব হুমকি দেয় তারা।’

একই অভিযোগ করে হাতপাখার প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠের পরিবেশ নষ্ট করছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। টাকা দিয়ে ভোট কিনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা চলছে।’

শনিবার দুপুরে নগরের হাটখোলা এলাকায় গণসংযোগকালে সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করে ফয়জুল বলেন, ‘দেদার কালো টাকা ছড়িয়ে ভোটের মাঠের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। যাদেরকে দেওয়া হচ্ছে তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে নিচ্ছেন টাকা। না নিলে নৌকার বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।’

দুই প্রার্থীর এই অভিযোগ সর্ম্পকে নৌকার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আফজালুল করিম বলেন, ‘মুখে বললেই তো হবে না। প্রমাণ দিতে হবে। তাদের কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যে আমরা টাকা দিয়েছি? এসব পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। নৌকার পক্ষে সাধারণ মানুষের গণজোয়ার দেখে ভীত হয়ে এসব মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে।’

টাকা দিয়ে ভোট কেনার পাশাপাশি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁইয়ে ভোটারদের শপথ করানোর অভিযোগ উঠেছে হাতপাখার প্রার্থী ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধেও।

শুক্রবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় হাতপাখার পক্ষে ভোট চাইতে নগরের বর্ধিত এলাকার একটি বাড়িতে গেছেন ইসলামী আন্দোলনের নারী কর্মীরা। পুরো শরীর বোরকায় আবৃত। তারা কয়েকজন নারী ভোটারকে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। টাকা দেওয়ার পাশাপাশি তারা যে ভোট দেবেন তার নিশ্চয়তা হিসাবে চলে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁইয়ে শপথ করানোর চেষ্টা।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করতে অস্বীকৃতি জানান নারী ভোটাররা। তারা বলেন, ‘আপনারা ভোট চাইছেন ভালো কথা, কিন্তু কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করতে হবে কেন? কুরআন ছুঁয়ে কোনো শপথ করব না আমরা।’

এ সময় এক নারী কর্মী বলেন, ‘আমি তো আপনার মেয়ের মতো। শায়েখে চরমোনাই আল্লাহ’র অলি। তাকে ভোট দিলে আল্লাহ ও তার নবী খুশি হবেন।’

ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিও সম্পর্কে জানতে চাইলে সবকিছু অস্বীকার করেন হাতপাখার প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম। এটি ক্ষমতাসীন দলের ষড়যন্ত্র বলে পালটা অভিযোগ করেন তিনি। নির্বাচনি মাঠে নৌকা বেকায়দায় আছে উল্লেখ করে ফয়জুল বলেন, ‘এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একদিকে যেমন তারা কালো টাকা দিয়ে ভোট কিনছে, তেমনি এসব ভুয়া ভিডিও বানিয়ে অবস্থান ভালো করতে চাইছে।’

এদিকে গত কয়েক দিন ধরেই বরিশালে বাড়ছে অপরিচিত মানুষের ভিড়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে আসা এইসব মানুষ অবস্থান করছেন আবাসিক হোটেলে। অনেকে আবার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও উঠেছেন। বহিরাগত এসব মানুষকে শনিবার মধ্যরাতের আগে নগর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

ভোটের প্রচারে আসা এইসব বহিরাগতদের কারণে ডাক্তার দেখানোসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রয়োজনে আসা সাধারণ মানুষ কক্ষ পাচ্ছেন না আবাসিক হোটেলগুলোতে। ঝালকাঠির নলছিটি থেকে ডাক্তার দেখাতে আসা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘স্ত্রীকে নিয়ে নগরের প্রায় সব আবাসিক হোটেলে গেছি। কেউ সিট দিতে পারেনি। সবাই বলছে যে ১৩ তারিখের আগে কোনো সিট খালি নেই।’

গির্জা মহল্লা এলাকার এক আবাসিক হোটেল মালিক বলেন, ‘প্রায় সব হোটেলে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগাম রুম বুকিং দিয়ে রাখা হয়েছে। তার ওপর ভোটের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা লোকের চাপ। ১৩ তারিখের আগে আর রুম খালি হবে না।’

আওয়ামী লীগের পক্ষে হাজার হাজার বহিরাগত বর্তমানে নগরে অবস্থান করছে অভিযোগ করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, ‘২০১৮-র মতো এবারও তারা ভোট কেন্দ্র দখল করে ওলট-পালট কিছু একটা করার চেষ্টা করবে বলে আশংকা করছি। প্রশাসনও সরাসরি নৌকার পক্ষে কাজ করছে। না হলে এত বহিরাগত নগরে অবস্থান করে কী করে?

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার রাত ১২টার পর অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বহিরাগত কেউ বরিশালে অবস্থান করতে পারবে না। প্রতিটি আবাসিক হোটেলে তল্লাশি চলবে। চেকপোস্ট বসিয়ে যাচাই করা হবে যে কারা নগরের বাসিন্দা আর কারা নয়।’ শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে ৪ হাজার সদস্য নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে। শনিবার মধ্যরাতের পর যানবাহন চলাচলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।’

র‌্যাব-৮-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘নির্বাচনে র‌্যাবের ১৬টি টিম কাজ করবে। চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হবে সন্দেহভাজনদের।’

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

ঘটনাপ্রবাহ : বরিশাল-খুলনা সিটিতে ভোট