বিএফআইইউকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার চিঠি
মার্কিন নাগরিকের আড়াই কোটি টাকা লোপাট
হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে আনার পর ৯৬ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন
সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতারণার মাধ্যমে এক মার্কিন নাগরিকের প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা (২ লাখ ২২ হাজার ডলার) হাতিয়ে নিয়েছে ২ বাংলাদেশি প্রতারক। সেই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে আনার পর ৯৬টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করা হয়েছে।
এসব ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও সরেজমিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউকে মার্কিন নাগরিকের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে ২ লাখ ২২ হাজার ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ জানায়।
প্রতারণায় জড়িত ২ জন বাংলাদেশি নাগরিক এবং তারা নিজেদের আমেরিকার ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির এজেন্ট পরিচয় দিয়ে মার্কিন নাগরিক ডেবোরাহ জন্সটন রামলো ডেবির কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর অন্য এক বাংলাদেশির ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউকে লেনদেনকৃত ৫টি দেশি এবং ২টি বিদেশি ব্যাংক হিসাবের তথ্য দেয়।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে নেমে বিএফআইইউ কর্মকর্তারা রীতিমতো বিস্মিত হয়ে পড়েন। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রতারকচক্র হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থ এনে রেকর্ড মুছে ফেলতে তা ৯৬টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করা হয়।
বিএফআইইইউ-এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া ৫টি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে ৩৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা জমা এবং ৩৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা উত্তোলনের তথ্য পাওয়া যায়।
হিসাবগুলোর সর্বশেষ স্থিতি ছিল ৩০ লাখ টাকা। এই ৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যেসব ব্যক্তির নামে খোলা হয়েছিল, একই নামে আরও ৯১টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পান আর্থিক খাত নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দারা। এসব হিসাবে ২৯১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা জমা হয় এবং উত্তোলন করা হয় ২৯১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সব ব্যাংক হিসাবের অধিকাংশ লেনদেন ওয়াশ-আউট প্রকৃতির এবং বড় অঙ্কের পূর্ণ সংখ্যায় সম্পাদিত। অর্থাৎ অর্থ জমা হওয়ার দিন অথবা পরবর্তী কর্মদিবসের জমাকৃত অর্থ উত্তোলন করা হয় এবং ব্যাংক হিসাবে ন্যূনতম স্থিতি রাখা হয়।
ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে যেসব নাম-ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, তার সবই অস্তিত্বহীন। ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ নামে ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে একটি ব্যাংকে মিরপুরের ঠিকানা এবং অন্য ব্যাংকে পুরান ঢাকা বাসীচরণ পোদ্দার লেনের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। দুই ঠিকানাতেই এ নামে প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া জামান এন্টারপ্রাইজ নামের অপর আরেকটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক হিসাবে নিজেদের আমদানিকারক উল্লেখ করলেও প্রতিষ্ঠানটির আমদানি নিবন্ধন পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খুলে অর্থ লেনদেন করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, অর্থ লেনদেনের গতিপথ যাতে শনাক্ত করা না যায়, সেজন্য প্রতারণায় জড়িতরা মানি এক্সচেঞ্জ, ট্রেডিং ব্যবসার প্রতিনিধি, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সরবরাহকারী, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস অপারেটর, মোবাইল এক্সেসরিজ, ফার্নিচার, কৃষি, হোটেল, স্টিল, সুপারশপসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছে, যা ব্যাংক হিসাবধারীদের ব্যবসার প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বড় ধরনের হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যেসব ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে প্রতারণা অর্থ লেনদেন করা হয়েছে, তাদের অন্যতম একজন পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনীন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তার মালিকানাধীন ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, আই নক্স ফ্যাশন ও মা গোল্ড হাউজ নামে একাধিক ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়।
এর মধ্যে ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ, আই নক্স ফ্যাশনের ব্যাংক হিসাবে যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ভিন্ন ভিন্ন (কাপড় ব্যবসা, সরবরাহকারী ও জুয়েলারি) প্রকৃতির দেখানো হয়েছে।
এছাড়া মা গোল্ড হাউজ নামে তাঁতীবাজারে স্বর্ণের দোকান থাকলেও দীর্ঘদিন সেটি বন্ধ রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের লেনদেন হলেও মনীন্দ্রনাথ ৩ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ৫ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন।
সরেজমিন জানা গেছে, তাঁতীবাজারের ১৯/এ হোল্ডিংয়ের শামীমা মার্কেটের ৪ নম্বর দোকানটি মা গোল্ড হাউজ। আড়াই মাস ধরে দোকানটি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কেটের দারোয়ান বিল্লাল ও আশপাশের দোকানদাররা। ওই দোকানের মালিক মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ওরফে মনুদা নিজেই।
আশপাশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন ছোটখাটো স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসাবে সবাই তাকে চেনে। মনোরঞ্জন নামে একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, ওই দোকানটি মনুদা পজিশন কিনে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করে আসছেন। বড় কোনো ব্যবসায়ী নন তিনি। হঠাৎ দোকানটি দুই-তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। দোকানের কারিগরকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে।
মাঝেমধ্যে তিনি নিজে এসে দুই-এক ঘণ্টার জন্য দোকান খুলে আবার বন্ধ করে দেন। ওই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ ও আই নক্স ফ্যাশন আমার পরিচিত। তবে এ বিষয়ে আপনারা সিআইডি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বেশি ভালো হয়। আমি আমার লিখিত বক্তব্য তাদের কাছে জমা দিয়েছি। এ রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন পুরান ঢাকা প্রতিনিধি কাওসার মাহমুদ।