ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা ও সমাজভিত্তিক সেবা প্রয়োজন
রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসাবঞ্চিত বেশির ভাগ রোগী * বছরে মারা যায় এক লাখের বেশি * জরায়ুমুখে ক্যান্সার সচেতনতা দিবস আজ
রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা ও সমাজভিত্তিক সেবা প্রয়োজন
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় বছরে এক লাখের বেশি রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এই বিপুলসংখ্যক রোগীর তুলনায় মানসম্মত চিকিৎসার সুবিধা এখনও অপ্রতুল। মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ক্যান্সার সচেতনতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সামাজিক আন্দোলন গড়ে না ওঠায় সাধারণের ভেতর এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরি হয়নি। সবার মাঝে এ সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, আক্রান্ত হলে ‘চিকিৎসা’ দেয়াটাই ক্যান্সার সেবা নয়, ক্যান্সার থেকে সুরক্ষাও সেবা।
সম্প্রতি একদল রুশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী ক্যান্সার চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কেন্দ্রীভূত সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা, সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ অপেক্ষমাণ তালিকা, বেসরকারি হাসপাতালের লাগামহীন উচ্চব্যয়, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নির্ণয় সুবিধা যথেষ্ট গুরুত্ব না পাওয়ায় প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে ক্যান্সার সেবা। সচেতনতা ও রোগ নির্ণয় সুবিধার অভাবে দেরিতে ক্যান্সার ধরা পড়ছে, বিলম্বিত চিকিৎসায় কাক্সিক্ষত রোগমুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। আস্থার সংকটে অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চালিয়ে নিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে বেশির ভাগ রোগী।
তাদের মতে, এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি। তবে প্রচলিত ব্যবস্থায় সেটি সম্ভব নয়। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। চিকিৎসা সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্যান্সার নির্ণয় সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সমাজভিত্তিক ক্যান্সার সেবার ধারণা গ্রহণ করা যেতে পারে। একজন নাগরিক যেন তার সামাজিক পরিমণ্ডল থেকেই ক্যান্সার সংক্রান্ত সচেতনতা, এ থেকে সুরক্ষা, আক্রান্ত হলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রাথমিক সেবা পান।
জানা গেছে, গত দুই দশকে দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত জনবল যুক্ত হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার সব পদ্ধতি এখন বিরাজমান। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রে কয়েকটি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু একটিও বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে উঠেনি। একমাত্র বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।
কয়েক ধাপে তিনশ’ শয্যায় উন্নীত হলেও সারা দেশের ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা দেয়া এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। পুরনো মেডিকেল কলেজগুলোয় রেডিওথেরাপি বিভাগ এবং কয়েকটিতে রেডিয়েশন বা বিকিরণ চিকিৎসার যন্ত্র থাকলেও, যেখানে গড়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পরিপূর্ণ কেন্দ্র। ফলে সেখানে বিশেষায়িত ক্যান্সার সেবা গ্রহণে মানুষের আস্থা গড়ে উঠেনি।
জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন যুগান্তরকে বলেন, রাজধানী থেকে সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় ন্যূনতম ক্যান্সার সেবা পৌঁছে দেয়া সুদূরপরাহত। তাই প্রয়োজন সমাজভিত্তিক ক্যান্সার সেবা।
ভারতের কেরালা রাজ্যে অনেক আগেই এই ধারণায় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পেয়েছে। কমিউনিটি অর্থাৎ সমাজ পর্যায়ে ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক সেবা কার্যকর করা। পাশাপাশি ক্যান্সার সেবা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।
এক্ষেত্রে তিনি বেশকিছু সুপারিশ উল্লেখ করেন, যেমন- সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কার্যক্রমের সঙ্গে প্রতিরোধ ও ক্যান্সার শনাক্তকরণের সীমিত সুবিধা সংযুক্ত করার বৈশ্বিক নীতির বাস্তবায়ন। উপজেলা পর্যায়ে ‘প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় কেন্দ্র’ চালু করা। জেলা পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা।
পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সব শাখার সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার বিভাগ চালু করা। প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় বা আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র চালু করা।
জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট, আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র ও মেডিকেল কলেজ ক্যান্সার বিভাগ থেকে আধুনিক টেলিমেডিসিন সুবিধার মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও সমাজ পর্যায়ে ক্যান্সার সচেতনতা, ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে।
এছাড়া সামাজিক নেতা যেমন জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, স্থানীয় চিকিৎসক এবং তরুণ ও যুবসমাজের জন্য প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রয়োজন।
জরায়ুমুখে ক্যান্সার সচেতনতা দিবস আজ : আজ পালিত হচ্ছে জরায়ুমুখে ক্যান্সর সচেতনতা দিবস। জরায়ুমুখ ক্যান্সার বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যান্সার। প্রতিবছর এই ক্যান্সারে প্রায় ১২ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে এবং প্রায় ৬ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করে। এই ক্যান্সার মূলত মানবদেহের প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) কারণে সৃষ্টি হয়। এইচপিভি অনিয়ন্ত্রিত যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়ায়।
ইউনাইটেড ন্যাশন্স ফান্ড ফর পপুলেশন অ্যাক্টিভিটিসের (ইউএনএফপিএ) তথ্যমতে, প্রায় ৯০ ভাগ এইচপিভি ইনফেকশন মানবদেহের হরমোনের মাধ্যমে দূর হয়। বেড়ে যাওয়া ইনফেকশনগুলো জরায়ুমুখ ক্যান্সারে পরিণত হয়। তবে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে পরিণত হতে ইনফেকশনের পর প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। তাই এক্ষেত্রে সব নারীরই উচিত স্ক্রিনিং করা এবং টিকা গ্রহণ করা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গাইনোকোলজিকাল অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুজ্জামান বলেন, জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার কৌশলপত্র ২০১৭-২০২১ অনুসারে এ পর্যন্ত ২ মিলিয়ন মহিলাকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে।
এছাড়া আরও ২৭ মিলিয়ন মহিলাকে এই সেবার আওতায় আনা হবে। এছাড়া এ বিষয়ে টিকাদান কর্মসূচিও চলমান রয়েছে। পরীক্ষামূলক কার্যক্রম গাজীপুরে এরই মধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।