একুশ অভিযাত্রীর সুখপাঠ্য গল্প
এককাল থেকে আরেককাল হলো ‘কালান্তর’; আবিষ্কার বা বিজয়ের জন্য যারা যাত্রা করেন, তারা হলেন ‘অভিযাত্রী’। ইমরান মাহফুজ তার ‘কালান্তরের অভিযাত্রী’ গ্রন্থে এপার-ওপার উভয় বাংলার ২১ জন এমন অভিযাত্রীর জীবন ও কর্মের অতি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন। সময়ের বিবেচনায় তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিত্ব হলেন সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) এবং শেষ ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান (১৯১০-১৯৭৫)। মাঝে কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কারক ও রাজনীতিবিদ আরও ১৯ জন আছেন। সময়ের ব্যবধান প্রায় ২০০ বছর। তারা আপন যুগের অভিযাত্রী ছিলেন, কারণ লেখকের ভাষায় তারা ‘সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন’। তিনি নিজস্ব চিন্তার আলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এরূপ ২১ জন বঙ্গ-সন্তানকে বেছে নিয়েছেন। এর বাইরেও অনেক খ্যাতিমান জ্ঞানী-গুণী-মনীষী রয়েছেন, যারা সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিবর্তন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানা অবদান রেখেছেন। কিন্তু আমরা এরূপ বিতর্কে যেতে চাই না।
লেখক গ্রন্থে সূচিবদ্ধ ব্যক্তিবর্গকে ‘সাহিত্য সংস্কৃতি মনন’, ‘সমাজ সংস্কার’ এবং ‘রাজনীতি ও মানুষের মুক্তি’-এ তিন ক্যাটাগরি বা শ্র্রেণিতে ভাগ করেছেন। ১ম শ্র্রেণিতে আছেন ৮ জন- মধুসূদন দত্ত, মীর মশারফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন ও আবদুল কাদির। ২য় শ্র্রেণিতে আছেন ৭ জন-রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী, মুনশী মেহেরুল্লাহ, আকরাম খাঁ, ইসমাইল হোসেন শিরাজী ও নাসিরউদ্দীন। ৩য় শ্র্রেণিতে আছেন ৬ জন-শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমান।
সম্প্রদায়ভেদে ৫ জন ছাড়া সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার বাংলার দুই অঞ্চলভেদে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ও আকরাম খাঁ ছাড়া সবাই পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের অধিবাসী। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় ঐতিহাসিক কারণে পিছিয়ে পড়ে। সংগত কারণেই এ সম্প্রদায়ের প্রতি লেখকের সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে, আর তাদের উন্নতি ও মুক্তির জন্য যারা জীবনপাত করেছেন, তাদের সম্পর্কে আলোচনা প্রাধান্য লাভ করেছে। বাংলাদেশ যথার্থ অর্থেই মুক্ত ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদালাভ করেছে। এরূপ ঐতিহাসিক বিজয় তো এক-দুদিনের ফসল নয়, বিগত ২০০ বছর ধরে নবজাগরণের অভিযাত্রীর কীর্তিকলাপ তিলতিল করে তার পটভূমি নির্মাণ করেছে।
কীর্তিমান এ ২১ পুরুষ বাঙালির ভাবজগৎ, চিন্তা ও মননের পরিবর্তনের, সমাজের মুক্তির ও উন্নয়নের জন্য কী করেছেন? ‘পাঠসূত্র’ অংশে লেখক বলেন, ‘সূচিবদ্ধ প্রাণের একুশজন-বাংলা ও বাঙালির ভাগ্যের উন্নয়নে কঠিন সময়ে নীতিনিষ্ঠায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রচলিত ধারণায় না মিশে অপবাদ নিয়ে হলেও মতামত দিয়েছেন। গতানুগতিক সাহিত্য সমাজ রাজনীতির সংজ্ঞা আমূল পালটে দিয়েছেন। ... আপসহীন এ মানুষগুলো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। চলতে পারেননি গতানুগতিক সমাজে, ভালো করে খেতেও পাননি। পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান পাননি। ... তবু অনিবার্য সত্য নিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন ব্যথিত জনগোষ্ঠীকে; বোধের তালা ভেঙে বিচিত্র ঘটনায় ও কালচারে দাঁড়ানোর পাটাতন গড়ে দিয়েছেন।’ গ্রন্থভুক্ত ছোট ছোট অথচ সারবান নিবন্ধে এ সবের এবং আরও অন্য বিষয়ের প্রতিফলন রয়েছে। এক কথায়, তারা সবাই ছিলেন আধুনিক বাংলার রূপকার। পলাশী যুদ্ধের (১৭৫৭) শেষ ও মুসলিম শাসনের (১২০৪-১৭৫৭) অবসানে জড় ও স্থবির মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি এবং নব্যযুগ বা আধুনিক যুগের সূচনা হয়, পাশ্চাত্যের প্রভাবজাত ব্যক্তিত্ববাদ, মানবতাবাদ, হিতবাদ, যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতাপ্রীতি ইত্যাদির বিকাশ ও অনুশীলনের ফল।
১৭৭২ সালে রামমোহনের জন্ম হয়, ইংরেজ প্রশাসক উডনির অধীনে চাকরি করে তিনি অর্থ উপার্জন করে ধনী হন। তিনি মহাজনি কারবার করতেন; অনুজ সহদরকেও সুদে ঋণ দিতে কার্পণ্য করেননি। ১৮১৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে সংস্কৃতিচর্চায় ও সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও ইউরোপীয় বিদ্যা তার মনের দুয়ার খুলে দেয়। সদ্য বিধবা রূপসী ভ্রাতৃবধূর সতীত্ববরণের ঘটনা তার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। শতসহস বছরের পুরোনো সতীদাহ প্রথা জগদ্দল পাথরের মতো হিন্দুসমাজের ঘাড়ে চেপে ছিল। অতিশয় অমানবিক এ প্রথাবন্ধের উদ্যোগ আকবর বাদশাহ নিয়েছিলেন, কিন্তু হিন্দুদের বিদ্রোহের আশঙ্কায় তা পরিত্যাগ করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রামমোহন রায় প্রথম এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি সফলও হন। রামমোহন পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না; তিনি ইসলামের ‘তৌহিদবাদে’র আলোকে একেশ্বরবাদ ‘ব্রাহ্মধর্মে’র প্রবর্তন করেন এবং তা টিকেও যায়।
রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও বিধবা নারীর কান্না শুনেছিলেন, যারা স্বামীর মৃত্যুতে আজীবন বৈধব্য পালন করত। কৌলীন্য প্রথার স্বীকার অজস হিন্দু রমণীর অন্তরের হাহাকার ধ্বনিও তিনি শুনেছিলেন, দেখেছিলেন বাল্যবিয়ের করুণ পরিণতি। বিদ্যাসাগর একযোগে বিধবাবিবাহ প্রচলন, কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আন্দোলন করেন। নানা সমালোচনায় সূচিবিদ্ধ হয়েও তিনি অবশেষে আইন পাশ করে বিধবাবিবাহ চালু করতে সক্ষম হন। সমকালের বঙ্কিমচন্দ্রের মতো রেনেসাঁ পুরুষও তার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করতে ছাড়েননি। ‘বিদ্যাসাগর যদি পণ্ডিত হন, তবে মূর্খ কে!’ এটি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের জনৈক নারী চরিত্রের উক্তি। ঈশ্বর গুপ্তও কটূক্তি করতে ছাড়েননি; তিনি বিদ্যাসাগরকে আপন বিধবা মায়ের বিয়ে দেওয়ার কথা বলে কটাক্ষ করেন। বিদ্যাসাগর আপন পুত্রের বিয়ে একজন বাল্যবিধবার সঙ্গে দিয়েছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্র নিজ বিধবা বালিকা কন্যার বিবাহ দেননি। ঈশ্বরচন্দ্র সমালোচনার বৃশ্চিক দংশন সহ্য করতে না পেরে শেষ জীবনে কর্মাটারে আদিবাসীদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের জগতে তার মৌলিক অবদান ছিল আধুনিক গদ্যের সৃষ্টি, যার জন্য তাকে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা হয়।
বিগত ২০০ বছরে বাংলার জাগরণ হয়েছে সত্য, কিন্তু তার পরিণতি সুখকর হয়নি। হিন্দুর জাগরণ হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য, মুসলমানের জাগরণ মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ছিল; আমরা একত্রে মিলে স্বদেশ ও স্বজাতির জাগরণ ও উন্নয়ন চাইনি, যার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও বিভেদ বেড়েছে। বিভেদ বেড়েছে আগেই, যখন দেখেছে-‘বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান, মহাজন হিন্দু খাতক মুসলমান, উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু রোগী মুসলমান, হাকিম হিন্দু আসামি মুসলমান, খেলোয়াড় হিন্দু দর্শক মুসলমান, জেলার হিন্দু কয়েদি মুসলমান।’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)। এরূপ এবং আরও অন্য অনেক কারণে বাংলার বিভাজন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। আমরা মাতৃভূমিকে অখণ্ড রাখতে পারিনি; শতসহস্র বছরের বাংলাকে দুভাগ করে ফেলেছি। আলোচ্য গ্রন্থে ছোট বড় ২১টি ক্যানভাসে মুখ্যত এ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। অনেক লেখা স্কেচধর্মী হলেও সুখপাঠ্য হয়েছে। কালান্তরের অভিযাত্রী ইমরান মাহফুজ। প্রকাশক ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ আনোয়ার সোহেল। মূল্য ৩৯০ টাকা। হ
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
একুশ অভিযাত্রীর সুখপাঠ্য গল্প
এককাল থেকে আরেককাল হলো ‘কালান্তর’; আবিষ্কার বা বিজয়ের জন্য যারা যাত্রা করেন, তারা হলেন ‘অভিযাত্রী’। ইমরান মাহফুজ তার ‘কালান্তরের অভিযাত্রী’ গ্রন্থে এপার-ওপার উভয় বাংলার ২১ জন এমন অভিযাত্রীর জীবন ও কর্মের অতি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন। সময়ের বিবেচনায় তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিত্ব হলেন সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) এবং শেষ ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান (১৯১০-১৯৭৫)। মাঝে কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কারক ও রাজনীতিবিদ আরও ১৯ জন আছেন। সময়ের ব্যবধান প্রায় ২০০ বছর। তারা আপন যুগের অভিযাত্রী ছিলেন, কারণ লেখকের ভাষায় তারা ‘সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন’। তিনি নিজস্ব চিন্তার আলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এরূপ ২১ জন বঙ্গ-সন্তানকে বেছে নিয়েছেন। এর বাইরেও অনেক খ্যাতিমান জ্ঞানী-গুণী-মনীষী রয়েছেন, যারা সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিবর্তন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানা অবদান রেখেছেন। কিন্তু আমরা এরূপ বিতর্কে যেতে চাই না।
লেখক গ্রন্থে সূচিবদ্ধ ব্যক্তিবর্গকে ‘সাহিত্য সংস্কৃতি মনন’, ‘সমাজ সংস্কার’ এবং ‘রাজনীতি ও মানুষের মুক্তি’-এ তিন ক্যাটাগরি বা শ্র্রেণিতে ভাগ করেছেন। ১ম শ্র্রেণিতে আছেন ৮ জন- মধুসূদন দত্ত, মীর মশারফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন ও আবদুল কাদির। ২য় শ্র্রেণিতে আছেন ৭ জন-রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী, মুনশী মেহেরুল্লাহ, আকরাম খাঁ, ইসমাইল হোসেন শিরাজী ও নাসিরউদ্দীন। ৩য় শ্র্রেণিতে আছেন ৬ জন-শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমান।
সম্প্রদায়ভেদে ৫ জন ছাড়া সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার বাংলার দুই অঞ্চলভেদে রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ও আকরাম খাঁ ছাড়া সবাই পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের অধিবাসী। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় ঐতিহাসিক কারণে পিছিয়ে পড়ে। সংগত কারণেই এ সম্প্রদায়ের প্রতি লেখকের সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে, আর তাদের উন্নতি ও মুক্তির জন্য যারা জীবনপাত করেছেন, তাদের সম্পর্কে আলোচনা প্রাধান্য লাভ করেছে। বাংলাদেশ যথার্থ অর্থেই মুক্ত ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদালাভ করেছে। এরূপ ঐতিহাসিক বিজয় তো এক-দুদিনের ফসল নয়, বিগত ২০০ বছর ধরে নবজাগরণের অভিযাত্রীর কীর্তিকলাপ তিলতিল করে তার পটভূমি নির্মাণ করেছে।
কীর্তিমান এ ২১ পুরুষ বাঙালির ভাবজগৎ, চিন্তা ও মননের পরিবর্তনের, সমাজের মুক্তির ও উন্নয়নের জন্য কী করেছেন? ‘পাঠসূত্র’ অংশে লেখক বলেন, ‘সূচিবদ্ধ প্রাণের একুশজন-বাংলা ও বাঙালির ভাগ্যের উন্নয়নে কঠিন সময়ে নীতিনিষ্ঠায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রচলিত ধারণায় না মিশে অপবাদ নিয়ে হলেও মতামত দিয়েছেন। গতানুগতিক সাহিত্য সমাজ রাজনীতির সংজ্ঞা আমূল পালটে দিয়েছেন। ... আপসহীন এ মানুষগুলো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। চলতে পারেননি গতানুগতিক সমাজে, ভালো করে খেতেও পাননি। পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান পাননি। ... তবু অনিবার্য সত্য নিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন ব্যথিত জনগোষ্ঠীকে; বোধের তালা ভেঙে বিচিত্র ঘটনায় ও কালচারে দাঁড়ানোর পাটাতন গড়ে দিয়েছেন।’ গ্রন্থভুক্ত ছোট ছোট অথচ সারবান নিবন্ধে এ সবের এবং আরও অন্য বিষয়ের প্রতিফলন রয়েছে। এক কথায়, তারা সবাই ছিলেন আধুনিক বাংলার রূপকার। পলাশী যুদ্ধের (১৭৫৭) শেষ ও মুসলিম শাসনের (১২০৪-১৭৫৭) অবসানে জড় ও স্থবির মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি এবং নব্যযুগ বা আধুনিক যুগের সূচনা হয়, পাশ্চাত্যের প্রভাবজাত ব্যক্তিত্ববাদ, মানবতাবাদ, হিতবাদ, যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতাপ্রীতি ইত্যাদির বিকাশ ও অনুশীলনের ফল।
১৭৭২ সালে রামমোহনের জন্ম হয়, ইংরেজ প্রশাসক উডনির অধীনে চাকরি করে তিনি অর্থ উপার্জন করে ধনী হন। তিনি মহাজনি কারবার করতেন; অনুজ সহদরকেও সুদে ঋণ দিতে কার্পণ্য করেননি। ১৮১৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে সংস্কৃতিচর্চায় ও সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ও ইউরোপীয় বিদ্যা তার মনের দুয়ার খুলে দেয়। সদ্য বিধবা রূপসী ভ্রাতৃবধূর সতীত্ববরণের ঘটনা তার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। শতসহস বছরের পুরোনো সতীদাহ প্রথা জগদ্দল পাথরের মতো হিন্দুসমাজের