উর্দু কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম
যে সংগ্রাম মুক্তিকামী গণমানুষের পক্ষে হয় তা সারা দুনিয়ার কবি লেখকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কবিরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন এবং সহজই মানুষের দুঃখ কষ্ট অন্যায় অবিচার উপলব্ধি করতে পারেন। কবিরা দুনিয়ার যে ভৌগলিক স্থানেই থাকেন না কেন, তারা মানুষের মুক্তিকামী সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি পোষণ করেন। এটা যুগে যুগে হয়ে আসছে। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসকের মতো এমন জঘন্যতম নিপীড়নের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর মেলে না। এমন অবস্থায় কোনো বিবেকবান ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে কথা না বলে থাকতে পারে না। লেখক আর কবিরা তো আরও সংবেদনশীল এবং তাদের চরিত্রের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ বপন করা থাকে। উর্দু কবিরাও এর ব্যতিক্রম নন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে তাদের কলম নীরব থাকেনি। উপমহাদেশের উর্দু কবিরা বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসকারী উর্দু কবিরাও অনেক কবিতা লিখেছেন যাদের মধ্যে রয়েছেন কবি নওশাদ নূরী, আহমেদ ইলিয়াস, আতাউর রহমান জামিল, আহসান আহমাদ আশক প্রমুখেরা। এ প্রবন্ধে উপমহাদেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ উর্দু কবির কবিতার অনুবাদ এবং তাদের ওপর আলোকপাতের চেষ্টা এই লেখা। কবি নওশাদ নূরী বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষা আর ন্যায্য দাবির বিরাট সমর্থক ছিলেন। তিনি তার কবিতা আর সাংবাদিকতার দ্বারা বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং একটি কালজয়ী কবিতা ‘মহেঞ্জোদরো’ রচনা করেছিলেন যেটি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, সিন্ধি এবং জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যতগুলো গণ-আন্দোলন হয়েছিল তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তার একটি কবিতা যেটি পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির প্রেক্ষাপটে লেখা তা নিচে উদ্ধৃত করা হলো।
ছাব্বিশে মার্চ
নিষ্পাপ মজলুমের আলু-থালু চুলের মতো
ভর সন্ধ্যায় অন্ধকার শূন্যে ঝুলে আছে।
কামানের কালো ধোঁয়া জ্যোৎস্নার অমল প্রবাহ
সন্ন্যাসীর ছাইমাখা শরীরের মতো।
আজানের রেশ ভেঙে-ভেঙে পড়ছে
মসজিদে কে ঢুকেছে পিশাচ হালাকু খানের মতো?
দিগন্ত থেকে সূর্য নামল নিঃশব্দে ফসলের মাঠে
নিষ্পাপ অশ্রুর মতো।
বাঘের ভয়ে হরিণ যেমন ক’রে পালিয়ে বেড়ায়
তেমনি আল্লাহর সৃষ্টি দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফিরছে।
চারদিকে রক্তের ফোয়ারা
ঠোঁটগুলো বন্ধ আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা
কাগমারীতে, সন্তোষে, টুঙ্গিপাড়ায়-সবখানে
আহত পরিবেশে কানে-কানে নিচু স্বরে আলাপ।
আমার দৃষ্টি গলি-ঘুপচি, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল,
পাহাড়ে, জঙ্গলে সর্বত্র বুটের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মসজিদের মিনারে কামানের চিহ্ন দেখলাম
দোহাজারি থেকে ঝালকাঠি সবখানেই,
আঙিনার লাউ-মাচানে দেখলাম মদের বোতল পড়ে আছে,
আর ঘরের ভেতর বাহাদুর সেপাইদের বেলেল্লাপনা।
বাঁশের বেড়ার ওপর বেয়োনেটের দাগ দেখলাম
শীতল পাটির ওপর দেখলাম রক্তের আলপনা।
এখন, এই ঢাকাতে, করাচীর কল্পনা দুঃখজনক,
কাগান থেকে রাঙামাটির দূরত্ব আজ অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়াই একমাত্র পথ,
