সিন্ডিকেটে জিম্মি সিডিবিএল
jugantor
শেয়ারের তথ্য পাচার ও জাল সনদ : চাকরিচ্যুত ৬
সিন্ডিকেটে জিম্মি সিডিবিএল

  মনির হোসেন  

১৪ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে সার্ভার থেকে তথ্য পাচার ও জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির অভিযোগ। অনুমতি ছাড়া সার্ভারে ঢোকার কারণে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির এক মহাব্যবস্থাপকসহ দুই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জাল সনদের কারণে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন চার কর্মকর্তা। তদন্ত চলছে আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে।

এর আগেও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছিল। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু চক্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি অসাধুদের বিরুদ্ধেও। এসব কারণে বাজারের উন্নয়ন এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডে যারা আছেন, তাদের কারও কারও রেকর্ড ভালো নয়। ফলে বিএসইসিকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যারা পরিচালক হবেন, তাদের কী কী যোগ্যতা থাকা উচিত এবং কী কারণে তারা অযোগ্য হবেন-নীতিমালায় তারও পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

সিডিবিএলের এক পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চাইলেও পরিবর্তন করা যায় না। তবে সম্প্রতি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। সিডিবিএল শেয়ারবাজারে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা দেওয়া হবে। বিএসইসি কাউকে ছাড় দেবে না।

সূতমতে, দেশের শেয়ারবাজারের আধুনিকায়নে সিডিবিএলের জন্ম। দুই স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিদিন যত শেয়ার লেনদেন হয়, প্রতিষ্ঠানটি তা সংরক্ষণ করে রাখে। এ ছাড়াও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের যে কোনো তথ্য সিডিবিএলে সংরক্ষিত। এ থেকে তথ্য পাচার শেয়ারবাজারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও প্রতিষ্ঠানটি থেকে তথ্য পাচারের অভিযোগ আনা হয়। তবে বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে তথ্য সংরক্ষণে বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে ২০১৭ সালে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিএসইসি। নাম সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল)। এ প্রতিষ্ঠানটির ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। সিডিবিএলেরও এখানে শেয়ার রয়েছে।

সূত্র বলছে, ডাটা সার্ভারে বেআইনি প্রবেশের কারণে গত বছরের অক্টোবরে সিডিবিএলের মহাব্যবস্থাপক কেএম সাবেরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ সময়ে চাকরি হারান প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তা সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক। জাল সনদের কারণে সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চারজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। ফলে এখনো বিষয়টি বোর্ডকে জানানো হয়নি। তদন্ত চলছে আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ তালিকায় মহাব্যবস্থাপক মো. মইনুল হকও রয়েছেন।

সূত্র মতে, সন্দেহভাজনদের পুলিশের সহায়তায় অস্থায়ী ও স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে সনদও পরীক্ষা করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের পরে যারা পাশ করেছেন, তাদের সনদ অনলাইনেই পাওয়া যাচ্ছে। আর এর আগের যারা রয়েছেন, তাদের সনদ যাচাইয়ের জন্য শিক্ষা বোর্ডে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখনো চূড়ান্তভাবে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। অভিযুক্তদের ছুটিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও অল্প সময়ে পদোন্নতি পাওয়া একজন মহাব্যবস্থাপক অত্যন্ত বেপরোয়া। নীতিনির্ধারকদের কাছের এই কর্মকর্তার দাপটে অন্য কর্মকর্তারাও আতঙ্কে থাকেন।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৪ সালে অর্থ হাতিয়ে নেন তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. ফারুক আহমেদ। শেয়ার দেওয়ার কথা বলে জাফর কিবরিয়া সুজন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা নেন তিনি। এর এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা ওই সময়ে সিস্টেম অপারেশন বিভাগে কর্মরত কেএম সাবিরুল ইসলামের ঢাকা ব্যাংক কাওরান বাজার শাখার হিসাবে জমা হয়। বিষয়টি নিয়ে থানায় মামলা হলে পুলিশের তদন্তে সত্যতা মেলে। মামলার চার্জশিট এবং আসামির শাস্তি দেওয়া হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোম্পানিতে ছিলেন ফারুক আহমেদ। আর সাবেরুল ইসলাম চাকরিতে ছিলেন গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত। বারবার সার্ভারে প্রবেশের পর গত বছরের নভেম্বরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই ঘটনায় চাকরিচ্যুত হন সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, আমি নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, সিডিবিএলের চেয়ে ভালো অফার পেয়েছি। কোথায় যোগদান করেছেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন এখনো যোগদান করিনি। তবে ভালো চাকরি খুঁজছি। ডাটা পাচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ পুরোনো। এগুলো আমাদের সময় হয়নি। আর আমি রেজিস্ট্রেশন শাখায় ছিলাম। ফলে সার্ভারে প্রবেশের সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সাবেরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাড়া দেননি। পরে প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টি তাকে জানানো হয়।

জানতে চাইলে সিডিবিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভ্রকান্তি চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, কিছু লোক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখালে সেখানে কিছু বলার থাকে না। আর কয়েকজনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

সূত্রমতে, শেয়ারবাজারে সিডিবিএলকে অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব হিসেবে ৬০০ কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নিলে একজন সদস্যকে ৩০ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ১৩ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ হাবিবুস সামাদ। ২০১৮ সালে সেখান থেকে অবসরের পর সিসিবিএলের পরিচালক হন। ওই সময়ে সিডিবিএলের এমডির দায়িত্ব পান শুভ্রকান্তি চৌধুরী। আগামী বছরের শুরুতে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে তিনিও দীর্ঘদিন থেকে এ প্রতিষ্ঠানে জড়িত। মাঝে এক বছর বাদ দিয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও কোম্পানি সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন শুভ্র কান্তি। শেয়ারবাজারে আলোচিত কথা, সিডিবিএলে প্রবেশ করা কঠিন। বের হওয়া আরও কঠিন।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে ১৩ জন সদস্য রয়েছেন। চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন। কিন্তু তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ থাকায় ভাইস চেয়ারম্যান, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রতিনিধি নুরুল ফজল বুলবুল সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সাল থেকে সিডিবিএলের পর্ষদে রয়েছেন তিনি। ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন ২০১৬ সাল থেকে। একইভাবে নতুন কোম্পানি সিসিবিএলেরও পর্ষদে রয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির পক্ষে সিডিবিএলে রয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি সৈয়দ মঞ্জুর ইলাহী, প্রাইম ব্যাংকের পক্ষে আজম জে চৌধুরী, স্কয়ার ফার্মার প্রতিনিধি তপন চৌধুরী, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে মো. আফজাল করিম, এবি ব্যাংকের প্রতিনিধি তারিক আফজাল, সাধারণ বিমার পক্ষে ওয়াসিফুল হক, সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির পক্ষের মো. আবুল হোসেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মো. ইউনূসুর রহমান এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম রয়েছেন পর্ষদে।

১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৯৯ সালের ডিপোজিটরি অ্যাক্টের আওতায় সিডিবিএল গঠিত হয়। তবে কার্যক্রম শুরু করে ২০০০ সাল থেকে। এরপর বাজার থেকে কাগজের শেয়ার বিলুপ্তি শুরু হয়। বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংখ্যা ৫৬ জন। সিডিবিএল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত এখানে ৭৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৬০টি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। বর্তমানে বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৩টি। তবে শেয়ার আছে এমন বিও অ্যাকাউন্ট ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫টি। বিও অ্যাকাউন্টগুলোতে মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ হাজার ২২০ কোটি। এসব শেয়ারের বাজারমূল্য তিন লাখ ৯১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা।

শেয়ারের তথ্য পাচার ও জাল সনদ : চাকরিচ্যুত ৬

সিন্ডিকেটে জিম্মি সিডিবিএল

 মনির হোসেন 
১৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে শেয়ারবাজারের সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে সার্ভার থেকে তথ্য পাচার ও জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরির অভিযোগ। অনুমতি ছাড়া সার্ভারে ঢোকার কারণে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির এক মহাব্যবস্থাপকসহ দুই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জাল সনদের কারণে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন চার কর্মকর্তা। তদন্ত চলছে আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে।

এর আগেও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছিল। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু চক্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি অসাধুদের বিরুদ্ধেও। এসব কারণে বাজারের উন্নয়ন এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডে যারা আছেন, তাদের কারও কারও রেকর্ড ভালো নয়। ফলে বিএসইসিকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যারা পরিচালক হবেন, তাদের কী কী যোগ্যতা থাকা উচিত এবং কী কারণে তারা অযোগ্য হবেন-নীতিমালায় তারও পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

সিডিবিএলের এক পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চাইলেও পরিবর্তন করা যায় না। তবে সম্প্রতি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। সিডিবিএল শেয়ারবাজারে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা দেওয়া হবে। বিএসইসি কাউকে ছাড় দেবে না।

সূতমতে, দেশের শেয়ারবাজারের আধুনিকায়নে সিডিবিএলের জন্ম। দুই স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিদিন যত শেয়ার লেনদেন হয়, প্রতিষ্ঠানটি তা সংরক্ষণ করে রাখে। এ ছাড়াও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের যে কোনো তথ্য সিডিবিএলে সংরক্ষিত। এ থেকে তথ্য পাচার শেয়ারবাজারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও প্রতিষ্ঠানটি থেকে তথ্য পাচারের অভিযোগ আনা হয়। তবে বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে তথ্য সংরক্ষণে বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে ২০১৭ সালে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিএসইসি। নাম সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল)। এ প্রতিষ্ঠানটির ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। সিডিবিএলেরও এখানে শেয়ার রয়েছে।

সূত্র বলছে, ডাটা সার্ভারে বেআইনি প্রবেশের কারণে গত বছরের অক্টোবরে সিডিবিএলের মহাব্যবস্থাপক কেএম সাবেরুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ সময়ে চাকরি হারান প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তা সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক। জাল সনদের কারণে সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চারজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। ফলে এখনো বিষয়টি বোর্ডকে জানানো হয়নি। তদন্ত চলছে আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ তালিকায় মহাব্যবস্থাপক মো. মইনুল হকও রয়েছেন।

সূত্র মতে, সন্দেহভাজনদের পুলিশের সহায়তায় অস্থায়ী ও স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে সনদও পরীক্ষা করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের পরে যারা পাশ করেছেন, তাদের সনদ অনলাইনেই পাওয়া যাচ্ছে। আর এর আগের যারা রয়েছেন, তাদের সনদ যাচাইয়ের জন্য শিক্ষা বোর্ডে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখনো চূড়ান্তভাবে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। অভিযুক্তদের ছুটিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও অল্প সময়ে পদোন্নতি পাওয়া একজন মহাব্যবস্থাপক অত্যন্ত বেপরোয়া। নীতিনির্ধারকদের কাছের এই কর্মকর্তার দাপটে অন্য কর্মকর্তারাও আতঙ্কে থাকেন।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৪ সালে অর্থ হাতিয়ে নেন তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মো. ফারুক আহমেদ। শেয়ার দেওয়ার কথা বলে জাফর কিবরিয়া সুজন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাঁচ কোটি ১১ লাখ টাকা নেন তিনি। এর এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা ওই সময়ে সিস্টেম অপারেশন বিভাগে কর্মরত কেএম সাবিরুল ইসলামের ঢাকা ব্যাংক কাওরান বাজার শাখার হিসাবে জমা হয়। বিষয়টি নিয়ে থানায় মামলা হলে পুলিশের তদন্তে সত্যতা মেলে। মামলার চার্জশিট এবং আসামির শাস্তি দেওয়া হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোম্পানিতে ছিলেন ফারুক আহমেদ। আর সাবেরুল ইসলাম চাকরিতে ছিলেন গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত। বারবার সার্ভারে প্রবেশের পর গত বছরের নভেম্বরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই ঘটনায় চাকরিচ্যুত হন সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, আমি নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, সিডিবিএলের চেয়ে ভালো অফার পেয়েছি। কোথায় যোগদান করেছেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন এখনো যোগদান করিনি। তবে ভালো চাকরি খুঁজছি। ডাটা পাচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ পুরোনো। এগুলো আমাদের সময় হয়নি। আর আমি রেজিস্ট্রেশন শাখায় ছিলাম। ফলে সার্ভারে প্রবেশের সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সাবেরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাড়া দেননি। পরে প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টি তাকে জানানো হয়।

জানতে চাইলে সিডিবিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভ্রকান্তি চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, কিছু লোক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখালে সেখানে কিছু বলার থাকে না। আর কয়েকজনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

সূত্রমতে, শেয়ারবাজারে সিডিবিএলকে অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব হিসেবে ৬০০ কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নিলে একজন সদস্যকে ৩০ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ১৩ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ হাবিবুস সামাদ। ২০১৮ সালে সেখান থেকে অবসরের পর সিসিবিএলের পরিচালক হন। ওই সময়ে সিডিবিএলের এমডির দায়িত্ব পান শুভ্রকান্তি চৌধুরী। আগামী বছরের শুরুতে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে তিনিও দীর্ঘদিন থেকে এ প্রতিষ্ঠানে জড়িত। মাঝে এক বছর বাদ দিয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও কোম্পানি সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন শুভ্র কান্তি। শেয়ারবাজারে আলোচিত কথা, সিডিবিএলে প্রবেশ করা কঠিন। বের হওয়া আরও কঠিন।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে ১৩ জন সদস্য রয়েছেন। চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন। কিন্তু তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ থাকায় ভাইস চেয়ারম্যান, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রতিনিধি নুরুল ফজল বুলবুল সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সাল থেকে সিডিবিএলের পর্ষদে রয়েছেন তিনি। ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন ২০১৬ সাল থেকে। একইভাবে নতুন কোম্পানি সিসিবিএলেরও পর্ষদে রয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির পক্ষে সিডিবিএলে রয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি সৈয়দ মঞ্জুর ইলাহী, প্রাইম ব্যাংকের পক্ষে আজম জে চৌধুরী, স্কয়ার ফার্মার প্রতিনিধি তপন চৌধুরী, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে মো. আফজাল করিম, এবি ব্যাংকের প্রতিনিধি তারিক আফজাল, সাধারণ বিমার পক্ষে ওয়াসিফুল হক, সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির পক্ষের মো. আবুল হোসেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মো. ইউনূসুর রহমান এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম রয়েছেন পর্ষদে।

১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৯৯ সালের ডিপোজিটরি অ্যাক্টের আওতায় সিডিবিএল গঠিত হয়। তবে কার্যক্রম শুরু করে ২০০০ সাল থেকে। এরপর বাজার থেকে কাগজের শেয়ার বিলুপ্তি শুরু হয়। বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংখ্যা ৫৬ জন। সিডিবিএল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত এখানে ৭৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৬০টি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। বর্তমানে বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৩টি। তবে শেয়ার আছে এমন বিও অ্যাকাউন্ট ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫টি। বিও অ্যাকাউন্টগুলোতে মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ হাজার ২২০ কোটি। এসব শেয়ারের বাজারমূল্য তিন লাখ ৯১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন