‘কান ধরানো’ সেই এসি ল্যান্ড প্রত্যাহার: মাঠ প্রশাসনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত সরকার

 যুগান্তর রিপোর্ট 
২৯ মার্চ ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

কুড়িগ্রামের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও আলোচনায় এসেছে মাঠ প্রশাসন। যশোরের মনিরামপুরে মাস্ক না পরায় দুই বৃদ্ধকে কান ধরানোয় এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) সাইয়েমা হাসানকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র।

এমনকি মাঠ প্রশাসনের এ ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত সরকার। ইতোমধ্যে সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি যশোরের ডিসি ও মনিরামপুরের ইউএনও দুই বৃদ্ধের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।

এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। আমরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছি। এছাড়া তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করার নির্দেশ মাঠ প্রশাসনকে দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রামের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে এমন একটি বিতর্কিত ঘটনায় সত্যিই আমরা বিব্রত। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনমুখী এবং দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে ফরহাদ বলেন, ‘কিন্তু কিছু কর্মকর্তার কারণে অনেক সময় আমাদের বিব্রত অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। তিনজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরিয়ে মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান ভুল করেছেন বলে মত দেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মনিরামপুর উপজেলার ইউএনও ওই বয়স্ক তিনজনের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তাদের হাতে খাদ্যসামগ্রী এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার তুলে দিয়েছেন। ডিসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি।’ ৫ এপ্রিল অফিস খোলার পর ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম শুরু করা হবে বলেও জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।

এ ঘটনাকে ‘বেআইনি ও অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ’ আখ্যা দিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কর্মকর্তারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মাধ্যমে তাদের সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, এর ব্যত্যয় হলে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের ঘটনার পর আমরা ডিসিদের একই নির্দেশনা দিয়েছিলাম। আমরা বলেছি, আপনাদের (ডিসি) অধীনে যারা কাজ করেন তারা যেন জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করেন, কারণ জনগণের জন্যই আপনারা। কেউ যেন দায়িত্বে অবহেলা এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করেন। এতে ‘ব্যাড ইমেজ’ তৈরি হচ্ছে, আমরা এর দায়ভার নেব না। দয়া করে এ ধরনের বিতর্কিত কাজ করে ক্যারিয়ার নষ্ট করবেন না, ভুল করবেন না।’

জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সাইয়েমা হাসান যেটা করেছে তা অবশ্যই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। কোনো অবস্থাতেই তা সমর্থনযোগ্য নয়। সে মাঠ প্রশাসনে হাজারও কর্মকর্তার কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি জনগণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অপমান করেছেন এবং তাদের সাফল্যকে ম্লান করেছেন। তবে এটা কোনো উদাহরণ হতে পারে না। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া উচিত হবে না।’

করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে যশোরের মনিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে শুক্রবার (২৭ মার্চ) বিকাল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন।

অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। এ সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এছাড়া পরে অপর এক ভ্যানচালককে অনুরূপভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুক্রবার রাতে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ।

মাঠ প্রশাসনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন যুগান্তরকে বলেন, ‘সব জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কেউ যেন অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ না করেন। কেউ এ ধরনের আচরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা আমরা ডিসিদের দিয়েছি। বলেছি, মনে রাখতে হবে- তারা মাস্টার নন, সেবক; তারা যেন জনগণের সেবা করেন। এই ধরনের ঘটনার (যেমন, বৃদ্ধদের কান ধরে ওঠবস) যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়। সিনিয়র সিটিজেন তো অবশ্যই, যে কোনো নাগরিকের সঙ্গে যাতে সম্মানজনক আচরণ করা হয়। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক পেজেও জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশনাটি আমরা আপলোড করে দিয়েছি।’

এ প্রসঙ্গে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ‘ছবিটি আমি দেখেছি। এটি তিনি করতে পারেন না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমাদের কাজ নয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে শনিবার বিকাল ৫টার পর একাধিকবার ফোন করলেও মনিরামপুরের সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) সাইয়েমা হাসানের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেছেন, তাদের কান ধরতে বাধ্য করেননি তিনি। তারা নিজেরাই কান ধরেছেন। তারপরও সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে ভুল হতে পারে। ঘটনাটি নিয়ে তিনি বিব্রত। ভুল হয়ে থাকলে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন