নাগিব মাহফুজের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আমার কাছে স্কুল ছিল কারাগারের মতো

  
২৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

নোবেল বিজয়ী মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ আরবি সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে আধুনিক আরবি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বিবেচনা করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং নাট্যকার। ‘কায়রো ট্রিলজি’র জন্য দেশ-বিদেশের পাঠকের কাছে সুপরিচিত। এ ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সুদীর্ঘ সত্তর বছরের সাহিত্যিক জীবনে ৩৫টি উপন্যাস এবং প্রায় ৩৫০টি ছোটগল্প (যা ষোলটি ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত), পাঁচটি নাটক এবং প্রায় ২৫টি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। নাগিব মাহফুজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির আগে এবং পরে, বিশেষ করে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশের সময় কিংবা প্রচারকালীন অসংখ্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার এ সাক্ষাৎকারটি যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো নিবাসী মার্কিন লেখক এবং সাংবাদিক জোনাথান কুরিয়েল ১৯৯০ সালে গ্রহণ করেছিলেন। পুরো সাক্ষাৎকারে নাগিব মাহফুজ তার কথাসাহিত্যে প্রাথমিক প্রভাব; তার শেষ আন্তর্জাতিক সাফল্য (মাহফুজ তখন ৭৭ বছর বয়সি ছিলেন এবং দু’বছর আগে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন); ইসলামি মৌলবাদ এবং তার জীবনের বিরুদ্ধে হুমকি; সালমান রুশদি; মিসর-ইসরায়েল সম্পর্ক এবং প্রতিদিন সকালে তার অভ্যাসগত হাঁটাচলা সম্পর্কে খোলামেলা আলাপ করেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ সম্পর্কে কুরিয়েল বলেছেন, সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ম্যাকলিন’স ম্যাগাজিন তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল এবং তিনি যথারীতি তা করেছেন। কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে ম্যাকলিন’স ম্যাগাজিন তার নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেনি। পরবর্তী সময়ে কুরিয়েল তা প্রকাশ করেন। কেননা তার বিশ্বাস ছিল যে, সাক্ষাৎকারটি নাগিব মাহফুজের জীবন লেখালেখি এবং সাহিত্যের জগতের অজানা বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি করবে। কায়রোতে নৃশংসভাবে হামলার চার বছর আগে নাগিব মাহফুজ তার জীবনের হুমকি নিয়ে কৌতুক করেছিলেন বলে প্রশ্নোত্তরের একটি ভীতিকর পূর্বজ্ঞানও রয়েছে। উল্লেখ্য, নাগিব মাহফুজ ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কুরিয়েল উল্লেখ করেছেন, সাক্ষাৎকারের সময় লেখক প্রচুর হেসেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, লেখকের এমন হাস্যোজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য তিনি আশা করেনি, তবে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। অনুবাদ ও ভূমিকা : ফজল হাসান

আপনি সতের বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেছেন। লেখক হওয়ার জন্য আপনাকে কি প্রভাবিত করেছিল?

: আমার মাঝে মধ্যে খুব ভালো করেই মনে পড়ে পড়া। যদিও আমার শৈশবে গোয়েন্দা গল্প ছাড়া শিশুদের জন্য কোনো বই ছিল না (হাসি)। আমাদের কাছে এখনকার মতো শিশুদের জন্য সাহিত্য ছিল না। তখন আসলে আমার আর কোনো উপায় ছিল না

আপনার উপন্যাসে প্রায়ই সমস্যায় জর্জরিত পরিবার দেখানো হয়; যেমন-ছেলেমেয়ে যারা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায়, বাবা-মা যাদের দাম্পত্য জীবন ভালো মতো চলে না, ইত্যাদি। এ বিষয়টি কি আপনার শৈশব জীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা?

: তা ঠিক নয়। আমি হয়তো পরিবারের সমস্যা অথবা শহরের সমস্যা অথবা যে কোনো সমস্যা সম্পর্কে, যা আমি কাগজের মাধ্যমে জানতে পারি, তা নিয়ে লিখতে পারি। আমি নিজেকে অত্যন্ত সুখী মানুষ মনে করি। অবশ্যই আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি এত সুখী ছিলাম না; কারণ, আমার কাছে স্কুল ছিল কারাগারের মতো এবং এ ধরনের অনেক কিছু। তবে অন্যান্য পরিবারের তুলনায় আমি মনে করি আমার শৈশব অবশ্যই খুব ভালো ছিল।

আপনার জীবনের এ পর্যায়ে পৌঁছে আন্তর্জাতিক সাফল্য অর্জনের অনুভূতি কেমন?

: সত্যিই আমি খুবই বিস্মিত, কেননা আমি এ সম্পর্কে ভাবিনি।

নোবেলপ্রাপ্তি কি আপনার জীবন বদলে দেয়নি?

: না। আমি আমার জীবনের চূড়ায় পৌঁছেছি, তাই এখন বদলে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। হয়তো আমার পরিবারের জীবনধারাকে পরিবর্তন করেছে; হ্যাঁ, তবে আমার জীবন নয়। তারা আর্থিকভাবে অনেক বেশি নিরাপত্তা লাভ করেছে; কিন্তু আমার জীবন একই আছে। আমি এখনো প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন পড়ার জন্য আলি বাবাতে (কায়রো শহরের ক্যাফে) যাই। প্রতিদিন সকালে আমি আনুমানিক এক ঘণ্টা হাঁটি।

কুড়ি বছর আগে আপনার লেখা ‘চিলড্রেন অব গেবেলাউয়ি’ উপন্যাসের জন্য সম্প্রতি ইসলামি মৌলবাদীরা আপনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। (উপন্যাসটি ইংরেজিতে ‘চিলড্রেন অব দ্য অ্যালি’ নামেও প্রকাশিত হয়েছিল।) এতে নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর পাশাপাশি, ঈসা (আ.) ও মুসা (আ.)-এর চরিত্রের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে-এমন একটি প্রতীক যা কেউ কেউ বলেছিলেন, ইসলামকে অবমাননা করা হয়েছে। আপনি কি উৎকণ্ঠিত নন?

: না। আর আমি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীদের প্রস্তাব (সরকার কর্তৃক প্রদত্ত) প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা যদি সত্যিই আমাকে হত্যা করতে চাইত, তাহলে তারা করত। তারা আদৌ ভয়ংকর নয়। আমাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার চেয়ে তাদের আরও গুরুতর উদ্দেশ্য রয়েছে (হাসি)।

তাহলে ‘চিলড্রেন অব গেবেলাউয়ি’ এবং সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে?

: হ্যাঁ, যদিও উগ্রপন্থি মৌলবাদীরা বিশ্বাস করে যে, গ্রন্থ দুটি একই।

সালমান রুশদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?

: সালমান রশদী, সত্যি বলতে কি তার গ্রন্থে ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননা রয়েছে। আমি রুশদীর বই পড়িনি, (কিন্তু) বই সম্পর্কে শুনেছি। টেলিভিশন এবং রেডিওর লোকজন যারা তার সম্পর্কে জানার জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তারাও রুশদীর বই পড়েনি। আমি শুনেছি এবং পড়েছি যে, বইটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার কথা রয়েছে। আমার বইয়ের তুলনা করে বলতে পারি যে, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কিন্তু আমি মানবতার ইতিহাসের জন্য কিছু দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছি, যেভাবে আমি কল্পনা করেছিলাম। হয়তো আমি ঘটনার বর্ণনায় স্বাধীনতা নিয়েছি, যা ধর্মের মানুষকে বিরক্ত করেছে।

রাজনীতি নিয়ে কথা বলার জন্য আপনার পরিচিতি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে আপনি কী ভাবেন?

: সব আরববাসী শান্তি চায় এবং কমপক্ষে অর্ধেক ইসরায়েলিরাও তাই চায়। সুতরাং আমি কোনো না কোনোভাবে আশাবাদী। ইসরায়েলের কোনো বিপদ ছাড়াই ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আপনি কি কখনো রাজনৈতিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভেবেছেন?

: না। আমি এ নিয়ে (রাজনীতি) ভাবি এবং লেখি, তবে একজন লেখক হিসাবে।

আপনি কি নতুন কোনো উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন?

: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে আমি কয়েকটি ছোটগল্প লিখেছি, এখনো সংকলিত বা প্রকাশিত হয়নি।

কেন?

: কেননা আমার চোখের দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তি খুবই দুর্বল। আমি সারা দিন দু’ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারি না-এক ঘণ্টা পড়াশোনা করার জন্য এবং আরেক ঘণ্টা লেখার জন্য। আগে আমি প্রায় তিন ঘণ্টা লিখতাম এবং প্রায় চার কিংবা পাঁচ ঘণ্টা পড়তাম।

আপনি আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে কী ভাবেন?

: আমি হেমিংওয়ের প্রজন্মের লেখক। আমি ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত অনেক নতুন বই পড়েছি এবং সেগুলো অগ্রদূতদের পরিমাপ নয়। প্রথম শতাব্দী থেকে এ অর্ধশতক পর্যন্ত সময়কালে সাহিত্য একই স্তরে নেই-সাঁত্রে এবং কামু।

আপনি আপনার অনেক উপন্যাসে যে মিসর সম্পর্কে লিখেছেন-এ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাগের মিসর আপনার কী মনে হয় না তা পরিবর্তিত হয়েছে?

: একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে এবং তা একই রকম নয়। এখন অনেক নারী কাজ করছে, সমাজে তারা আরও বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছে। একইসঙ্গে প্রতিদিন আমরা পাঠক হারাচ্ছি। সম্ভবত এটি টেলিভিশন এবং অন্যান্য পরিবর্তনের প্রভাব।

আপনার উপন্যাস থেকে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকরা কী পাবেন বলে আপনি আশা করেন?

: আমি আশা করি, তারা আমার উপন্যাসকে সাহিত্য হিসাবে খুঁজে পাবে (হাসি)। আপনি যেমন লন্ডনকে জানার জন্য ডিকেন্স বা প্যারিসকে জানার জন্য বালজাক পড়েন, তাতেও সত্যিকারের আনন্দ আছে। এটাই প্রথম উদ্দেশ্য; বাকি সবকিছুই গৌণ। যে কোনো বিদেশি সংস্কৃতির দৈনন্দিন জীবন জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে তার প্রথম লক্ষ্য অবশ্যই শৈল্পিক হতে হবে।

আর আপনি কী মনে করেন যে, তারা আবিষ্কার করবে আপনার উপন্যাসের চরিত্ররা কিছুটা তাদের মতো হয়েছে?

: হ্যাঁ, সম্ভবত। তারা (চরিত্ররা) হয়তো অদ্ভুত পোশাক পরতে পারে এবং তাদের মধ্যে কিছু হয়তো জটিলতা থাকতে পারে, তবে সম্ভবত তাদের প্রকৃতি একই রয়েছে।

সূত্র: জোনাথন কুরিয়েলের ব্লগ, ২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর পোস্ট করা হয়। পরবর্তীতে (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০) ‘দ্য ইন্টারনেট আর্কাইভ’-এ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন