চট্টগ্রামে দেড় শতাধিক অবৈধ লেভেল ক্রসিং

 এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম 
৩১ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় হতাহতের ঘটনায় ঘুরেফিরে গেটম্যান বা গেটকিপারের কাঁধে দোষ গিয়ে পড়ে। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে ঘটনার পরপরই তাকে সাময়িক বরখাস্ত, গ্রেফতার অথবা তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তই হয় না। মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে সুরক্ষিত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, কেবল লেভেল ক্রসিং নয়, ট্রেনে কাটা পড়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এজন্য তারা মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করেন। শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশাপাশি চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ রুটগুলোয় থাকা লেভেল ক্রসিংয়ের অর্ধেকই অবৈধ। মাঠপর্যায়ে রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এ হিসাবে প্রায় ৪৮ শতাংশ লেভেল ক্রসিং অবৈধ। ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় দেড় শতাধিক ক্রসিং রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মীরসরাই উপজেলার ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। সীতাকুণ্ডের ৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৬০টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আরও ২০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব ক্রসিং একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলের ৫১১টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ২৫৭টিতে গেট ব্যারিয়ার বা লোহার বার রয়েছে। এর মধ্যে ২২৯টিতে গেটম্যান থাকলেও বাকিগুলোয় থাকে না। অবৈধ ক্রসিংগুলোয় কোনো গেটম্যান নেই। এ কারণে যানবাহন ও মানুষজন নিজ দায়িত্বে রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হয়। অসাবধানতায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

শনিবার নগরীর ঝাউতলা, কদমতলীসহ বেশ কয়েকটি লেভেল ক্রসিংয়ে সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেন আসার কয়েক মিনিট আগে সড়কের দুই পাশ আটকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ট্রেন আসার কয়েক মুহূর্ত আগেও অধিকাংশ যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে উলটো পথে রেললাইনের ওপর দিয়ে পারাপার করতে দেখা যায়। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালনকারী পতাকা উড়ান। এরপরও অনেককে লেভেল ক্রসিং হেঁটে পার হতে দেখা যায়। তবে যানবাহন ও মানুষজনকে পারাপারে বাধা দিতে গেটম্যানদের দেখা যায়নি। ঝাউতলা রেলগেটে দায়িত্বরত গেটম্যান জানান, ট্রেন আসার আগে দুই সড়কের মুখে লোহার বার ফেলা হয়। এ সময় উলটোপথে যানবাহন ও মানুষজন চলাচল শুরু করে। আমরা নিষেধ করলেও কাজ হয় না। উলটো তাদের মারধর করার চেষ্টা করা হয়। নিষেধ করতে গিয়ে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়।

সর্বশেষ শুক্রবার হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকার ‘আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টার’-এর শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে মাইক্রোবাসে শিক্ষা সফর শেষে ফেরার পথে ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে ১১ তরুণ প্রাণ হারান। গুরুতর আহত আরও ৭ জনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১০ জন হাটহাজারী উপজেলার খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দা। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে গেটম্যানের যেমন দায়িত্বে অবহেলা ছিল, তেমনই দুর্ঘটনাকবলিত মাউক্রোবাসচালকের সচেতনতার অভাব ছিল। ট্রেনের গতিবিধি ও আশপাশে না তাকিয়ে দ্রুত ক্রসিং পার হতে গিয়ে এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনায় মাইক্রোবাসচালকেরও মৃত্যু হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর নগরীর খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় বাসের ধাক্কায় ডেমু ট্রেনের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষ হয়। এতে চারজনের মৃত্যু হয়। সড়কের পাশে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ডেমু ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে রেললাইন থেকে কিছুটা দূরে ছিল বিভিন্ন গাড়ি। কিন্তু ট্রেনের রেলগেট অতিক্রম করার সময় নগরীর জিইসি মোড় থেকে আসা একটি দ্রুতগামী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিকশা ও একটি টেম্পোকে ধাক্কা দেয়। বাসের ধাক্কা খেয়ে অটোরিকশা ট্রেনের ওপর আছড়ে পড়ে। সেই সময় লেভেল ক্রসিংটিতে গেটম্যান ছিল। তবে ট্রেন যাওয়ার সময় তা খোলা ছিল। এ ঘটনায় রেলওয়ের গঠিত কমিটির তদন্তে দেখা যায়- গেটম্যান আশরাফুল আলমগীর ভূঁইয়ার দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল। সড়কের এক পাশে লোহার দণ্ডের প্রতিবন্ধকতা ফেলা হলেও অন্য পাশে তা ফেলা হয়নি। যে পাশে ফেলা হয়নি, ওই পাশ দিয়েই বাসটি দ্রুতগতিতে এসেছে। এ ঘটনায় বাসচালক ও গেটম্যান পালিয়ে যায়। পরে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের এসপি হাছান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, লেভেল ক্রসিং ছাড়াও ট্রেনে কাটা পড়ে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে। রেললাইন অতিক্রম করার সময় ডানে-বামে ও সামনে-পেছনে দেখে-শুনে পার হতে হবে। মোবাইল ফোনে কথা বলা অবস্থায় রেললাইন অতিক্রম না করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন