সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতার প্রশ্নে বিভক্ত আদেশ
কেন বাতিল করা হবে না জানতে চেয়ে রুল দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী * রিট আবেদন খারিজ করেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল * বিভক্ত রায় প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে করা রিটে বিভক্ত রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ৭০ অনুচ্ছেদ প্রশ্নে রুল দিয়েছেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। সোমবার হাইকোর্ট এ রায় দেন। আইনজীবীরা বলেছেন, এখন বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি এর জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন। সেই বেঞ্চে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
আদেশে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় হাইকোর্ট বলেছেন, পার্টিপ্রধানের বা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদ সদস্যদের ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ এ অভিমত বহাল রেখেছেন। আদেশে আদালত বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। অথচ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, এমপিরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে না। এখানে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন। এসব কারণে এটা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আদেশে বলা হয়, শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ইউকেসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়েছেন। শুনানিতে তারা বলেছেন, ওইসব দেশে আইনপ্রণেতারা স্বাধীনভাবে মতামত দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আমার (বিচারক) অভিমত হল, ওইসব দেশে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কোনো অনুচ্ছেদ নেই। ওইসব দেশের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আমাদের সংসদ সদস্যদের মৌলিক পার্থক্য আছে। আমাদের দেশে দলীয় হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আরও বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় এ আদালত (হাইকোর্ট) ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে অভিমত দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, আপিল বিভাগের দেয়া রায় আমাদের (হাইকোর্ট) জন্য মানা বাধ্যতামূলক। এ রিট আবেদনে রুল জারির মতো প্রাথমিক উপাদান রয়েছে। এ কারণে রুল জারি করা হল।
কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি এ সংক্রান্ত আদেশে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্ট যে অভিমত দিয়েছেন তা আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন ঠিক। তবে ষোড়শ সংশোধনী মামলা ছিল বিচার বিভাগ সংক্রান্ত। সেখানে বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে ৭০ অনুচ্ছেদের বিচার্য ছিল না।
আদালত বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। সে সময় যেভাবে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেভাবেই রয়েছে। এ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে অতীতে কোনো সরকার বা সংসদে প্রশ্ন ওঠেনি। জনগণও প্রশ্ন তোলেননি। ৭০ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার হয়েছে এমন নজিরও আমাদের সামনে নেই। আদেশে বলা হয় বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে, আদালত সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করেন না। শুধুই বলতে পারেন, সংসদে প্রণীত আইন সংবিধান পরিপন্থী কিনা। এ কারণেই সুপ্রিমকোর্ট পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে রায় দিয়েছেন।
আদেশে বলা হয়, রিট আবেদনকারী তার আবেদনে বলেননি যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের আর কোন কোন অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এও বলেননি যে, আইনপ্রণেতা কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনগণ সকল ক্ষমতার অধিকারী। আর সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইন প্রণয়নে আদালত বাধ্য করতে পারেন না। কার্যত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্যই আদালতের সৃষ্টি। আদালতের দায়িত্ব সেটাই। বিচার বিভাগকে তার নিজস্ব সীমা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আইনপ্রণেতারা কি উদ্দেশ্যে আইন করছেন তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারেন না। এ জন্যই রিটটি খারিজ করা হল।
আদেশের পর ড. ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ৭০ অনুচ্ছেদকে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন। বিশেষ করে তিনি কেন রুল দিয়েছেন সে বিষয়টি তিনি তার আদেশে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে যা বলেছেন তা গ্রহণ করেই আজ রুল জারি করেছেন। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন (ষোড়শ সংশোধনী) তার পরিপ্রেক্ষিতে অনুচ্ছেদ ৭০ আর থাকতে পারে না।
গত ১৭ এপ্রিল সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। রিট আবেদনে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব ও আইন সচিবকে বিবাদী করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে ইউনুছ আলী আকন্দ নিজেই শুনানি করেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন।
রিট আবেদনে বলা হয়েছে, এই ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধনের প্রস্তাবনা এবং ৭(১)/১৯(১)(৩) /২৬(১)(২)/২৭/১১৯(১) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর কারণ ব্যাখ্যা করে রিটকারীর আইনজীবী ইউনুছ আলী বলেন, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। অথচ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, এমপিরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না। এখানে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন। তারা নিজ দলের কাছে পরাধীন। তারা স্বাধীনভাবে কোনো মতামত দিতে পারেন না। সংসদে কোনো গণবিরোধী আইন পাস হলেও সেখানে তারা নিজ দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য। কিন্তু সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। দল যা বলবে এমপিরা তাই করবেন- এমন কোনো কারণে জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দেননি। জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছেন যাতে স্বাধীনভাবে তাদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন, জনস্বার্থে কাজ করেন। এখানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সব ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে রাজনৈতিক দল, জনগণ নন। এসব কারণে এটা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক দাবি করে এ আইনজীবী বলেন, গণতন্ত্র সংবিধানের মূল ভিত্তি (বেসিক স্ট্রাকচার)। গণতন্ত্র অর্থ স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বৈরাচারী ধারা এটি। এ অনুচ্ছেদ বাতিল হলে সরকারপ্রধানের ক্ষমতা কমে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাকিস্তানে তখন সকালে এক সরকার, বিকালে আরেক সরকার। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে তখন সংসদ সদস্যরা বেচাকেনা হতেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে এ অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অনুচ্ছেদের আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মনে করেন রিটকারী আইনজীবী। সংসদকে কার্যকর করতে, গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ ঘটাতে এবং জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে এ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।