আর কোনো ওষুধ নেই;
ঘৃণার প্রচণ্ড আবেগ ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই,
জনগণের প্রচণ্ড বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
(অনুবাদ-কবি আসাদ চৌধুরী)
কবিতাতে কবি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো পথ নেই, জনগণের প্রচণ্ড বিদ্রোহ একমাত্র পথ এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, আর এখানে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ১৯৭১ সালে একজন উর্দু কবি এ ধরনের কবিতা রচনা করে কী ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
হাবিব জালিব পাকিস্তানের একজন বিপ্লবী কবি ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে লাহোরের মাল রোডে একটি জনসভায় বলেছিলেন, ‘এই সময় চুপ থাকা, প্রতিবাদ না করা একটি অসৎ কাজ আর কারারুদ্ধ না হওয়া অসম্মানের কাজ’। সেই জনসভায় তিনি তার খুব বিখ্যাত একটি কবিতা আবৃত্তি করে ছিলেন-
বন্দুকের গুলি দিয়ে প্রেম বপন করছো
দেশের মুখ রক্ত দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছো
তুমি মনে করছো সব রাস্তা করছো রুদ্ধ
আমি জানি তুমি তোমার গন্তব্য হারাচ্ছো।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
হাবিব জালিব আর একটি কবিতা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রচনা করেছিলেন। এ কবিতার পটভূমি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডব। তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তার বিপ্লবী চিন্তা ভাবনার জন্য। আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, জিয়াউল হক, কারও আমলে তিনি খুব বেশি দিন কারামুক্ত থাকতে পারেননি। তিনি ২৪ মার্চ ১৯২৪ সালে হোশিয়ারপুর, ভারতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩ মার্চ ১৯৯৩ সালে লাহোর, পাকিস্তানে মৃত্যুবরণ করেন।
বাগিয়া লাহু লাহান (বাগিচা রক্তে লাল)
সবুজের জন্য মন কাঁদে বাগিচা তো রক্তে লাল
প্রেমের গীত কেমন করে গাই শহর তো হলো সুনসান
বাগিচা তো রক্তে লাল
সূর্যের কিরণ করে দংশন, চাঁদের আলো ম্লান
পদে পদে মৃত্যুর ছায়া, জীবন তো মৃত্যুর সমান
পবনের হাতেও দেখি আমি মৃত্যুর তীর-কামান
বাগিচা তো রক্তে লাল
গুলিতে ঝাঁঝরা কলির বুক, রক্তে হয়েছে একাকার
জানি না আর কত দিন ঝরবে অশ্রুর বর্ষা
আর শেষ হবে কবে দুঃখ ভরা দিন-রাত
রক্তের হোলি খেলছে দেখো ধরণির বলবান
বাগিচা তো রক্তে লাল।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
ভারতের প্রখ্যাত প্রগতিশীল উর্দু কবি ক্যাফী আজমী এই জুলুম নিপীড়নের ওপর একটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছিলেন যেটা একটি মাইলফলক ছিল। ক্যাফী আজমী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ব্রিটিশ ভারত ছাড় সংগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি শ্রমিক নেতা ছিলেন, ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট গীতিকার ছিলেন। তিনি ২০০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শাবানা আজমীর বাবা আর বিখ্যাত উর্দু কবি জাভেদ আখতারের শ্বশুর। কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ
আমি কোন দেশ নই যে আমাকে পুড়িয়ে দেবে
আমি কোন দেয়াল নই যে আমাকে গুঁড়িয়ে দেবে
কোন সিমান্ত নই যে আমাকে মুছে দেবে।
এই যে পৃথিবীর অধুনালুপ্ত মানচিত্র
তোমার টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখেছো,
এখানে উচ্ছৃঙ্খল রেখা ছাড়া আর তো কিছুই নেই
তাহলে তুমি কী করে খুঁজে পাবে আমাকে?
আমি স্বাধীনচিত্ত মানুষের আশা
আমি তো অমৃত স্বপ্ন মানবতার
যখন লুটপাট সব সীমানা ছাড়িয়ে যায়
যখন অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করে
তখন আমি হঠাৎ মনের কোণে জেগে উঠি
তখন আমি হৃদয়ের মাঝে ভেসে উঠি।
তুমি আমাকে আগেও দেখেছো
কখনো পূর্বে, কখনো পশ্চিমে
কখনো শহরে, কখনো গাঁয়ে
কখনো লোকালয়ে, কখনো অরণ্যে
আমার অতীত আছে, ইতিহাস আছে
কিন্তু আমার কোন ভূগোল নেই,
আর আমার ইতিহাসের পাঠ নিষিদ্ধ
লোকজন পাঠ করে গোপনে,
আমি কখনো বিজয়ী কখনো পরাজিত
কখনো আমার হত্যাকারীকে উঠিয়েছি ফাঁসির মঞ্চে
আর কখনো নিজে হয়েছি ক্রুশবিদ্ধ।
শুধু একটি পার্থক্য,-
আমার হত্যাকারীরা মরে যায়
আর আমার কোন মৃত্যু নেই।
তোমরা যে কতো মূর্খ!
ভিক্ষায় পেয়েছো যে ট্যাংকগুলো
তা দিয়ে আমাদের করো পিষ্ট
দিন রাত করো নাপাম বোমার বৃষ্টি,
শুনে রাখো, একদিন হয়ে যাবে ক্লান্ত
আমার কোন হাতে পরাবে হাতকড়া বলো
আমার তো আছে সাত কোটি হাত,
বলো, আমার কোন ঘাড় থেকে করবে মাথা বিছিন্ন
আমার তো সাত কোটি ঘাড়ে আছে সাত কোটি মাথা।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রগতিশীল কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এপ্রিল ১৯৭১ সালে একটি কবিতা লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ। ফয়েজ উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি, তাকে আল্লামা ইকবালের পরে প্রভাবশালী উর্দু ভাষার কবি বলা হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, শ্রমিক নেতা ছিলেন, পাকিস্তান টাইমস’এর সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। কারাবরণ করেছেন, দেশান্তর হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ
দুঃখের আবরণে ঢাকা আমার হৃদয়ের বেদনা
আমার চোখে ভেসে উঠলো
আর আমি কিছুই করতে পারিনি।
পুরু ধুলো আমার বুকে জমে ছিল
অবশেষে বন্ধুদের কথা মেনে নিয়ে
আমার ধুলায় মাখা দুটি চোখ রক্তে ধুয়ে নিলাম।
তখন দুনিয়ার সব কিছু
আমার রক্তিম চোখের মতো
একই রং ধারণ করেছে।
সূর্যের সোনালী রঙ রক্তিম
চাঁদের রুপালি রঙ লাল
ভোরের আলোর হাসি রক্তিম
রাতের কান্নায় রক্তের অশ্রু।
প্রত্যকটি গাছ রক্তের মিনারের মতো
প্রতিটি ফুলও রক্তমাখা
প্রতিটি চাহনি যেন রক্তের বর্ষায় ভেজা তীর।
প্রত্যেক ছায়াও রক্তে ভেজা।
রক্তের নদী যতক্ষণ বহমান
রক্তের রঙ থাকবে লাল
শহীদদের জন্য বহমান রক্তের কান্না
আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, দুঃখের রঙ
ক্রোধ আর ভালবাসা
যদি নিভু নিভু আগুনের মতো নিভে যায়
শুধু ঘৃণা, রাত আর মৃত্যু
সবকিছুর রং এখন মাতমের রং।
বন্ধুরা কেন এমন হতে দিলে
এখন নিয়ে আসো আমার ঝরেপড়া অশ্রুর বন্যা
সেই অশ্রুতে আবার অজু করি
আমার দুচোখ ধুয়েমুছে পবিত্র করি
চিরতরে ধুয়ে যাক ধূলিকণায় ভরা দুই চোখের রক্ত।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে অনেক কিছুই সংযুক্ত করা যায়নি, অনেক কবিতা বাদ পড়েছে, অনেক কবিদের সম্বন্ধে আলোকপাত করা যায়নি। উর্দু সাহিত্যে যেভাবে ভারত বিভাগের ঘটনা ফুটে উঠে ছিল। সেই সময়ের কষ্ট, দুঃখ, দুর্দশা প্রকাশ পেয়ে ছিল তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর সংগ্রামের চিত্রও ফুটে উঠেছে।
উর্দু কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম
হাইকেল হাশমী
২৬ মে ২০২৩, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যে সংগ্রাম মুক্তিকামী গণমানুষের পক্ষে হয় তা সারা দুনিয়ার কবি লেখকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কবিরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন এবং সহজই মানুষের দুঃখ কষ্ট অন্যায় অবিচার উপলব্ধি করতে পারেন। কবিরা দুনিয়ার যে ভৌগলিক স্থানেই থাকেন না কেন, তারা মানুষের মুক্তিকামী সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি পোষণ করেন। এটা যুগে যুগে হয়ে আসছে। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসকের মতো এমন জঘন্যতম নিপীড়নের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর মেলে না। এমন অবস্থায় কোনো বিবেকবান ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে কথা না বলে থাকতে পারে না। লেখক আর কবিরা তো আরও সংবেদনশীল এবং তাদের চরিত্রের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজ বপন করা থাকে। উর্দু কবিরাও এর ব্যতিক্রম নন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে তাদের কলম নীরব থাকেনি। উপমহাদেশের উর্দু কবিরা বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসকারী উর্দু কবিরাও অনেক কবিতা লিখেছেন যাদের মধ্যে রয়েছেন কবি নওশাদ নূরী, আহমেদ ইলিয়াস, আতাউর রহমান জামিল, আহসান আহমাদ আশক প্রমুখেরা। এ প্রবন্ধে উপমহাদেশের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ উর্দু কবির কবিতার অনুবাদ এবং তাদের ওপর আলোকপাতের চেষ্টা এই লেখা। কবি নওশাদ নূরী বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষা আর ন্যায্য দাবির বিরাট সমর্থক ছিলেন। তিনি তার কবিতা আর সাংবাদিকতার দ্বারা বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং একটি কালজয়ী কবিতা ‘মহেঞ্জোদরো’ রচনা করেছিলেন যেটি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, সিন্ধি এবং জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যতগুলো গণ-আন্দোলন হয়েছিল তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তার একটি কবিতা যেটি পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির প্রেক্ষাপটে লেখা তা নিচে উদ্ধৃত করা হলো।
ছাব্বিশে মার্চ
নিষ্পাপ মজলুমের আলু-থালু চুলের মতো
ভর সন্ধ্যায় অন্ধকার শূন্যে ঝুলে আছে।
কামানের কালো ধোঁয়া জ্যোৎস্নার অমল প্রবাহ
সন্ন্যাসীর ছাইমাখা শরীরের মতো।
আজানের রেশ ভেঙে-ভেঙে পড়ছে
মসজিদে কে ঢুকেছে পিশাচ হালাকু খানের মতো?
দিগন্ত থেকে সূর্য নামল নিঃশব্দে ফসলের মাঠে
নিষ্পাপ অশ্রুর মতো।
বাঘের ভয়ে হরিণ যেমন ক’রে পালিয়ে বেড়ায়
তেমনি আল্লাহর সৃষ্টি দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফিরছে।
চারদিকে রক্তের ফোয়ারা
ঠোঁটগুলো বন্ধ আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা
কাগমারীতে, সন্তোষে, টুঙ্গিপাড়ায়-সবখানে
আহত পরিবেশে কানে-কানে নিচু স্বরে আলাপ।
আমার দৃষ্টি গলি-ঘুপচি, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল,
পাহাড়ে, জঙ্গলে সর্বত্র বুটের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মসজিদের মিনারে কামানের চিহ্ন দেখলাম
দোহাজারি থেকে ঝালকাঠি সবখানেই,
আঙিনার লাউ-মাচানে দেখলাম মদের বোতল পড়ে আছে,
আর ঘরের ভেতর বাহাদুর সেপাইদের বেলেল্লাপনা।
বাঁশের বেড়ার ওপর বেয়োনেটের দাগ দেখলাম
শীতল পাটির ওপর দেখলাম রক্তের আলপনা।
এখন, এই ঢাকাতে, করাচীর কল্পনা দুঃখজনক,
কাগান থেকে রাঙামাটির দূরত্ব আজ অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়াই একমাত্র পথ,
আর কোনো ওষুধ নেই;
ঘৃণার প্রচণ্ড আবেগ ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই,
জনগণের প্রচণ্ড বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
(অনুবাদ-কবি আসাদ চৌধুরী)
কবিতাতে কবি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো পথ নেই, জনগণের প্রচণ্ড বিদ্রোহ একমাত্র পথ এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, আর এখানে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ১৯৭১ সালে একজন উর্দু কবি এ ধরনের কবিতা রচনা করে কী ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
হাবিব জালিব পাকিস্তানের একজন বিপ্লবী কবি ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে লাহোরের মাল রোডে একটি জনসভায় বলেছিলেন, ‘এই সময় চুপ থাকা, প্রতিবাদ না করা একটি অসৎ কাজ আর কারারুদ্ধ না হওয়া অসম্মানের কাজ’। সেই জনসভায় তিনি তার খুব বিখ্যাত একটি কবিতা আবৃত্তি করে ছিলেন-
বন্দুকের গুলি দিয়ে প্রেম বপন করছো
দেশের মুখ রক্ত দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছো
তুমি মনে করছো সব রাস্তা করছো রুদ্ধ
আমি জানি তুমি তোমার গন্তব্য হারাচ্ছো।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
হাবিব জালিব আর একটি কবিতা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রচনা করেছিলেন। এ কবিতার পটভূমি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডব। তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তার বিপ্লবী চিন্তা ভাবনার জন্য। আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, জিয়াউল হক, কারও আমলে তিনি খুব বেশি দিন কারামুক্ত থাকতে পারেননি। তিনি ২৪ মার্চ ১৯২৪ সালে হোশিয়ারপুর, ভারতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩ মার্চ ১৯৯৩ সালে লাহোর, পাকিস্তানে মৃত্যুবরণ করেন।
বাগিয়া লাহু লাহান (বাগিচা রক্তে লাল)
সবুজের জন্য মন কাঁদে বাগিচা তো রক্তে লাল
প্রেমের গীত কেমন করে গাই শহর তো হলো সুনসান
বাগিচা তো রক্তে লাল
সূর্যের কিরণ করে দংশন, চাঁদের আলো ম্লান
পদে পদে মৃত্যুর ছায়া, জীবন তো মৃত্যুর সমান
পবনের হাতেও দেখি আমি মৃত্যুর তীর-কামান
বাগিচা তো রক্তে লাল
গুলিতে ঝাঁঝরা কলির বুক, রক্তে হয়েছে একাকার
জানি না আর কত দিন ঝরবে অশ্রুর বর্ষা
আর শেষ হবে কবে দুঃখ ভরা দিন-রাত
রক্তের হোলি খেলছে দেখো ধরণির বলবান
বাগিচা তো রক্তে লাল।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
ভারতের প্রখ্যাত প্রগতিশীল উর্দু কবি ক্যাফী আজমী এই জুলুম নিপীড়নের ওপর একটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছিলেন যেটা একটি মাইলফলক ছিল। ক্যাফী আজমী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ব্রিটিশ ভারত ছাড় সংগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি শ্রমিক নেতা ছিলেন, ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনে একজন বিশিষ্ট গীতিকার ছিলেন। তিনি ২০০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শাবানা আজমীর বাবা আর বিখ্যাত উর্দু কবি জাভেদ আখতারের শ্বশুর। কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ
আমি কোন দেশ নই যে আমাকে পুড়িয়ে দেবে
আমি কোন দেয়াল নই যে আমাকে গুঁড়িয়ে দেবে
কোন সিমান্ত নই যে আমাকে মুছে দেবে।
এই যে পৃথিবীর অধুনালুপ্ত মানচিত্র
তোমার টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখেছো,
এখানে উচ্ছৃঙ্খল রেখা ছাড়া আর তো কিছুই নেই
তাহলে তুমি কী করে খুঁজে পাবে আমাকে?
আমি স্বাধীনচিত্ত মানুষের আশা
আমি তো অমৃত স্বপ্ন মানবতার
যখন লুটপাট সব সীমানা ছাড়িয়ে যায়
যখন অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করে
তখন আমি হঠাৎ মনের কোণে জেগে উঠি
তখন আমি হৃদয়ের মাঝে ভেসে উঠি।
তুমি আমাকে আগেও দেখেছো
কখনো পূর্বে, কখনো পশ্চিমে
কখনো শহরে, কখনো গাঁয়ে
কখনো লোকালয়ে, কখনো অরণ্যে
আমার অতীত আছে, ইতিহাস আছে
কিন্তু আমার কোন ভূগোল নেই,
আর আমার ইতিহাসের পাঠ নিষিদ্ধ
লোকজন পাঠ করে গোপনে,
আমি কখনো বিজয়ী কখনো পরাজিত
কখনো আমার হত্যাকারীকে উঠিয়েছি ফাঁসির মঞ্চে
আর কখনো নিজে হয়েছি ক্রুশবিদ্ধ।
শুধু একটি পার্থক্য,-
আমার হত্যাকারীরা মরে যায়
আর আমার কোন মৃত্যু নেই।
তোমরা যে কতো মূর্খ!
ভিক্ষায় পেয়েছো যে ট্যাংকগুলো
তা দিয়ে আমাদের করো পিষ্ট
দিন রাত করো নাপাম বোমার বৃষ্টি,
শুনে রাখো, একদিন হয়ে যাবে ক্লান্ত
আমার কোন হাতে পরাবে হাতকড়া বলো
আমার তো আছে সাত কোটি হাত,
বলো, আমার কোন ঘাড় থেকে করবে মাথা বিছিন্ন
আমার তো সাত কোটি ঘাড়ে আছে সাত কোটি মাথা।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রগতিশীল কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এপ্রিল ১৯৭১ সালে একটি কবিতা লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল বাংলাদেশ। ফয়েজ উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি, তাকে আল্লামা ইকবালের পরে প্রভাবশালী উর্দু ভাষার কবি বলা হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, শ্রমিক নেতা ছিলেন, পাকিস্তান টাইমস’এর সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। কারাবরণ করেছেন, দেশান্তর হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবিতাটি নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ
দুঃখের আবরণে ঢাকা আমার হৃদয়ের বেদনা
আমার চোখে ভেসে উঠলো
আর আমি কিছুই করতে পারিনি।
পুরু ধুলো আমার বুকে জমে ছিল
অবশেষে বন্ধুদের কথা মেনে নিয়ে
আমার ধুলায় মাখা দুটি চোখ রক্তে ধুয়ে নিলাম।
তখন দুনিয়ার সব কিছু
আমার রক্তিম চোখের মতো
একই রং ধারণ করেছে।
সূর্যের সোনালী রঙ রক্তিম
চাঁদের রুপালি রঙ লাল
ভোরের আলোর হাসি রক্তিম
রাতের কান্নায় রক্তের অশ্রু।
প্রত্যকটি গাছ রক্তের মিনারের মতো
প্রতিটি ফুলও রক্তমাখা
প্রতিটি চাহনি যেন রক্তের বর্ষায় ভেজা তীর।
প্রত্যেক ছায়াও রক্তে ভেজা।
রক্তের নদী যতক্ষণ বহমান
রক্তের রঙ থাকবে লাল
শহীদদের জন্য বহমান রক্তের কান্না
আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, দুঃখের রঙ
ক্রোধ আর ভালবাসা
যদি নিভু নিভু আগুনের মতো নিভে যায়
শুধু ঘৃণা, রাত আর মৃত্যু
সবকিছুর রং এখন মাতমের রং।
বন্ধুরা কেন এমন হতে দিলে
এখন নিয়ে আসো আমার ঝরেপড়া অশ্রুর বন্যা
সেই অশ্রুতে আবার অজু করি
আমার দুচোখ ধুয়েমুছে পবিত্র করি
চিরতরে ধুয়ে যাক ধূলিকণায় ভরা দুই চোখের রক্ত।
(অনুবাদ-হাইকেল হাশমী)
এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে অনেক কিছুই সংযুক্ত করা যায়নি, অনেক কবিতা বাদ পড়েছে, অনেক কবিদের সম্বন্ধে আলোকপাত করা যায়নি। উর্দু সাহিত্যে যেভাবে ভারত বিভাগের ঘটনা ফুটে উঠে ছিল। সেই সময়ের কষ্ট, দুঃখ, দুর্দশা প্রকাশ পেয়ে ছিল তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর সংগ্রামের চিত্রও ফুটে উঠেছে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2023