ঘাড়ে চেপে ছিল। অতিশয় অমানবিক এ প্রথাবন্ধের উদ্যোগ আকবর বাদশাহ নিয়েছিলেন, কিন্তু হিন্দুদের বিদ্রোহের আশঙ্কায় তা পরিত্যাগ করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রামমোহন রায় প্রথম এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি সফলও হন। রামমোহন পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না; তিনি ইসলামের ‘তৌহিদবাদে’র আলোকে একেশ্বরবাদ ‘ব্রাহ্মধর্মে’র প্রবর্তন করেন এবং তা টিকেও যায়।
রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও বিধবা নারীর কান্না শুনেছিলেন, যারা স্বামীর মৃত্যুতে আজীবন বৈধব্য পালন করত। কৌলীন্য প্রথার স্বীকার অজস হিন্দু রমণীর অন্তরের হাহাকার ধ্বনিও তিনি শুনেছিলেন, দেখেছিলেন বাল্যবিয়ের করুণ পরিণতি। বিদ্যাসাগর একযোগে বিধবাবিবাহ প্রচলন, কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আন্দোলন করেন। নানা সমালোচনায় সূচিবিদ্ধ হয়েও তিনি অবশেষে আইন পাশ করে বিধবাবিবাহ চালু করতে সক্ষম হন। সমকালের বঙ্কিমচন্দ্রের মতো রেনেসাঁ পুরুষও তার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করতে ছাড়েননি। ‘বিদ্যাসাগর যদি পণ্ডিত হন, তবে মূর্খ কে!’ এটি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের জনৈক নারী চরিত্রের উক্তি। ঈশ্বর গুপ্তও কটূক্তি করতে ছাড়েননি; তিনি বিদ্যাসাগরকে আপন বিধবা মায়ের বিয়ে দেওয়ার কথা বলে কটাক্ষ করেন। বিদ্যাসাগর আপন পুত্রের বিয়ে একজন বাল্যবিধবার সঙ্গে দিয়েছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্র নিজ বিধবা বালিকা কন্যার বিবাহ দেননি। ঈশ্বরচন্দ্র সমালোচনার বৃশ্চিক দংশন সহ্য করতে না পেরে শেষ জীবনে কর্মাটারে আদিবাসীদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের জগতে তার মৌলিক অবদান ছিল আধুনিক গদ্যের সৃষ্টি, যার জন্য তাকে ‘বাংলা গদ্যের জনক’ বলা হয়।
বিগত ২০০ বছরে বাংলার জাগরণ হয়েছে সত্য, কিন্তু তার পরিণতি সুখকর হয়নি। হিন্দুর জাগরণ হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য, মুসলমানের জাগরণ মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ছিল; আমরা একত্রে মিলে স্বদেশ ও স্বজাতির জাগরণ ও উন্নয়ন চাইনি, যার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও বিভেদ বেড়েছে। বিভেদ বেড়েছে আগেই, যখন দেখেছে-‘বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান, মহাজন হিন্দু খাতক মুসলমান, উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু রোগী মুসলমান, হাকিম হিন্দু আসামি মুসলমান, খেলোয়াড় হিন্দু দর্শক মুসলমান, জেলার হিন্দু কয়েদি মুসলমান।’ (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)। এরূপ এবং আরও অন্য অনেক কারণে বাংলার বিভাজন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। আমরা মাতৃভূমিকে অখণ্ড রাখতে পারিনি; শতসহস্র বছরের বাংলাকে দুভাগ করে ফেলেছি। আলোচ্য গ্রন্থে ছোট বড় ২১টি ক্যানভাসে মুখ্যত এ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। অনেক লেখা স্কেচধর্মী হলেও সুখপাঠ্য হয়েছে। কালান্তরের অভিযাত্রী ইমরান মাহফুজ। প্রকাশক ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ আনোয়ার সোহেল। মূল্য ৩৯০ টাকা। হ