কনডেম সেলে থাকার সময় ভাবিনি বাঁচব
২০ বছর কারাভোগ শেষে মুক্ত জাহিদ
‘কে হত্যা করল আমার স্ত্রী-সন্তানকে, সেই রহস্য জানতে পারলাম না’ * রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইলে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন -ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
আলমগীর হোসেন
২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
স্ত্রী ও কন্যাসন্তানকে হত্যার অভিযোগে শ্বশুরের করা মামলায় ২০ বছর সাজা খেটে মুক্ত হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুলনার শেখ জাহিদ । সর্বোচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় প্রায় আড়াই বছর আগে তিনি খালাস হন। তিনি বললেন, ‘কনডেম সেলে থাকা অবস্থায় কোনোদিন ভাবিনি বাঁচব। সব সময় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতাম। তবে এই মুহূর্তে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, কে হত্যা করল আমার স্ত্রী ও সন্তানকে।’ সম্প্রতি খুলনা থেকে মোবাইল ফোনে যুগান্তরের কাছে এসব কথা তুলে ধরেন জাহিদ।
তিনি আরও জানান, জীবনের হারিয়ে যাওয়া ২০ বছরের ক্ষতিপূরণের মামলা করবেন, সেই অর্থও নেই তার কাছে। দুবেলা ভাতের বিনিময়ে খুলনা শহরে এক ভাঙারির দোকানে কাজ করেন, মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভাইয়ের বাড়িতে।
জাহিদ বলেন, কনডেম সেলে থাকা অবস্থায় কোনোদিন ভাবিনি বাঁচব। যে সেলে থাকতাম, সেখান থেকে দেখা যেত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য। ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য কনডেম সেল থেকে অনেক আসামিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। তখন ভাবতাম, আমাকেও হয়তো এভাবেই ফাঁসি দেওয়া হবে। এসব ভেবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতাম।
ক্ষতিপূরণের মামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিশিষ্ট ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পীর কাছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শেখ জাহিদ মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন। তার জীবন থেকে ২০টি বছর হারিয়ে গেছে। এখন যদি তিনি রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চান, তাহলে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি লিগ্যাল এইডের সহযোগিতা নিতে পারেন।
খুলনা জেলার রূপসা থানার নারিকেল চানপুর গ্রামের শেখ ইলিয়াস আহমেদের ছেলে শেখ জাহিদ (৫২)। ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার রহিমার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, তখন থেকেই শ্বশুরবাড়ির পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তার একটি মেয়েও হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি যশোরে গিয়ে রাতে আর ফিরতে পারেননি। ওই রাতেই তার স্ত্রী ও কন্যা খুন হন। পরদিন তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন শ্বশুর। ২০০০ সালের শুরুর দিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন জাহিদ। ওই বছরই বাগেরহাটের আদালত তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হলে ২০০৪ সালে সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। কারাগার থেকেই ২০০৪ সালে আপিল বিভাগে জেল পিটিশন করেন জাহিদ, যা ২০০৭ সালে জেল আপিল হিসাবে গণ্য হয়। ২০২০ সালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগে ওই জেল আপিলের শুনানি হয়। শুনানিতে আদালত মামলায় নানা অসংগতি পান। শুনানি শেষে ওই বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ জাহিদকে খালাস দেন।
রায়ে বলা হয়, স্ত্রী ও কন্যা হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার কারণে খালাস দেওয়া হলো শেখ জাহিদকে। ৩১ আগস্ট রাতেই খুলনা কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
শেখ জাহিদ বলেন, কনডেম সেলে কাটানো ২০টি বছরের দুর্বিষহ জীবনের কথা ভুলতে পারছি না। নির্দোষ হয়েও জীবদ্দশায়ই পেয়েছি নরকের স্বাদ। কনডেম সেলে থাকাকালীন যে খাবার দেওয়া হতো তাতে পোকা ভেসে উঠত। ডাল দেওয়ার কিছুক্ষণ পর সাদা সাদা পোকা ভেসে উঠত এর মধ্যে। সেই সময় কয়েদিদের জন্য দেওয়া টুপি দিয়ে ডাল ছেঁকে ভাত খেয়েছি। মাঝেমধ্যে সেলে দম আটকে যেত। সেই সময় দরজার কাছে মুখ বাড়িয়ে নিশ্বাস নিতাম।
শেখ জাহিদ বলেন, কারাগারে থাকাবস্থায় বাবা-মাকে হারিয়েছি, দাফন করতে পারিনি। ভিটেবাড়ি, জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে মামলার পেছনে খরচ করতে হয়েছে। কারাগারে থাকাকালীন কেউ খোঁজ নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাইরের জগতের আলো দেখার আশাও বাদ দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, মামলাটি আপিল বিভাগে থাকাবস্থায় ঢাকার লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন। অবশেষে আপিলে খালাস পাই। এখন সরকার যদি কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে তা নিয়েই বেঁচে থাকব। কারাগার থেকে বের হয়ে খুলনা শহরের হরিণটানা এক ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় আছি। বর্তমানে এক ভাঙারির দোকানে দুবেলা ভাতের বিনিময়ে কাজ করছি। শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ শেখ জাহিদ জীবনের হারিয়ে যাওয়া ২০টি বছরের ক্ষতিপূরণের মামলা করতে চান। কিন্ত রায়ের কপিসহ আনুষঙ্গিক নথি সংগ্রহ করতে কমপক্ষে তার ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। সেই টাকাও নেই তার কাছে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
২০ বছর কারাভোগ শেষে মুক্ত জাহিদ
কনডেম সেলে থাকার সময় ভাবিনি বাঁচব
‘কে হত্যা করল আমার স্ত্রী-সন্তানকে, সেই রহস্য জানতে পারলাম না’ * রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইলে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন -ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
স্ত্রী ও কন্যাসন্তানকে হত্যার অভিযোগে শ্বশুরের করা মামলায় ২০ বছর সাজা খেটে মুক্ত হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুলনার শেখ জাহিদ । সর্বোচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় প্রায় আড়াই বছর আগে তিনি খালাস হন। তিনি বললেন, ‘কনডেম সেলে থাকা অবস্থায় কোনোদিন ভাবিনি বাঁচব। সব সময় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতাম। তবে এই মুহূর্তে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, কে হত্যা করল আমার স্ত্রী ও সন্তানকে।’ সম্প্রতি খুলনা থেকে মোবাইল ফোনে যুগান্তরের কাছে এসব কথা তুলে ধরেন জাহিদ।
তিনি আরও জানান, জীবনের হারিয়ে যাওয়া ২০ বছরের ক্ষতিপূরণের মামলা করবেন, সেই অর্থও নেই তার কাছে। দুবেলা ভাতের বিনিময়ে খুলনা শহরে এক ভাঙারির দোকানে কাজ করেন, মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভাইয়ের বাড়িতে।
জাহিদ বলেন, কনডেম সেলে থাকা অবস্থায় কোনোদিন ভাবিনি বাঁচব। যে সেলে থাকতাম, সেখান থেকে দেখা যেত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য। ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য কনডেম সেল থেকে অনেক আসামিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। তখন ভাবতাম, আমাকেও হয়তো এভাবেই ফাঁসি দেওয়া হবে। এসব ভেবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতাম।
ক্ষতিপূরণের মামলার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিশিষ্ট ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পীর কাছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শেখ জাহিদ মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন। তার জীবন থেকে ২০টি বছর হারিয়ে গেছে। এখন যদি তিনি রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চান, তাহলে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি লিগ্যাল এইডের সহযোগিতা নিতে পারেন।
খুলনা জেলার রূপসা থানার নারিকেল চানপুর গ্রামের শেখ ইলিয়াস আহমেদের ছেলে শেখ জাহিদ (৫২)। ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার রহিমার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, তখন থেকেই শ্বশুরবাড়ির পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তার একটি মেয়েও হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি যশোরে গিয়ে রাতে আর ফিরতে পারেননি। ওই রাতেই তার স্ত্রী ও কন্যা খুন হন। পরদিন তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন শ্বশুর। ২০০০ সালের শুরুর দিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন জাহিদ। ওই বছরই বাগেরহাটের আদালত তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হলে ২০০৪ সালে সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। কারাগার থেকেই ২০০৪ সালে আপিল বিভাগে জেল পিটিশন করেন জাহিদ, যা ২০০৭ সালে জেল আপিল হিসাবে গণ্য হয়। ২০২০ সালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগে ওই জেল আপিলের শুনানি হয়। শুনানিতে আদালত মামলায় নানা অসংগতি পান। শুনানি শেষে ওই বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ জাহিদকে খালাস দেন।
রায়ে বলা হয়, স্ত্রী ও কন্যা হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার কারণে খালাস দেওয়া হলো শেখ জাহিদকে। ৩১ আগস্ট রাতেই খুলনা কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
শেখ জাহিদ বলেন, কনডেম সেলে কাটানো ২০টি বছরের দুর্বিষহ জীবনের কথা ভুলতে পারছি না। নির্দোষ হয়েও জীবদ্দশায়ই পেয়েছি নরকের স্বাদ। কনডেম সেলে থাকাকালীন যে খাবার দেওয়া হতো তাতে পোকা ভেসে উঠত। ডাল দেওয়ার কিছুক্ষণ পর সাদা সাদা পোকা ভেসে উঠত এর মধ্যে। সেই সময় কয়েদিদের জন্য দেওয়া টুপি দিয়ে ডাল ছেঁকে ভাত খেয়েছি। মাঝেমধ্যে সেলে দম আটকে যেত। সেই সময় দরজার কাছে মুখ বাড়িয়ে নিশ্বাস নিতাম।
শেখ জাহিদ বলেন, কারাগারে থাকাবস্থায় বাবা-মাকে হারিয়েছি, দাফন করতে পারিনি। ভিটেবাড়ি, জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে মামলার পেছনে খরচ করতে হয়েছে। কারাগারে থাকাকালীন কেউ খোঁজ নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাইরের জগতের আলো দেখার আশাও বাদ দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, মামলাটি আপিল বিভাগে থাকাবস্থায় ঢাকার লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন। অবশেষে আপিলে খালাস পাই। এখন সরকার যদি কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে তা নিয়েই বেঁচে থাকব। কারাগার থেকে বের হয়ে খুলনা শহরের হরিণটানা এক ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় আছি। বর্তমানে এক ভাঙারির দোকানে দুবেলা ভাতের বিনিময়ে কাজ করছি। শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ শেখ জাহিদ জীবনের হারিয়ে যাওয়া ২০টি বছরের ক্ষতিপূরণের মামলা করতে চান। কিন্ত রায়ের কপিসহ আনুষঙ্গিক নথি সংগ্রহ করতে কমপক্ষে তার ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। সেই টাকাও নেই তার কাছে।